আগে বাজার থেকে সাধারণত বড় মাছ কিনলে বিক্রেতারা দড়ি দিয়ে মাছটিকে এমনভাবে বেঁধে দিতেন, যেন ক্রেতারা মাছটি হাতে ঝুলিয়ে নিতে পারে। ফলে মাছ নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাবার সময় পরিচিত-অপরিচিত সবাই-ই মাছের দাম জিজ্ঞেস করতেন। রাজ-দরবারে একদিন এই বিষয়টি নিয়েই সবাই আলোচনা করছিলেন। রাজ-দরবারের উজির-নাজিরসহ সবাই-ই মন্তব্য করছিলেন যে, মাছ কিনে বাড়ি ফিরবে কিন্তু কেউ সেই মাছের দাম জিজ্ঞেস করবে না, এমনটা অসম্ভব। গোপাল ভাঁড় এসময় বলে উঠলেন যে, তিনি মাছ কিনে অন্যদের মতই দড়ি দিয়ে বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসবেন, কিন্তু কেউ-ই তাকে মাছের দাম জিজ্ঞেস করবে না। রাজা একথা শুনে বললেন, গোপাল ভাঁড় যদি সত্যিই এমনটি পারে, তবে তাকে পুরষ্কৃত করা হবে। গোপাল ভাঁড় কথা মোতাবেক বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটি ইলিশ মাছ কিনলো। বিক্রেতা তার মাছটি দড়ি দিয়ে বেঁধে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিলো। মাছ নিয়ে রওনা হওয়ার আগে গোপাল ভাঁড় তার পরনের ধুতিটি খুলে মাথার সঙ্গে বেঁধে দিগম্বর হয়ে রাজ-দরবারের দিকে রওনা হলো। রাস্তার লোকেরা গোপাল ভাঁড়ের এমন অবস্থা দেখে মাছের দাম জিজ্ঞেস করবে কি, তারা তো হেসেই খুন। কেউ-ই আর গোপাল ভাঁড়কে মাছের দাম জিজ্ঞেস করলো না। রাজ-দরবারে ঢোকার আগে গোপাল ভাঁড় পরনের কাপড় আবার ঠিক করে রাজ-দরবারে ঢুকলো। রাজাসহ অন্যরা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সবিস্তারে তা বর্ণনা করলো। রাজাও তখন গোপাল ভাঁড়ের উপস্থিত বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে পুরষ্কৃত করলেন।
উপরোক্ত কাহিনীটি বর্ণনা করার কারণ হলো, সাম্প্রতিক সময়ের একটি বিষয়কে তুলে ধরা। আমরা যারা কোন ধরণের যন্ত্রচালিত বাহনের অধিকারী নই, তাদের জন্য অপরিহার্য বাহন হলো রিকশা। অথচ ইদানিংকালে যে হারে রিকশা ভাড়া বাড়ছে তাতে মনে হয় সিএনজি বা ট্যাক্সিক্যাবগুলোর সঙ্গে রিকশা ভাড়ার খুব বেশি তফাৎ বোধ হয় আর ক'দিন পরে থাকবে না। রিকশায় উঠলেই নাকি ১০/২০ টাকার কমে ভাড়া হয় না, এমন ডায়লগ এখন প্রায় সব রিকশাওয়ালারই মুখে মুখে। আর দুরত্ব যদি একটু বেশি হয় তবে তো আর কথাই নেই, অনায়াসে ৪০-৫০ টাকা চেয়ে বসবে তারা। তাদের রিকশা ভাড়া বাড়ানোর কারণ দেখায় দুটি। এক. মহাজন রিকশার জমা বাড়াইছে এবং দুই. জিনিসপত্রের এতো দাম ..
অথচ বাস্তবতা হলো, রিকশার মহাজনরা প্রতিটি রিকশার জমা পূর্বে যা নিতেন তার চেয়ে খুব বেশি বাড়ান নি। কয়েকজন রিকশা মহাজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি যে, তারা পূর্বে হয়তো জমা রাখতেন প্রতিদিন ৩০-৫০ টাকা। আর এখন রাখছেন ৫০-৮০ টাকা। অথচ এই জমা বাড়ার অজুহাতে রিকশায়ালারা ভাড়া বাড়াচ্ছে ৩-৪ গুণ!
অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে-কমবে এটা অর্থনীতির শিক্ষার্থীরা ভালো বুঝলেও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে বোধ হয় এই তত্ত্ব অচল! এই দেশে কোন কিছুর দাম একবার বাড়লে তা আর কখনোই কমে না। তবে মাঝে-মধ্যে কোন কোন পণ্যের আকাশছোঁয়া মূল্য মাঝে মাঝে মাটির কাছাকাছি নেমে আসে। কিন্তু এই অজুহাতে (বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য মূল্য বৃদ্ধিকে এই আলোচনায় অনুল্লেখ্য রেখে) রিকশাভাড়া একবার বাড়লে তা যে আর কমে না তা আমরা যেন ইতিমধ্যে সহ্যও করে নিয়েছি।
আবার আরেকটি যে সমস্যা ইদানিংকালে প্রকোটভাবে লক্ষ্য করছি তা হলো, রিকশায়ালারা ভাড়া চাইবার আগে যাত্রীর পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তার স্টান্ডার্ড বোঝার চেষ্টা করে। খুব ফিটফাট হলে তার কাছ থেকে নায্য ভাড়ার ৩-৪ গুণ ভাড়া অবশ্যই চাইবে। আর যদি যাত্রীকে দেখে স্টুডেন্ট বা কম স্টান্ডার্ডের (!) বলে তার কাছে মনে হয় তবে রিকশা ভাড়া ১.৫ থেকে ২ গুণ চাইবে। তখন গোপাল ভাঁড়ের গল্পটার কথা খুব বেশি মনে পড়ে।
আর সঙ্গে যদি একজন মেয়ে থাকে তবে তো আর কথাই নেই। মেয়েটির সঙ্গে যাত্রীর সম্পর্ক কি সেটি তখন মুখ্য নয়, বরং পুরুষ যাত্রীর সঙ্গে একজন মেয়ে আছে এটিই তখন রিকশায়ালাদের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। কারণ তারা তখন এতে বেশি অনায্য ভাড়া চাইবে যে তখন নিজের কাছে নিজেই কনফিউজ হয়ে যাই যে, আমি কি কোন সিএনজি বা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করছি নাকি?
১১ অক্টোবর
রাত ১২-২০ মিনিট
মোহাম্মদপুর, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১২:৫৪