somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আত্মপ্রচারণা লেখাটি লিখেছেন দিলীপ দাস

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৪:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চিতার উপর মিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে মঠ
নিজেরে বিক্রি করি কানা পয়সার হাটে
পাশের গলিতে কারা যেন পানির দামে
ভাড়া দিচ্ছে শরীরের ওম
এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছিনা বহুকাল
যার কাছে নিজেকে সঁপে শুদ্ধ হবো।
(কানা পয়সার হাট)

এই কৌতুহল, এই হাহাকার, অতৃপ্তি এবং তা থেকে সঞ্জাত ঘৃণা আমাদের এই সময়ের কবি এহসানুল ইয়াছিন এর কবিতার মূল বিষয়। যদি এ কথা বলি, তাহলে তার কবিতার প্রতি সম্ভবত অমর্যাদা করা হবে না। সময়কে যদি একটু কাটাছেড়া করি, তাহলে কি আমরা দেখতে পাই না, পণ্যসভ্যতা কিভাবে আমাদের ঘর থেকে বাহির, অবিরলভাবে একাকার করে দিচ্ছে হাটের উদোমে? হয় বিক্রি হও , নয় বিক্রেতা হও। এর মাঝেই আমাদের সকল সম্পর্ক যেন অসহায় ভাবে দুলছে। কখনো আমরা নিজেরে বিক্রি করছি, কখনো ভাড়া দিচ্ছি ‘শরীরের ওম ’। আর এর মাঝেই আমাদের এই তরুণ কবি এবং তার প্রজন্ম দিশেহারা হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই শুদ্ধতা, সেই পবিত্র অনুভব, যার কাছে তিনি নিজেরে সঁপে দিয়ে পবিত্র হবেন ( যদিও পবিত্রতা শব্দটি আপেক্ষিক)। কিন্তু ভোগ সর্বস্বতায় যখন সবকিছু আচ্ছন্ন করে ফেলে, পণ্যায়ন প্রণোদিত বিশ্ব যখন সবকিছুরই মূল্যমান নির্ধারন করে মুনাফার লালিত লাবণ্যে, যখন সবচেয়ে পবিত্র, ভালোবাসার সম্পর্কও রক্তাত্ত হয়, কলুষিত হয়, ভালাবাসার নামে, প্রেম ধর্ষিত হয় প্রেমিকেরই হাতে, তখন ইয়াছিনের শুদ্ধতার সন্ধান অলীক কুহকের মতো গড়াগড়ি খায়। তবু যে এই প্রজন্ম , এই সমূহ সর্বনাশের মধ্যেও, শুদ্ধতার অন্বেষণ করে, এ সম্ভবত সেই বোধ বিশ্বাস থেকে,‘ কোথাও মানুষ এখনো ভালো রয়ে গেছে’।

রয়েছেই তো। নয়লে ইয়াছিনের দুই ফর্মার কবিতাবইয়ের একটি মাত্র কবিতা নিয়ে এত কথা বলছি কেন? কারণ এই একটি কবিতাতেই ফুটে ওঠেছে এই সময়ের সবচেয়ে ঘৃণিত সমাজ-বিন্যাস, এই বিন্যাসের প্রতি তার বিবমিষা, এই অবিমৃশ্য এবং অপার উল্লাসী সময়ের কাছে থেকে মুক্তির আকুলতা।

