somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঝরা নক্ষত্র

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে কিছুতেই আমার প্রত্যাশিত মানুষটির সাথে মেলাতে পারছিলাম না। বিকেল নেমেছে কি নামেনি এ প্রহরে তার-চোখে মুখে ব্যস্ততার ইঙ্গিত। টানা আড়াই বছরের মুখস্থ মুখটি তো এ খানিক অচর্চায় ভুলে যেতে পারি না। কিংবা বন্ধুত্বের কি বিস্তৃতি আছে। আবার আমার প্রাপ্য তথ্যটাও ভুল হতে পারে।
শেষ অগ্রহায়ণের অসহ্য উত্তুরে বাতাস। হাত পা চড়চড় করে। বিকেলে রোদের তেজ কমে এলে শীত জেঁকে বসতে থাকে এসব সবুজ গ্রামে। দিন ফুরোবার আগে আমাকে ফিরতে হবে বন-জঙ্গল, ধুধু ক্ষেত, খাল পেরিয়ে নিজামপুর। প্রায় পাঁচ মাইলের পথ। নাহ! চলেই যাই। তার আগেই ও শান্ত প্রশ্ন- কাকে খুঁজছেন।
চমক লাগে আমার- এটা কি লাবণীদের বাড়ি? হ্যাঁ, আমিই লাবণী। আমি ভালো করে তাকাই। কণ্ঠটা হারায়নি। সত্যি ধুলো বিস্মৃতির নিচে আমি লাবণীকে আবিষ্কার করি। এ আমাদের লাবণী কষ্ট করে বিশ্বাস করি। বলি, লাবণী, আমি মাসুদ। দনিয়া কলেজ, অনার্স, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ মনে আছে। আচমকা আবেগের তোড়ে যেন বেসামাল লাবণী। বিহ্বলতার মুখে যেন কথা সরে না। শুধু আবেগ ধরা কন্ঠে বলে, মাসুদ তুমি এখানে কিভাবে। আমাকে মনে রেখেছ! আর কিছু বলতে পারে না। আমি ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে বোধহয় অশান্ত বুকে জড়িয়ে ধরে স্থিরতা খুঁজতো। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে তার। কয়েকবার ভিজে ওঠা দু’চোখ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই শুকিয়ে যায়।
লাবণী আমাকে ঘরে নিয়ে বসায়। বসিয়ে গ্রাম্য রীতি অনুযায়ী চা, সেমাই, শরবত পরিবেশন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথার স্রোত। চারপাশে তাকাই। বেশ সামর্থ্যবান গেরস্থ। বড় ঘর, দামি পালঙ্ক, সুদৃশ্য চেয়ার-টেবিল, বড় আলমারি। ঘরের কোথাও নিশ্চয়ই গোলাভরা ধানও রাখা আছে।
লাবণী ট্রে ভর্তি শরবত সেমাই এনে রাখে। সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে বলে, বলেন ক্যামনে আসলেন। আমি অবাক লাবণী আমাকে ‘আপনি’ করে বলছে। অস্বস্তি লাগে। বলি একি লাবণী এত দূরে ঠেলে দিলে। না, কতদিন পর তো- ভারী লজ্জা পাই। তারপর বলে, জানো কাউকে দেখিনা। কতদূরে পড়ে আছি।
আমি লাবণীর দিকে তাকাই। হ্যাঁ, সে অনেক দূরে পড়ে আছে, আমাদের কল্পনা ছাড়িয়ে। এই লাবণী একদিন চমৎকার গাইতো। কাসে ও যখন গাইতো সুরের মাদকতায় বুঁদ হয়ে থাকতো সবাই। আমি মেয়েদের সাথে মিশতাম না, আসলে মিশতে পারতাম না। তাই কাসের জানালায় উদাসী দৃষ্টি মেলে ওর গান শুনতাম। যেন ওদের কিছুতে আমি নেই। ছাত্রীও ছিলো ভালো। যেখানে আমি খেটেখুটে থার্ডকাস সে অনায়াসে সেকেন্ড কাস। প্রথম বর্ষ এমনই গেছে। তারপর দ্বিতীয় বর্ষ। আমি একটু একটু গল্প, কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। সে কিভাবে জেনে যায়। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তার ভীষণ আগ্রহ। একটু একটু করে আমরা কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করি। এক সময় বেশ ভালো বন্ধু হয়ে যাই।
একদিন লাবণী দেশময় গাইবে, সে স্বপ্নের কথা আমাকে বলে। বলে নানা স্বপ্ন ভঙ্গের কথাও। তৃতীয় বর্ষে গিয়ে লাবণীর আর দেখা নেই। বন্ধুতার মাঝেও আমার দিক থেকে নিষ্ঠুর একটা দূরত্ব ছিলো। লাবণীকে না দেখার পর থেকে তা আরো তীব্র হয়। এক সময় আমি তাকে অনেকটা ভুলেই যাই।
