somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের ধর্মীয় কাহিনীগুলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারনে সৃষ্ট। এগুলো জানার পরও আমাদের সমাজের মৌলবাদিদের ধারনা ওই অবতারগণ ঈশ্বরের আর্শীবাদপুষ্ট।

অবতারদের আর্বিভাব সমাজের কিম্ভূতকিমার, জবরজঙ্গ পরিস্থিতিতে দিশেহারা দেশকে দিশা দিতে। এনমটাই ভাবতে আমরা অভ্যস্ত। সেই সঙ্গে এটিও জানা যায় যে, রামকৃষ্ণের ভাষ্যকার এবং প্রিয় শিষ্য, বিবেকানন্দ সনাতন হিন্দু ধর্মের পুনরূদ্ধার করে সারা পৃথিবীর কাছে বেদান্তকে তুলে ধরেন।

কিন্তু এছাড়াও কিছু সত্য আছে, বিকল্প সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ যার দ্বারা আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রামকৃষ্ণ- বিবেকানন্দ ধর্মমত আসলে পরাধীন ভারতে খ্রিস্টান প্রভূদের সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ছেঁচে হিন্দু বর্ণবাদের প্রচার এবং প্রতিষ্ঠা লাভের আন্দোলন।

উনবিংশ শতাদ্বীতে কলকাতায় বেড়ে-ওঠা শিল্পায়নে রোজগারের সুযোগ নিতে প্রধানতঃ বর্ণহিন্দুরাই এসেছিল; মুসলমানেরা চাষী হয়ে গ্রামের দৈন্যের মধ্যেই পড়ে ছিল। সেই সঙ্গে হিন্দু বাঙালঈর মধ্যে মাতৃপূজার আধিক্য দেখা গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের কালীসাধক এবং শ্যামা সঙ্গীতের রচয়িতা রামপ্রসাদ সেনের পর থেকেই শুরু করে কমলাকান্ত চক্রবর্তী, রামদুলাল নন্দী, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল প্রমুখ কবিরা কালীর আরাধনা এবং স্তব গানের মধ্য দিয়ে বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এই একই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে ব্যবসা করে হঠাৎ -সফল গ্রামের পূজা শহুরে এসে পড়ল, কারন ধন-দৌলত প্রদর্শনের প্রকৃত শাবাশী গেঁয়ো ভূতেরা নয়, শহুরে ভদ্রলোকেরাই দিতে পারে। তার উপর যদি লাটসাহেবকে প্রধান অতিথি করে আনা যেতো তাহলে একটি খেতাব জেতার পথ সুগম হয়ে যেত অনায়াসে। অষ্টাদশ শতকের শেষে বাঙালায় মাতৃপূজার রমরমা যে কতখানি ছিল তা বড়লাট ওয়েলসলির নির্দেশে কালীপূজার সময় দেবীর উদ্দেশ্যে নয়বার তোপধ্বনি করার নিয়ম থেকেই বোঝা যায়।

কিন্তু শহরে-আসা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে মাতৃপূজার প্রভাব বিশ্লেষ্ণণ করতে হলে যন্ত্র সভ্যতার অবদান লক্ষ্য করাটা অত্যন্ত গুরূত্বপূর্ণ। বাস্তুত্যাগী মধ্যবিত্ত শহরে শিক্ষালাভ করে রোজগারে সফল হলেও কলকাতায় সে একা এবং ভিটে-মাটি ছাড়া। মাটি হল তার ছেড়ে-আসা গ্রামের প্রতীক। এই মাটিই আবার মাতৃপূজার প্রতীক, কারণ সেটা হল মানুষের জন্মস্থান। যেহেতু মা এবং সন্তানের বন্ধন অবিচ্ছেদ্য তাই মানুষ যতই নগর সভ্যতায় একাকীত্ব বোধ করে এবং শিল্পায়নের যান্ত্রিকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে ততই সে মাতৃক্রোড়ের আকাঙ্ক্ষায় কাতর হয়। তখন সেই মানুষ পাশ্চাত্যের প্রভাবে যতই স্বাধীণচেতা, যুক্তিনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী হওয়ার শিক্ষা পাক না কেন ঙ্গরের নির্মম প্রতিযোগিতায় পরিশ্রান্ত এবং প্রতিনিয়ত বিদেশী মনিবের জুতোর ভয়ে ভীত হয়ে সে মাতৃক্রোড়ে ফিরতে চায়। কিন্তু মুস্কিল হল এই যে, মাতৃক্রোড়ে যদিও স্নেহ আছে, কিন্তু সেটি হলো অস্থায়ী ঠাঁই, কারণ সেখানে জীবিকার সংস্থান নেই। এই অচেনা শহরে তাই দরকার মাতৃমন্দিরের এবং সেই সঙ্গে মাতৃসাধকের।