ইয়াছিনের কবিতার বই ‘রাধিকা নগরীর দিকে হেটে যাচ্ছি’ পড়ে আমার অনুভব কি ওই একটি কবিতাতেই সীমাবদ্ধ? মোটেই তা নয়। বরং এই কবি , ১৯৮২ সালে যার জন্ম, তার অনেক অনুভব, অনেক ঝাঁকুনিপ্রবণ শব্দ ব্যবহার আমাকে থমকে দিয়েছে। ভেবেছি, মাত্র ২৮ বছর বয়সেই যদি কারো পৃথিবীর এই ম্লানমুখ , এমন কলুষ কলঙ্কিত চেহেরা দেখা হয়ে যায়, তাহলে তার কাছে তো আমরা আগামীদিনে আরো অনেক কিছুই আশা করতে পারি। অনেক প্রবীণ কবির কাছেও আমি এমন আশা করি না, কারণ কী এক অদ্ভুুত মোহে এবং যাদু কপটতায় তারা দিব্যভাবের বিলাস নৈবদ্যের মতো সাজিয়ে যান। চারদিকে যখন আগুন, ছাই, ধূলিভষ্ম, কী অদ্ভুত তন্ময়তায় তারা ভাবকীর্তনে মশগুল হয়ে থাকেন এবং এই প্রাচীন জড়বাদ এবং স্থবির উপাখ্যানের প্রশংসায় তাদের সহযাত্রী কেউ কেউ আবার মুখর হন। মুখর হন হয়তো এই ভাবনায়, তারা যা জানেন, তা দিয়েই পৃথিবীর পরম সত্যের প্রাপ্তি ঘটবে। কিন্তু এ যে শুধুই মোহ, ভ্রান্তি, এক ধরনের অবিমৃশ্যকারিতা ও আত্মউদাসীনতা, এ তাদের পরিতৃপ্ত আত্মঅহমিকাকে কে বোঝাবে!

পণ্যসভ্যতার বড় অবদান নগর। সে গ্রামকে চুষে খায়, তাকে ফতুর করে, এবং নিজের রক্তশূন্য মুখের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। যারা কবি, ভাবুক, শিল্পী, বেশ্যা, ব্যবহারজীবী, দুর্বৃত্ত, খুনি, শখের রাজনীতিক, ভ- সুযোগ সন্ধানী, তারা সবাই এই উজ্জ্বলতার দিকে ধেয়ে যায়। কারণ ওখানেই তার পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয়, মুনাফার বাড়তি চাকচিক্যে। ওইখানেই খ্যাতির মাশুলগুণে ‘ বেশ্যা পাড়া থেকে খবর পাড়ার’ কাগজ। এই নগরীরই এক টুকরো ছবি তুলে এনেছেন ইয়াছিন, কী অদ্ভুত মুন্সিয়ানায়, কী সুন্দর কারুকর্মে।
ও নগরে আলো জ্বললে অপেক্ষা কেবল নতজানু হয়ে
বিকেলের দীর্ঘ ছায়ার মতো ঝুলে পড়ে
অথচ অন্ধকারের ক্ষত বৃষ্টিতে কতজন ধর্ষিতা হলো তা কি কেউ জানে?
তারপর রাত্রিগুলো ছোট হয়ে আসে সুশীলের জন্য
বাড়ে বেশ্যার পবিত্র দীর্ঘশ্বাস

হায় নগর ! হায় আলো!
মানুষ কি জানে না অন্ধত্ব বেশি কার?

