somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্যময় বগুড়ার গোবিন্দভিটা!!!

১৯ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ৮:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাজার বছর ধরে স্তূপটির পরিচিত নাম গোবিন্দভিটা। এর অবস্থান, আকার, বিন্যাস সবই যেন রহস্যময়। ঐতিহাসিকদের মতামত, প্রত্নতাত্তি্বকদের পর্যবেক্ষণ, গবেষকদের অনুসন্ধান_ সবকিছুই যেন এখানে এসে এক জটিল গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। উঁচু, এই আপাত ইটের তৈরি বিচিত্র স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে করতোয়া নদীর ক্ষীণধারার দিকে তাকিয়ে এর নির্মাণ সূচনার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। বরং বিশেষজ্ঞদের মতের বিভিন্নতার কারণে বিভ্রান্তি আরও বেড়ে যায়। অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্ন হাজার বছর ধরে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। বগুড়া শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে প্রাচীন দুর্গনগরী মহাস্থানগড়। এর আদি নাম পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধন নগর। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ বিবরণীতে এই নগরীকেই 'পো-শি-পো' বলে উল্লেখ করেছেন। মহাস্থানগড়ের দুর্গটি ছিল এক বর্গমাইল বিস্তৃত। ১৫ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু পোড়ামাটির মজবুত ইটের তৈরি দেয়ালের চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। চীনের গ্রেটওয়ালসদৃশ এই দেয়াল দেখলেই অনুমান করা যায় এর ভিতরে একটা সমৃদ্ধ-সম্পদশালী জনপদের বিকাশ ঘটেছিল। এখানে পাওয়া সবচেয়ে পুরনো প্রত্নতাত্তি্বক নমুনা থেকে প্রমাণিত হয়, এই প্রাচীন জনপদ যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগেই গড়ে উঠেছিল।

দুর্গনগরীর প্রাচীরের উত্তর-পূর্ব দেয়ালের বাইরে গোবিন্দভিটার অবস্থান। এর দক্ষিণে সরকারি রেস্টহাউস, পশ্চিমে বগুড়া-শিবগঞ্জ সড়ক, উত্তরে সামান্য ফাঁকা জায়গা ও পূর্বদিকে বয়ে গেছে করতোয়া নদী। গোবিন্দভিটায় প্রথম প্রত্নতাত্তি্বক খনন কাজ চালানো হয় ১৯২৮-২৯ সালে। দুটি বড় ভবনের ভিত্তিমূল খননের ফলে উন্মোচিত হয়। তখন এখানে ষষ্ঠ শতক থেকে তুর্কি বংশীয় সুলতানি আমল পর্যন্ত চারটি নির্মাণস্তর পাওয়া যায়। সবচেয়ে উপরের স্তরটি সুলতানি আমলের। তখনকার রত্ন, অলঙ্কার ও অন্যান্য উপকরণ দেখে মনে হয়, এখানে একটি সমৃদ্ধ বিপনকেন্দ্র বা বাজার ছিল। কিছু মূল্যবান মুদ্রা এখানে পাওয়া যায়। যেগুলোর গায়ে 'শহর-ই-নৌ' নামের একটি টাকশালের নাম খোদাই করা। মুদ্রাগুলো লক্ষ্মৌর স্বাধীন সুলতান শামছুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ( ১৩৫৭ খ্রি. ) থেকে শামছুদ্দিন ইউসুফ শাহ (১৪৮০ খ্রি. ) পর্যন্ত সময়ে মুদ্রিত। এ থেকে অনেকে মনে করেন, গোবিন্দভিটাই ওই 'শহর-ই-নৌ' টাঁকশাল।

