somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প - পান্না স্যার

১৮ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ পান্না স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে, অকৃত্তিম অজস্র ভালবাসাই ছিল যার একমাত্র সম্পদ। একবার শুনেছিলাম তিনি নাকি উচ্চ মাধ্যমিকের কোঠাই পেরুতে পারেননি, তাতে কি হয়? উচ্চ মাধ্যমিকের কোঠা পেরুলেই কি মানুষ সৎ হয়ে যায়, মানুষ ভালবাসা শিখে যায়?? মাথার অর্ধ-প্রাঙ্গন কেশমুক্ত, গলার নীচের চামড়াগুলো শুষ্ক ভাঁজ পড়া, শুকনো জীর্ন শরীরের পান্না স্যারকে অনেক ব্যাচের ছাত্ররা পৃত্তিতুল্য বলে দাবী জানালেও, আমাদের কাছে স্যার যে ঠিক কেমন ছিলেন, অথবা কি দিয়ে যে স্যারের গুনাবলী প্রকাশ করব, কখনোই সেটা বুঝে উঠতে পারিনা, হয়তোবা বুঝে ওঠার চেষ্টাই করিনা, পাছে অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের সাথে স্যারকে গুলিয়ে ফেলি সেই ভয়ে। পান্না স্যারের কাছে আমাদের পাঠ্য বিষয় ছিল বাংলা, শুদ্ধ করে বললে ব্যাকরণ। উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া এক লোক কিভাবে এত সুন্দর করে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রদের শেখায় তা রহস্যই ঠেকত তখন, তবে এখন বুঝি স্যার প্রায়ই কেন বলতেন, 'দ্যাখ, স্ট্যান্ড করা ছাত্ররা যাদের পড়ায় তাদের সবাই কিন্তু স্ট্যান্ড করেনা, আবার অনেকেই আছে যারা স্ট্যান্ড করা না, কিন্তু তাদের অনেক ছাত্রই স্ট্যান্ড করে'। স্যারের অনেক তত্বীয় কথাই তখন মাথায় ঢুকতনা, ঢুকবে কি করে? মাথাটাতো তখন আমরা কেউই স্যারের কথায় নয় বরং স্যারের অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে ডলির পেছনে খাটাচ্ছিলাম। তাই হয়ত তখন বিগ্গান, অংকের মত কঠিন বিষয়গুলো বাড়ীতে শেষ করে বাংলা পড়তে যেতাম স্যারের বাসায়। যেকোন অজুহাতে স্যারের বাড়ীর অন্দরমহলে প্রবেশ করাটাই ছিল নিত্যদিনকার একমাত্র উদ্দেশ্য। আর সে সুযোগটা স্যার নিজেই করে দিতেন, একেকদিন একেকজনকে ডেকে বলতেন 'যাতো ভেতরে, তোর চাচীর সাথে দেখা করে আয়'। চাচীর সাথে দেখা করার জন্য আমরা যেমন মুখিয়ে থাকতাম, বোধ হয় চাচীও তেমন আমাদেরই পথ চেয়ে বসে থাকতেন, কারন আমদের কেউ একজন নাহলে যে পুত্রসন্তানহীন চাচীর নিত্যদিনকার বাজার করা হয়না। আর শুধু বাজার কেন, চাচীর কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা সব করতে আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলাম শুধু এক নজর ডলির দেখা পাওয়ার লোভে। আর চাচী বাজারের ফর্দ আর ব্যাগ ডলির হাতেই পাঠাতেন, আর বাজার করে এনেও ডলির হাতেই দিতে হত, এ দুই ডলি দর্শনের মাঝের সময়টা উত্তর হতে দক্ষিন মেরূ ঘুরে এলেও ক্লান্তি স্পর্ষ করতনা আমাদের কাউকেই। আর ডলিও কাউকেই নিরাশ করতনা, কতক্ষন চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে মিহি এক হাসি দিয়ে ভেতরে চলে যেত। সেই মিহি হাসি যে আমাদের কয়েকশো বন্ধুর প্রথম প্রেমের একমাত্র সম্বল তা আজ হলফ করে বলতে পারি।
কখনো মনে হয় শুধু ডলি নয় স্যারের ভালবাসার টানেই ছুটে যেতাম স্যারের কাছে। স্যারের কাছে পুরো সময়টাই গল্প করে চলে যেত, তার মাঝে কিছু পাঠ্য হলেও হত, আর হলেও সেটা আমাদের নজরে পড়তনা যতক্ষন পরীক্ষার খাতা না লিখতাম। কেননা পরীক্ষার দিন স্যারের গল্প মনে পড়লেই অধিকাংশ লিখা শেষ হয়ে যেত। স্যারের কাছ থেকে শাস্তি পেতাম খুব কম, এমনিতে তার ছাত্রদের তিনি শাস্তি দেয়ার কথা চিন্তাও করতেন না, তবে খুব বেশী কারো উপর রেগে গেলে কঠিন শাস্তি দিতেন, আর সেটা সহ্য করা আমাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতনা, স্যারের শাস্তি ছিল আগামী এক সপ্তাহ স্যারের বাড়ীর ধারে-কাছে যাতে না যাই।