কবিতাটির নামও বড় অর্থবোধময়। ‘আলো অন্ধকার কিংবা আমাদের গল্প’। সত্যিই তো। এ তো আমাদেরই গল্প। আমরা যারা আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্বে প্রত্যহ দ্বিধানিত্ব, কণ্টাকিত, ক্ষতবিক্ষত, এ তো তাদেরই গল্প!
যদিও তা বড় অনুতাপময়, তবু তার এ ভাবনার সঙ্গে আমি সহমত, ‘অন্ধকার কখনো পাপ করে না।’ অন্ধকারের উৎস যে আলো উৎসারিত, সকল পাপ ওখানেই জন্ম নেয়। অন্ধকারে ভ-ের মুখ এবং মুখোশ কেউ দেখতে পায় না। ফলে তার কদরও বাড়ে না। তার চাই আলো, অফুরন্ত আলো, নাগরিক মেধা, পণ্যায়ন অভ্যস্থ সুচতুর লীলাকাপট্য, যা নয় সে তা দেখাবার জোরালো প্রয়াস এবং একখানি জমকালো ‘বুদ্ধিবিক্রির হাট’। এ হল তাদের সফলতার সীমান্তরেখা। ওই হাটে, সে জানে নগ্ন হলেও বাহবা পাবে,‘ওখানে শরীরি উপস্থিতি মানেই কথা’ (অন্ধকার এবং বুদ্ধিজীবী)। এই রকম হাটেই কবি পাপ কিনতে যাবেন।
গাছের মতো হাটগুলোর শেকড় গজাচ্ছে
অন্ধকারে হাট। আলোতে হাট
সবহাট ঘুরে দেখবো। যদি পণ্যের দেখা পাই
কিনেও নিতে পারি। আজ হাটবার
আগুন দামে হাট থেকে পাপ কিনতে যাবো।
(আজ হাটবার)
এই বাজার সভ্যতার এমনি অনেক নগ্ন চিত্র ইয়াছিনের রাধিকা নগরীতে ছড়িয়ে আছে। নির্মোহ ভঙিতে , নীরব রক্তপাতে তিনি লিখে যেতে পারেন এই অনুভব ঋদ্ধ পঙত্তিমালাও-
আমাদের চারপাশে কসাইখানা
এখান থেকে প্রতিনিয়ত আ্যম্বুল্যান্সগুলো
বেদনার গান ধরে ছুটে যাচ্ছে
রাধিকা নগরীর দিকে।
ইয়াছিনের আরও কিছু উজ্জ্বল ভাবনায় এবং বুননে প্রশংসাযোগ্য পঙক্তি ছড়িয়ে আছে তার অনেক কবিতার আনাচে কানাচে। সেগুলো না উদ্ধার করলে জানা যাবে না দুয়েক কথায় কি অদ্ভুত চমক ইয়াছিন গুঁজে দিতে পারেন তার কবিতার শরীরে।
ক.
প্রেসে একফর্মা অভিজ্ঞতা ছাপা হচ্ছে
আমি তখন আজ্রাইলের সঙ্গে
জীবন নিয়ে তর্ক করছি।
(বোধের ভেতর)
খ.
মুড়িভাজার বালুতে পুড়ে যাচ্ছে সবকিছু
তুমি বরং আগুনের নামে নগ্ন হও
(অন্ধকার এবং বুদ্ধিজীবী)
গ.
আত্মহত্যার মুহূর্তে অন্ধের হাত ধরে হাঁটা ভালো
(আত্মহত্যার মুহূর্তে)
ঘ.তুমি হিমঘরে জমানো আকালের সবজি হলে
নিজেকে সিদ্ধ করে নিতে পারবে।
(ফিরে যাচ্ছি)
ঙ.
ঘরের ভেতর ঘর
ঘরের ভেতর মানুষ
ঘরের ভেতর আত্মরক্ষা
ঘরের ভেতর আত্মহত্যা
(ঘর)

‘রাধিকা নগরীর দিকে হেঁটে যাচ্ছি’র কোনো কোনো কবিতা , কোনো পঙক্তি হয়তো একদিন দীর্ঘজীবী উচ্চারণের আবাদ পাবে। সেটা অবশ্যই সময়ের ইচ্ছাধীন। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, সামনে অনেক পথ বাকি। ইয়াছিনের যেন ঘরে ফেরা তাগাদা না থাকে। আর যে বোধের জগতে ইয়াছিনের হাটাহাটি- সেখানে অনেক গলিগুজি, অনেক আঁকবাঁকা। সেখান থেকে তাকে বিচ্যুত করার জন্য অনেক আলোকিত অন্ধকার, অনেক সুসজ্জিত মিথ্যে। এই নৃশংস মধ্যাহেৃ হাহাকার ও বিলাপে, বিষাদে ও আত্মমগ্ন বিলাসে এবং রঙিন ভাবেচ্ছ্বাসে, নৈর্বত্তিক আলাপনে, প্রকৃত সত্যের সন্ধান নেই। প্রকৃত সত্য তো অফুরন্ত অন্বেষণে। সেখানে আরো দুটো শব্দকে সঙ্গী করতে হয়। এর একটির নাম ক্রোধ, অন্যটির নাম প্রতিবাদ। যেহেতু প্রতিবাদই কবিতার প্রধান ধর্ম, শ্রেষ্ঠতম আয়ুধ, সুতরাং তার কাছে নতজানু হলে ভীরুতা নেই, পাপও হয় না। স্থবিরতার উদযাপনকারীদের কাছ থেকে সাময়িক অপবাদ জোটে শুধু।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৫৩
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×