আমার এক মামার শ্বশুড়বাড়ি নিজামপুর। বছর দু’আগে ওই বাড়ি বেরিয়ে যখন ঢাকায় যাই তখন পুরনো এক বন্ধুর সাথে দেখা। কথায় কথায় ওই জায়গার নাম উঠলে ও বললো, লাবণী, ওই যে তোর বেশ খাতির ছিলো, ভালো গাইতো ওর বিয়ে হয়েছে নিজামপুর থেকে খানিক দূরে রঙ্গশ্রী গ্রামে। পরে ওর কাছ থেকে বিস্তারিত ঠিকানা নিলাম। আমি নানা বাড়ি খুব বেড়াই। প্রতি ঈদেই যাই। তাই এবার নিজামপুর এসে এদিকটায় একটু চক্কর দিতে চাইলাম।
সামনে বসে আছে লাবণী। মাথার ঘোমটা নড়ে না। কত কথা বলে সে। মনে হয় লাবণী কথা না বলার অতৃপ্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করে, স্যারদের সাথে দেখা হয় কিনা। সুজিত, ফারুক, নয়ন ওরা কোথায়? মুন্নি, স্নিগ্ধা, মিলি কেমন আছে? ওর কোন কোন কথা আমি শুনতেই পাই না। মেঘ ভাসা মুখ পানে চেয়ে মনে হয়, ওর কত দুঃখ, কত কান্তি, কত শ্রম। লাবণী বেশ সুন্দরীও ছিলো। প্রায়ই সেজে কলেজে আসতো। ঠিক ওভাবে না। হালকা লিপস্টিক, ছোট্ট টিপ, পরিপাটি বাধা চুল। তাতেই অসাধারণ। খানিক সময়ে সেই লাবণী ঝলমলে দিনের শেষে স্থির বিকেল হয়ে আছে।
লাবণীর শোনা না শোনা কথার মাঝে আমার ভাবনার রেশ ধরে প্রশ্ন করি- অনার্সটা শেষ করলে না কেন? লাবণী তার কথার বাঁক পেরিয়ে খানিক সময় নিয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে আসে- তুমি তো জানো আমাদের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। এসএসসি পরীক্ষার পরপরই বাবা-মায়ের পাত্রস্থ করার দুশ্চিন্তা শুরু। কিভাবে যে হচ্ছিলো না। আমি অনেক দুশ্চিন্তা, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা পেরিয়ে ওতদূর গিয়েছিলাম। তারপর এদের সাথে মিলে গেল। ছেলের বিশাল ব্যবসা। চালের আড়ৎ, মাছের ঘের কত কি? আমার বড় ইচ্ছে ছিলো অনার্সটা শেষ করি। কিন্তু বাবা-মায়ের দুঃস্বপ্নের রাত শেষে প্রভাতের পূর্বাভাস। না করি কিভাবে? না করলেও সন্দেহের আঙ্গুল উঠবে। শান্তি থাকবে না। তবু ভালো বিদেশি পক্ষের হাতে পড়িনি। তবে তো সবকিছুর সাথে প্রিয় দেশটাও হারাতাম। এখানে তাও মাথার উপর পরিচিত আকাশটা আছে। ধানের গন্ধ আছে। লোকটাও খারাপ না। তবে একটু কম শিক্ষিত। ব্যবসা বোঝে ভালো। তাছাড়া পরিবারও বেশি বড় না। শাশুড়ি, এক ননদ আমার ছোট মেয়ে শিখা লোক বলতে এই। শ্বশুর অনেক আগে মারা গেছেন। তবে বিষয়-সম্পত্তির অনেক দিক। কয়েক কানি জমির ধান, হাঁস-মুরগি। শাশুড়ি চলতে পারেন না, তার দেখাশোনা। সব দেখতে হয়। লাবনী থামে।
তার কথায় কোন অতৃপ্তি বা না পাওয়া বিষাদের রেশ নেই। কিন্তু তার এক ঝলক মুখ কান্তি নিঃস্বতার প্রচ্ছন্ন দলিল। তবু আমি ফের বলি, লাবণী এখনো কি গাও? লাবণী হঠাৎ হেসে ওঠে। কেমন তাচ্ছিল্য ভরা হাসি। অবাক চেয়ে থাকি আমি। এর পৃষ্ঠে আর প্রশ্ন ছোড়া যায় না। তাই বলি, লাবণী আজ উঠি। নিজামপুর পথ কম না। ফিরতে হয়তো রাত হয়ে যাবে।
এখন লাবণীর মুখে খানিক আগের হাসির লেশ মাত্র নেই। সে বলে, আজ থাকতে হবে। শিখার আব্বুর সাথে দেখা করবে। বলি, না যেতেই হবে। লাবণী ছোট্ট করে হেসে বলে, আগের মতোই আছো। ছোট্ট নীলার গাল ছুঁয়ে আদর করে পা বাড়াই আমি। লাবণীও পিছু পিছু নামে। লাবণী উঠোনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি আর পেছনে তাকাই না। এ মুখটি থেকে কি আমি পালাতে চাই! পেছনে ফিরলেই যেন দেখতে পাবো বুক কেমন করা দুঃখী একটা মুখ। একটা নক্ষত্রের ঝরে পড়া। সন্ধ্যার বিশেষ বাকি নেই। আমি বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যাই।
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×