somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রবীণদের প্রাপ্য এবং আমাদের দায়।। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ভাবনা

০১ লা অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বার্ধক্য মানবজীবনের শেষ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। জীবনের এ পর্যায়ে একজন প্রবীণ নানামাত্রিক সমস্যায় পড়েন; যদিও খাতা-কলমে সমাজ-সংসারে তাদের অধিকার সুরক্ষিত। তবে অধিকারের প্রশ্নে নয় বরং তাদের জীবনের শেষভাগ সফল, সার্থক ও স্বাচ্ছন্দময় করা আমাদের নৈতিক দ্বায়িত্ব।

বিদেশে বয়স্করা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ‘প্রবীণ’ এবং গ্রামাঞ্চলে বুড়ো-বুড়িই তাদের বড় পরিচয়। এথানে সরকারি চাকরি অবসর গ্রহণের বয়স ৫৭ বছর হওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বৃদ্ধ হওয়ার আগেই প্রৌঢ় হিসেবে বিবেচিত হন। গ্রাম-বাংলায় কৃষিকাজ বা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাজ থেকে অবসর গ্রহণের কোন নির্দিষ্ট বয়স নেই। তাই তাদের পৌঢ়ত্ব নির্ধারণ বেশ কঠিন।

আদম শুমারী মতে, বাংলাদেশের বর্তমান ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা শতকরা প্রায় ৬ ভাগ; অথ্যাত বয়স্কের সংখ্যা আনুমানিক ৯০ লাখ। (ভারতে এই পরিসংখ্যান কত আমার জানা নেই) আধুনিক চিকিতসার সুবিধা, খাদ্যাভাস পরিবর্তন এবং সচেতনতার ফলে জনগণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। খাদ্য গ্রহণের ভারসাম্য ও আধুনিক স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের কারণে বয়স্কদের মৃত্যুহার একদিকে যেমন কমেছে অন্যদিকে গড়আয়ুও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের পুরুষদের গড়আয়ু প্রায় ৬০ বছর এবং নারীদের ৬৫ বছর। স্বাভাবিকভাবেই এখানে প্রবীণদের বেঁচে থাকার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সমস্যাও বেড়েছে। সময়ের সাথে নগরায়ন, শিল্পায়ন, চাকুরীগত ও অন্যান্য পরিবর্তিত পেক্ষাপটে বাঙালির ঐতিহ্যমণ্ডিত যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থার ফাটল আর পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তাদের দেখভালের জন্য একটি বড় সমস্যা। একান্নবর্তী পরিবার ব্যবস্থায় যে প্রবীণদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক; পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থার প্রভাবে এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সমাজ-সংসারে বয়স্করা অনেক ক্ষেতেই বোঝা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। তাই হতভাগ্য কোন কোন প্রবীণ ভিক্ষাবৃত্তি বা অন্যের করুণার পাত্র হয়ে বাকিজীবন অতিবাহিত করছেন।

নিজের সন্তানদের কাছেও হচ্ছেন অবাঞ্ছিত। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে বয়স্ককেন্দ্রে তাদের ম্লাণ মুখ; এ অবস্থায় তাদের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই দৃশ্য সর্বজনীন নয়। বাংলাদেশের সমাজ-সংসারে প্রবীণদের অবস্থান উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অপোকৃত সম্মানজনক। বিশেষত যৌথ পরিবারগুলোতে পারিবারিক পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আয়-ব্যয়ের হিসাব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজে প্রবীণদের ভূমিকা আজও গুরুত্ববহ। বৃহত্তর সমাজেও প্রবীণদের মতামতের গুরুত্ব কম নয়। সামাজিক প্রোপটে একজন প্রবীণকে ‘দাম্পত্য সম্পর্ক বা বিয়োগ’, ‘সন্তানের সাথে সম্পর্ক’, ‘নাতি-নাতনীর সাথে সম্পর্ক’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানিয়ে চলতে হয়। চাকরি কিংবা কাজ থেকে অবসর গ্রহণের সাথে সাথে দাম্পত্য সম্পর্কেও সুস্পষ্ট পরিবর্তন আসে। এ সময় গৃহকর্তা অধিকাংশ সময় বাড়িতে অবস্থান করায় পরিবারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ তার জন্য অবশ্যসম্ভাবী হয়ে ওঠে। স্ত্রী তার সংসারের একাধিপত্যে স্বামীর ভূমিকাকে কখনও খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করেন আবার কখনও করেন না; তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সুসম্পর্কের বিষয়টি নির্ভর করে অতীত বন্ধনের ওপর। যে বন্ধন তৈরী হয় মধ্যবয়স থেকেই। যখন সন্তানরা যার যার মতো দূরে সরে যেতে থাকে। তখন প্রবীণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পারিক নির্ভরশীলতা সুগভীর হয়। তারা প্রায় ক্ষেত্রে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণেও মনযোগি হন। তাই স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে একজনের মৃত্যু অপরজনের জীবনে বয়ে আনে শূন্যতা ও একাকীত্বের করুণ অধ্যায়।

