(মৃত্যুবরন করার সময় আমাদের মনে বড় বেদনা জাগে যে আমাদের প্রিয়জনকে অনেক অপ্রিয় কথা বলেছি।আমরা যদি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারতাম তা হলে আমরা সেটা স্মরনে এনে নিজেদের অনেক বেশি সংযত করতে পারতাম।বেঁচে থাকার মধ্যে যে প্রবল আনন্দ রয়েছে সেটাকে রক্ষা করতে হবে।)
একবার তিনজন রাশিয়ান সৈনিক নাজিদের হাতে ধরা পড়ল।তাদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হচ্ছে।যে কমান্ডার গুলি করার নির্দেশ দিবেন,তিনি হঠাৎ বরফে পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।রাশিয়ান সৈন্য তিনজন হো হো করে হাসতে লাগল।তাদের মৃত্যু হলো হাসতে হাসতে।
সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো,হিটলারের বর্বব আচরন থেকে নবজাত শিশুর মায়েরাও রক্ষা পায়নি।১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে 'হানস' আর 'হিলডে' দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়।এরা দুজনেই ছিল হিটলারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।কারাগারে হিলডে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়।এ ঘটনার ৮ মাস পর হিলডেকে ঝোলানো হয় ফাঁসি কাষ্ঠে।মৃত্যুর কিছু আগে হিলডে তার জননীকে লেখে একটি মর্মস্পশী চিঠি।
*'মামনি,
এখন সময় হয়েছে একে অন্যের কাছ থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নেয়ার।আমার পুত্রসন্তান তোমার কাছে রক্ষনাবেক্ষন পাবে।প্রতিজ্ঞা করো তুমি সাহসে বুক বাঁধবে।তুমি নিজেকে শক্ত করে নিজের হাত চেপে ধরো খুব শক্ত করে।ঠিক তুমি তা পারবে।তুমি তো কঠিনতম বাধা-বিঘ্নের সামনে সব সময় জয়ী হয়েছ।তোমাকে নির্মম কষ্ট দিতে যাচ্ছি আমি।তুমি তো জানো না,আমার বয়স যখন কম ছিল,ঘুম আসত না অনেক রাতে,তখন যে চিন্তা আমার মনকে সজীব করে তুলতো তা হলো,আমি যেন তোমার আগে ওপারে যেতে পারি।পরবর্তী সময়ে আমার একটি আকাঙ্ক্ষা ছিল।এ সংসারে একটি সন্তান না এনে কিছুতেই মারা যাব না আমি।আমার এ দু'টি কামনাই এখন সফলতা পেয়েছে।আমার রেখে যাওয়া সন্তানকে তুমি বুকে চেপে ধরবে।আমার বাচ্চাটা সারা জীবন তোমাকে সঙ্গ দিবে সুখে,দুঃখে,আনন্দে।আমার চেয়েও বেশী।
আমার আশা,আমার এ পুত্রটি যেন সবল হয়।খোলা মনের অধিকারী হয়।
-হিলডে।*
কোনো কারন ছাড়াই হঠাৎ,সুবোধ ঘোষের বিখ্যাত প্রাগৈতিহাসিক গল্পটির কথা খুব মনে পড়ছে।যেখানে মাটি খুঁড়ে মুখার্জি অতীত মানুষের হাড় বের করে আনছে।মুখার্জি শুধু সাদা হাড় দেখছে।সে সময়ের হাড়ে লেগে থাকা রক্তের কোনো সন্ধান পাচ্ছে না।এখানে আর একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন- "গোবিনের উগ্র মতবাদ ফ্যাসিবাদী চেতনাকে উসকে দিয়েছিল।গোবিনের মতে, সব জাতিরই বিশেষত্ব রয়েছে।তবে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জাতি হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ।আবার শ্বেতাঙ্গদের মাঝে সেরা হলো জার্মানরা।জার্মানদের রক্ত খাঁটি।তাতে নেই কোনো ভেজাল।আর্য রক্ত।এর বিশুদ্ধতা যে কোনো মুল্যে রক্ষা করতে হবে।এ ধরনের চিন্তা ধীরে ধীরে জন্ম দিল ফ্যাসিবাদকে।