আজ পান্না স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে, কারন স্যার আজ নেই, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ছুটেছিলাম বড় বড় ডিগ্রীর সন্ধানে, তার পর মোটা বেতনের চাকুরী, তার পর সময়ের জাহাজে চড়তে চড়তে এসে ঠেকেছি রন্গীন আলোর শহরে, সেই মলীন মফস্বলের পান্না স্যারের কথা বেমালুম ভুলে বসে ছিলাম, হয়ত স্যারের স্মৃতিগুলো মনের কোন এক কোনায় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গত আষাঢ়ে আত্মীয়ের বিয়েতে বাড়ী যাওয়া হয়েছিল বহূ বছর পর। হঠাৎ শুনলাম স্যার খুব অসুস্থ, আর নিজের আবেগ সামলাতে পারলাম না, ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে গেলাম স্যারের বাসায়। গিয়ে জানতে পারলাম স্যারের লিভার নষ্ট হয়ে গেছে, শরীরের প্রতি অযত্ন অবহেলায় হয়ত এমনটা হয়েছে, অনেকবার হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, স্যার কিছুতেই যেতে রাজী নয়। স্যারের মাথার পাশে এসে দাড়ালাম। শরীর ভেন্গে একাকার হয়ে গেছে, কন্ঠনালী বেরিয়ে এসেছে বেশ খানিকটা, চোখগুলো শুকিয়ে অনেকখানি ভেতরে ঢুকে গেছে। কোনভাবেই চিনতে পারছিলেন না আমাকে, অনেক কষ্টে চেনাতে পেরেছিলাম নিজেকে, চোখের কোনায় শুকনো চামড়া বেয়ে দু ফোটা গড়িয়ে পড়া অস্রু অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিল আমায়। শুধু আমার মাথা টেনে একটু নীচে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল ' তুইতো অনেক বড় হয়ে গেছিসরে, চিনতেই পারছিলাম না '। আমার দু চোখ যেন অস্রুভরা হয়ে উঠছিল, স্যারের হাত সরিয়ে তার বুকের ওপর রেখে দ্রুত বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। সেখানে কয়েকটা অল্পবয়েসী ছেলে শুকনো মুখে বসে আছে। নতুন ছাত্র হবে হয়ত, আমায় দেখে সবাই একসাথে তাকাল, আমিও ভদ্রতা মেনে হাসি দিলাম, এতে তাদের মুখাভন্গির তেমন পরিবর্তন হল বলে মনে হয়না, বরং ছেলেগুলো সেখান হতে উঠে চলে গেল। কখন যে চাচী এসে পেছনে দাড়িয়েছিল বুঝতেও পারিনি, পেছন ফিরতেই চাচী বলল ' ছেলেগুলো কি চলে গেছে??' বললাম 'হ্যা এইতো একটু আগেই'। চাচী বেশ কিছুক্ষন ইতস্তত করে বললেন ' বাবা, একটা কথা বলতাম, ছেলেগুলোও নেই, কিভাবে যে বলি, তোমার স্যারের কিছু ঔষধ আনা জরূরী ছিল, যদি কিছু মনে না করতে'। আমি যতটা সম্ভব বিনয়ী হয়েই বললাম ' চাচী, যাকে দিয়ে একসময় এত সদাই করালেন, আজ তাকে দোকানে যেতে বলতে এতটা ইতস্তত করা ঠিক না'। চাচী আর কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পর শাড়ী পরা এক মধ্য বয়স্ক মহিলা এসে সামনে দাড়ালেন। একটা মিহি হাসি দিয়ে প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিলেন আমায়, হাসি দেখে বুঝলাম এ ডলি ছাড়া আর কেউ নয়, কিন্তু একি অবস্থা শরীরের, সেই খাড়া নাকটা আর বৃস্তিত চোখের পাতা ছাড়া আর কিছুইতো নেই। খেয়াল করলাম সময় আমার সেই হৃদকম্পন কেড়ে নিয়ে গেছে, যে কম্পন হত অনেক বছর আগে ডলির সেই মিহি হাসি দেখে। কিছুটা সময় নিয়ে কথা বললাম তার সাথে, জানতে পারলাম বিয়ে হয়েছে সে অনেকদিন, বাচ্চাও আছে একটা, স্বামী যে কোন এক দুর্ঘটনায় মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর স্যার নিয়ে এসেছিলেন নিজের বাড়ীতে, বাচ্চাটাকে আনতে দেয়নি শ্বশুর বাড়ীর লোকজন। ডলিও আর বিয়ে করতে রাজী হয়নি। সেদিনের সেই আবেগ আর নেই আজ। তাই ডলিকে বিদায় জানিয়ে প্রেসক্রিপশন নিয়ে ছুটে চললাম ঔষধের খোজে।
এরপর কদিন যাওয়া হয়নি স্যারের বাসায়, আত্মীয়ের বিয়েতে ভালই ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম, বিয়ে শেষ হওয়ার একদিন আগে জানতে পারলাম স্যার আর নেই, ওদিন সকালেই স্যার আমাদের ছেড়ে গেছেন। স্যারের ভালবাসা সিক্ত স্মৃতিগুলো আজ বহূদিন পর ঘুম থেকে জেগে উঠল, আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম সেই আসরেই।


(আমার এই গল্পটি শ্রদ্ধেয় রসায়ন শিক্ষক বাবু খগেন্দ্রনাথ স্যার কে উৎসর্গ করলাম, যাকে এখনো টিউশন ফি বাবদ ৩০০০ টাকা দেয়া হয়নি, উল্টো যাতে বাবার কাছে বিচার না দেয়, সেই ভয়ে টেলিফোনে দেয়া হয়েছিল হুমকি। শারদীয় দুর্গা পূজা উপলক্ষে স্যারের প্রতি রইল এই নিকৃষ্টের অজস্র শুভাকাংখা)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১০:১৫
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×