সন্তানের সাথে সুসম্পর্কের স্থাপনে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশী আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। সন্তানকে লালন-পালন করার ফলে বন্ধনের বিশেষ ভাগটি তাদের জীবনে গভীরভাবে প্রভাবিত। বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এটি নিয়েও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র সন্তানের কারণে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় তা নয়; মানুষিক অস্থিরতার কারণে সন্তানের মতামতকে সন্দেহের চোখে দেখায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত এবং বিভিন্ন অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হয়। স্বভাবতই সন্তানরাও প্রবীণ বাবা-মায়ের অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে সম্মান না করে নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে। ফলে প্রজন্মের মাঝে সম্পর্কের ব্যবধান বেড়ে যায়। নাতি-নাতনীরা যখন ছোট থাকে তখন প্রবীণরা খেলাধুলা ও গল্প বলার বিষয়টি তাদের জীবনে প্রভাব সৃষ্টি করলেও তারা যখন কৈশোর বা যৌবনে পদার্পন করে তখন তাদের জীবনে দাদা-দাদীর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। এ সময় প্রবীণদের সহচার্য তাদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে এবং পুরাতন মূল্যবোধ ও ধ্যান ধারণার সাথে তাদের ধ্যান-ধারণার সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।

প্রবীণদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে সব ধরণের সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণেই প্রবীণরা পরিবারে ও সমাজে উপেক্ষা, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হন। তারা গণ্য হন অপ্রয়োজনীয় এবং পরিবার ও সমাজের বাড়তি বোঝা হিসাবে। আর্থ-সামাজিক অবস্থান অথ্যাত উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এই তিনটি অবস্থানে প্রবীণদের ভূমিকাও ভিন্ন ভিন্ন। উচ্চবিত্ত সমাজে প্রবীণদের সমস্যা তুলনামূলক কম। আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে তাদের মনোবল দৃঢ় থাকে। পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বরং তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়। তবে সন্তানরা নিজস্ব কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একাকীত্ব ও মানসিক নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত হওয়া প্রবীণের পে কঠিন হয়ে পড়ে।

গ্রামে বা শহরে স্বচ্ছল প্রবীণরা পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন, ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। মধ্যবিত্ত সমাজে অর্থনৈতিক অস্থিরতা তাদেরকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করে। আর্থিকভাবে সন্তানের মুখাপেক্ষি হয়ে নিজেদের ব্যস্ত থাকতে হয়। বাজার করা, নাতি-নাতনীকে স্কুলে আনা-নেয়া ও পড়ানো ইত্যাদি তাদের অন্যতম দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যবিত্ত প্রবীণরাও বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তবে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র প্রবীণরা যতদিন শারীরিক ক্ষমতা থাকে ততদিনই উপার্জনে নিয়োজিত থাকেন। কিছু প্রবীণ সম্পূর্ণরূপে সন্তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হন। সন্তানের অবহেলার কারণে কখনও কখনও অনেক বাবা-মাকে চিকিৎসাহীন মৃত্যুবরণ করতে হয়। অথচ তাদের কর্মময় জীবনের সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে নিজ পরিবার গঠন ও উন্নয়ন, সমাজ ও জাতির সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নতিতে।

বাবা-মার শেষ রক্তবিন্দু ঝরেছে সন্তানের মঙ্গল কামনায়। তাই প্রশ্নাতীতভাবে তাদের বার্ধক্যের দায়িত্ব গ্রহণ; তাদেরও প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ অতীত অভিজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বর্তমানকে অতিক্রম করা বেশ কঠিন। আর ভবিষ্যতের পথ- সে আরও দুস্তর।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরাধের সেকাল ও একাল

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

সেকাল
--------------------------------------------------------
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি বেভারিজ ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য৷বেভারিজ ১৮৭০ সালের মার্চ হতে ১৮৭১ সালের মার্চ এবং ১৮৭১ সালের জুন থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×