হিটলারের ব্যক্তিগত জীবন ছিল রহস্যের কুয়াশায় ঢাকা।তিনি পছন্দ করতেন না তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেউ আলোচনা করুক। হিটলার তার আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রাখতেন না।তার এক সৎ বোন ছিল।দেখতে খুব সুন্দরী।হিটলার ছিলেন নিরামিষী।তার জীবনে রহস্যময়ী নারী ছিলেন ইভা ব্রাউন(অসাধারন সুন্দরী মহিলা)।(১৯৩২ সালে ইভা ব্রাউনের সাথে হিটলারের প্রথম পরিচয়।)ইভাকে নিয়ে অনেকের'ই কৌতুহল ছিল।কেউ কেউ মনে করতেন ইভা ছিলেন হিটলারের রক্ষিতা।কেউ মনে করতেন স্ত্রী,আবার কেউ মনে করতেন তারা লিভ টুগেদার করতেন।স্বভাবে ইভা ছিলেন সরলা প্রকৃতির।ছলাকলায় পারদর্শী নয়। ইভাকে হিটলার হীরা বসানো একটি ছোট ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন।তারা মিউনিখের আশে পাশে লেকে,পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রেম করতে যেতেন।
হিটলার প্রথম জীবনে ভালোবেসেছিলেন 'গেলি রাউবাল' নামের এক কিশোরীকে।গেলি সম্পর্কে ছিল হিটলারের দূর সম্পর্কে ভাগ্নি।কোনো এক রহস্যময় কারনে গেলি আত্মহত্যা করে।(গেলি হিটলারের প্যাকেটে ইভা ব্রাউনকে লেখা প্রেমপত্র আবিষ্কার করেছিল।)
ইভা তার একাধিক বান্ধবীকে বলেছেন,আমার জীবনের সবচেয়ে নির্মম দিন হচ্ছে যেদিন হিটলার চ্যান্সেলর হলেন।হিটলার অতিশয় ব্যস্ত বার্লিনে আর ইভাকে থাকতে হয় মিউনিখে।প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা অস্থিরচিত্ত হিটলার তার এই প্রণয়িনীর সাথে ট্রাঙ্ককলে কথা বলতেন।
হিটলার বাহিনীর হাতে রাশিয়ান আর্মির আর্টিলারীর এক ব্রিগেডিয়ার ধরা পড়লেন।তাকে বলা হলো কুকুরের মতো জিভ বের করে রাখতে।যেই মুহূর্তে জিভ মুখের ভেতর ডুকবে সেই মুহূর্তেই তাকে গুলি করা হবে।ব্রিগেডিয়ার জিভ বের করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
বন্দিদের হত্যা করার আগে তাদের দিয়েই তাদের কবর খোঁড়ানো হতো।একটি কবিতার লাইন মনে পড়ল- "যারা মৃত,তারা আমাদের মধ্যেই বেঁচে আছে।/তারা বড়ো হচ্ছে আরো,আমাদের ভেতর।/আমার যুবক আর উচ্ছল কমরেডরা,যারা মৃত,/বেঁচে আছে আমাদের মধ্যেই।/ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলবে।"
হিটলারের ধারনা ছিল,মানুষ যে স্তরে রয়েছে ইহুদিরা রয়েছে তার নিচের স্তরে।ইহুদি কয়েদিদের কাছ থেকে প্লাটিনাম সোনা বা অন্যান্য যে কোনো রকম মূল্যবান অলংকার ছিনিয়ে নেওয়া হতো।মৃত দেহের মুখ হাঁ করে পরীক্ষা করা হত-সেখানে কোনো বহুমূল্য অলংকার আছে কিনা।
হিটলারের জীবনের শেষ দিনকে নিয়ে লেখা হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ।হিটলারের শেষ দশ দিন ছিল এতটাই বিচিত্র যা কোনো থিলার উপন্যাসের কল্প কাহিনীকেও রীতিমতো হার মানিয়ে দেয় ।
যুদ্ধের আগে জার্মানীতে ছিল ৫,৫০,০০০ ইহুদি।যুদ্ধের পর রইল ৩০,০০০।পোল্যান্ডে যুদ্ধের আগে ছিল ৩৩ লাখ ইহুদি।যুদ্ধের পর ৩০ হাজার।ইহুদিরা কখন'ই অন্য দেশে যেতে চাইত না।বলত,জার্মানি আমার পিতৃভূমি।এদেশ ছেড়ে আমরা যাবো কেন?জার্মানির শর্তহীন আত্মসমপর্ন এবং হিটলারের আত্মহত্যার ভেতর দিয়ে ১৯৪৫- এর মে মাসে বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
তথ্যসুত্রঃ
যুদ্ধ ও জীবন
মানবতা বিরোধী
সাপ্তাহিক ২০০০
নাৎসি বাহিনী
এডলফ হিটলার
পৃথিবীর এক বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো অখন্ড
বিশ্ব অর্থনীতি