১৯৬০ সালে এখানে আবার ব্যাপকভাবে খনন করা হয়। তখন পাওয়া যায় কানের দুল, বোতাম, নাকফুল, এগেট, কর্নেলিয়ান, চকচকে এবং রেখাযুক্ত মূল্যবান পাথর, মার্বেল, স্ফটিক, কাচ, ক্যালসেডনি, পোড়ামাটির পুতুল ও খেলনা, ব্রোঞ্জ ও তামার শলাকা, আংটি ও ব্রেসলেটের মতো গহনাসহ আরও অনেক প্রত্নবস্তু। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো নমুনা হলো- খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মৌর্য আমলের। মৌর্য যুগের ছাপমারা ঢালাই মুদ্রা ও এনবিপি মৃৎপাত্র পাওয়া যায় এখানে। মাটি খুঁড়তে গিয়ে একদম নিচের অকর্ষিত ভূমি পর্যন্ত আলাদা ১৭টি স্তর পাওয়া যায়। এর প্রত্যেকটিই নাকি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অস্তিত্ব প্রমাণ করে। এখানে ৬ষ্ঠ শতকের একটি নির্মাণস্তর পাওয়া যায়, যেখানে কিছু বিশেষ সামগ্রী বিস্মিত করে। সে যুগের ক্ষুদ্র পাথর-নুড়ি ঠাসা এবং ইটের টুকরো মিশ্রিত একটি মেঝে পাওয়া গেছে এখানে। মেঝেতে তিনটি মাটির কলসি পাওয়া গেছে, যেগুলোর অর্ধেক অংশ ভরা ছিল ঝিনুকের চুন দিয়ে। একটি কলসির ভিতর মানুষের এক টুকরো অস্থি পাওয়া গেছে।

এখানে পাওয়া অসংখ্য প্রত্নবস্তু থেকে ধারণা নিয়ে প্রত্নতাত্তি্বকরা বলেন, গোবিন্দভিটা আসলে একটি উপ-সামুদ্রিক নৌবন্দর এবং বিদেশজাত শৌখিন দ্রব্যাদির বাজার ছিল। ঠিক নদীর পাড়েই এর অবস্থান, আশপাশের নদীভিত্তিক কাঠামো এবং গঠনপ্রণালী বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায়।

গোবিন্দভিটার ২০০ গজ উত্তরের একটি বিশেষ স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করে সেটাকে 'ঘাঘর দুয়ার' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুলতানি আমলে নৌবন্দরসংলগ্ন বাজারকে ঘাঘর বলা হতো। 'ঘাঘর' বা 'ঘাগর' শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। জমকালো পরিস্থিতির বিষয় উল্লেখ করতে এটি ব্যবহৃত হতো। সময়ের বিবর্তনে গোবিন্দভিটা প্রথমে নৌবন্দর ও তার কয়েকশ' বছর পরে 'শহর-ই-নৌ' টাকশাল হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। প্রত্নতত্ত্ব সূত্রে জানা যায়, তুর্কি রাজবংশ ১৪ শতক থেকে মহাস্থানগড়ে তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপন করে কয়েকশ' বছর রাজত্ব করেছে। সেই বংশের যুবরাজ সেকেন্দার শাহ এ এলাকার প্রশাসক ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। 'শহর-ই-নৌ' বা বর্তমান গোবিন্দভিটা ছিল তাদের দ্বিতীয় টাকশাল।

গোবিন্দভিটায় পাওয়া সেই মাটির কলসির অস্থিসম্পর্কিত একটি বৌদ্ধ শ্লোক পাওয়া যায়। যার অর্থ, ' মহাকচ্চান স্থবির বুদ্ধের পূতাস্থি স্বর্ণপাত্রে ভরে পোতনগরে নিয়ে আসেন। তা থেকে একখণ্ড পূতাস্থি রাজকুমারকে প্রদান করেন এবং কুশল ইচ্ছুক রাজকুমার সেই উত্তম ধাতু নিধান করেন এবং তার ওপরে মহাস্তূপ নির্মৃাণ করে শ্রদ্ধার্ঘ্য দান করেন।' এই শ্লোক থেকে গোবিন্দভিটার আরেকটি নাম পাওয়া যায়, পোতনগর। এটি নদীবন্দর এবং প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধকীর্তি সেটাও বোঝা যায়।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×