সে-জন্যই গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের আর্বিভাব ঘটল কলকাতার শহরতলীতে। ১৮৫৩ সালে তিনি দাদার সাথে গ্রাম ছেড়ে দক্ষিণেশ্বরে এলেন মধ্যবিত্ত বর্ণহিন্দু শহুরে ভদ্রলোকদের ভগবান শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব হতে। যদিও উপরের আলোচনায় আগেই তৈরী হয়ে গিয়েছিল তবু তিনি যে মাতৃপূজাকে বহুগুণে প্রাণবন্ত করে তুলেছিলেন তাতে কনো সন্দেহ নেই।

গদাধরের সাধনা এবং দিব্যলাভের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় লীলাপ্রসঙ্গ বই থেকে। সেখান থেকে এটিও জানা যায় যে, সাধনাজনিত আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং দর্শনলাভের পর গদাধর আর গ্রামে ফিরলেন না। থেকে গেলেন কলকাতাতেই। এমনকি নিজের মা’কেও নিয়ে এলেন কলকাতায় এবং সেখানেই মাতা চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হয়। রামকৃষ্ণ গ্রামীনভাষার আদলে কথা বলতেন এবং পুঁথিগত বিদ্যায় অজ্ঞ বলে পরিচয় দিতেন। কিন্তু গ্রাম থেকে তার ভাগ্নে হৃদয় যখন আর্থিক অনটনে পড়ে তার পরমহংস মামার কাছে সাহায্যের আশায় এসেছিলেন তখন রামকৃষ্ণ মন্দিরের দ্বার থেকেই তাকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। এই ঘটন থেকে বোঝা যায় যে, রামকৃষ্ণ গ্রামের অজ্ঞ-মূর্খ, চাষা-ভূষো মানুষদের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে চাননি। তিনি শুধু শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত মানুষেরই সংসর্গ পছন্দ করেন। রামকৃষ্ণ মধ্যবিত্তদের ভগবান হওয়ার জন্য মধ্যবিত্তদের মতনই গ্রামীণ মূলকে অস্বীকার করলেন, কারণ গেঁয়ো ভূতেরা যথাযথ শাবাশী দিতে পারবে না।

আসলে কিন্তু রামকৃষ্ণকে মধ্যবিত্তের ভগবান করেছেন তাঁর জীবনীকারেরা। রামকৃষ্ণকে মধ্যবিত্তের ভগবান করে তুলেছেন রামকৃষ্ণ কথামৃত’র রচনাকার মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত এবং লীলাপ্রসঙ্গের রচয়িতা স্বামী সারদানন্দ।

(দেখুন: স্বামী সারদানন্দ, শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ
Edward Said, Orientalism
Natun Diganta. Vol 4, no-3, নৈবেদ্য চট্টোপাধ্যায় এর প্রবন্ধ 'পরাধীন ভারতে প্রাচ্যজাগতিক চর্চা এবং বর্ণহিন্দু বাঙালী মধ্যবিত্তের আদর্শ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ'
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭



অনেক দিন পর আমি আজ এই হোটেলে নাস্তা করেছি। খুব তৃপ্তি করে নাস্তা করেছি। এই হোটেল এর নাম বাংলা রেস্তেরা। ঠিকনা: ভবেরচর বাসস্ট্যান্ডম ভবেরচর, গজারিয়া, মন্সীগঞ্জ। দুইটি তুন্দুল রুটি আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×