ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার, ছুটি বাতিল করা হয়েছে উপকূলীয় জেলাগুলোর সরকারি কর্মকর্তাদের।
Published : 13 May 2013, 04:22 PM
তবে এখনো উপকূলীয় লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
তারা বলেছেন, ‘মহাসেন’ বাংলাদেশে আঘাত করবে কি না, তা মঙ্গলবার নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সোমবার বিকালে সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচি বাস্তবায়ন বোর্ডের এক সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মেছবাহ-উল আলম সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে লোকজনকে সতর্ক করা হয়েছে।
সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় এলাকার ৩৫ উপজেলার ৩২২টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার সেচ্ছাসেবককেও তৈরি রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সচিব বলেন, সোমবার থেকে প্রত্যেক জেলা-উপেজেলায় সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা রাখা হবে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন অধিদপ্তর এবং বিভাগেও আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হবে।
এসব নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া হালনাগাদ তথ্য মোতাবেক মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
সচিব জানান, দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি হিসাবে ইতোমধ্যেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া রেডক্রিসেন্ট ও রেডক্রসসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোও প্রস্তুত করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের সরিয়ে আনা হবে। তবে এখনো সে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
তবে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে বলে সভায় আবহাওয়াবিদরা জানান।
ত্রান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শুকনো খাবার ও খাবার পানি প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান সচিব।
তিনি বলেন, দুর্যোগপরবর্তী পরিস্থিতির পরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠানো হবে। এছাড়া একাধিক মেডিকেল টিম গঠন করতেও সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টি পর্যবেক্ষণসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে মঙ্গলবার বিকালে সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করা হয়েছে বলেও জানান সচিব।
সভায় আবহাওয়া অধিদপ্তর, রেডক্রিসেন্ট, রেডক্রস সোসাইটি ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা, সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার জেলাসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনগুলোও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে।
কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরিশাল, বরগুনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এসব জেলার প্রশাসন সভা করে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে।
বিভিন্ন স্থান থেকে বিডিনিউজ টোয়োন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
চট্টগ্রাম: ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গঠিত সমন্বিত প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এস এম আবদুল কাদের বলেন, সোমবার থেকে জেলা প্রশাসনসহ সকল উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সতর্কতা সঙ্কেত আরো বাড়লে উপকূলীয় এলাকার লোকজনদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হবে।
এছাড়া বিভিন্ন উপজেলার ৫২০টি সাইক্লোন সেন্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং ২৮৩টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, বাঁশখালী ও আনোয়ারার দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকেও লোকজনকে সরিয়ে নিতে প্রস্তুত রয়েছে প্রশাসন।
এর বাইরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে খোলা হয়েছে পৃথক নিয়ন্ত্রণ কক্ষও।
করপোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীর দামপাড়ায় খোলা হয়েছে পৃথক নিয়ন্ত্রণ কক্ষও। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দুটি নম্বর হলো- ০৩১-৬৩০৭৩৯ ও ০৩১-৬৩৩৬৪৯।
সোমবার সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সার্বিক বিষয় নিয়ে মেয়র এম মনজুর আলমের সভাপতিত্বে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় জানানো হয়, মহাবিপদ সংকেত পাবার পর নগরীর উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজনকে সরিয়ে নিতে করপোরেশনের ৫০টি গাড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় ওয়ার্ডের ১৫টি বিদ্যালয়কে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবেও প্রস্তুত রাখা আছে।
এদিকে চার নম্বর স্থানীয় হুশিঁয়ারি সংকেতের পর চট্টগ্রাম বন্দরে দুই মাত্রার সতর্কতা (এলার্ট-২) জারি করা হয়েছে।
কক্সবাজার: উপকূলীয় লোকজনকে সরিয়ে রাখতে প্রায় ১১শ’ আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে।
সোমবার বিকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা দূযোর্গ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়।
সভায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা লিটন বড়ুয়া জানান, জেলার ৫৩৭টি আশ্রয় কেন্দ্র এবং ৫৩৪টি স্কুল আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তা সিরাজুল মোস্তফা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলাব্যাপী তিন পর্যায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে, চলমান এবং পরবর্তী পর্যায়ে সহায়তার জন্য প্রস্তত রয়েছে জেলার স্বেচ্ছাসেবকরা।
জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন জানান, রোববারের সভার পর কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় মাইকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ১১৩টি জরুরি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এছাড়া জেলায় একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষও খোলা হয়েছে।
নোয়াখালী: উপকুলীয় এলাকা হাতিয়া, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলায় ৪ শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ওই সব এলাকার জনগণকে দ্রুত সরিয়ে আনতে নৌযান প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রেডক্রিসেন্ট, এনজিওসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রধানদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রত্যেক ইউনিয়নে সেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছে বলে। দুর্গম এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা চলছে।
নিজেদের পর্যাপ্ত শুকনো খাবারের ব্যবস্থা ছাড়াও এলাকাবাসীকেও আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবারসহ আশ্রয় নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরার সব উপজেলা সদরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, শুকনো খাবার, পরিধেয় বস্ত্র, খাবার পানি, মোমবাতি, উদ্ধারকারী নৌযান ও ওষুধপত্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন এস জেড আতিক জানান, ৮৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া সব ধরনের নৌকা ও ট্রলারকে উপকুলের কাছাকাছি থাকার কথা বলা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
ভোলা: সকালে জেলা প্রশাসক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে প্রস্তুতি সভা হয়।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল ওয়াহেদ বলেন, সভায় জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে তার কার্যালয়ে জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে, যার ফোন নম্বর ০৪৯১-৬১৩৪৫।
এছাড়া জেলার সাতটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলা নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আবহাওয়া বিভাগ চার নম্বর সতর্কতা সংকেত ঘোষণা করলে জনগণকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি।
বরগুনা: দুপুরে জেলা প্রশাসক মো. আবদুল ওয়াহাব ভূইয়ার সভাপতিত্বে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে এক জরুরি সভা হয়।
জেলা দুর্যোগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান জানান, তাদের ৩৭২টি ইউনিটের ৫ হাজার ৫৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ শুরু করেছে।
তিনি বলেন, জেলায় ৩২৪টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০০ জনের সংকুলান হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ খবর জানতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি, দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা অফিস এবং লোকবেতারের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সভা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে, যাতে পাঁচ নম্বর সংকেত জারি করার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান ছাড়া যায়।
বরিশাল: জেলার সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সকল প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে জেলা দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ছুটি বাতিল করার বিষয়টি জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল আলম।
সেইসঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৪টি কমিটি গঠন করা হয়েছে সভায়।
জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সভা করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া সকল সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারিদের কর্মস্থলের কাছাকাছি থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলার ১০ উপজেলার চেয়ারম্যান ও নিবার্হী কর্মকর্তাদের সাবির্ক প্রস্তুতি নেওয়ার নিদের্শ দেয়া হয়েছে।
পযার্প্ত স্বেচ্ছাসেবক, মেডিকেল টিম, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার জন্য সব বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
ঝড়ের গতি বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনার জন্য উপজেলা, পুলিশ প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানে এবং সদস্যরা কাজ করবেন।