somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: নামটা এখনো ঠিক হয়নি - ১

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বুড়ো লোকটা বসেছিল ট্রেনে। যাবে অনেকদুর। একলা। বসে বসে জানলায় দেখছে সারি সারি গাছ। আমার উল্টোদিকে। সাধারণত খুব মনযোগ দিয়ে কাউকে দেখিনা। লোকে বিরক্ত হয়। কিছুক্ষণ পর, লোকটা তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজেই বললো, আচ্ছা বলতে পারেন নগরকান্দি কয় স্টেশন পর?
আমিও এই ট্রেনে নতুন। তবে স্টেশনের নাম জেনে এসেছিলাম। ট্রেন সখীপুর ছেড়েছে, সুতরাং তিনটা স্টেশন পরেই নগরকান্দি। তাকে বললাম , "৩। তা আপনি কি নগরকান্দিতে যাবেন?"
-হ্যা, সেখানে পৈত্রিক ভিটে বাড়ি। বলেই লোকটার মুখে হাসি ফুটলো। প্রথম হাসি। লোকটা আমার কথা জানতে চাইলো না। সাধারণত সবাই পাল্টা প্রশ্ন করে।
শুলাটিয়া স্টেশনে ট্রেন থামলো। এখানে থামেনা। সম্ভবত: কেউ চেইন টেনেছে। আমি তখন মানুষ দেখছি। মানুষ আসছে। যাচ্ছে। মেঘ দেখছি।

খোলা আকাশ দেখতে আমার বেশ লাগে। মাঝে মাঝে ভুগোল ক্লাসে খুব বোর হতাম। স্কুলের জানালা দিয়ে একমাত্র আকাশ আর মেঘ নিয়ে নানান দৃশ্য কল্পণা করতাম। মাটিতে লম্বা লম্বা তার। সম্ভবত: তারগুলো সিগনালের কিছু একটা করে। ট্রেনের জানালা। নাক উঁচু করা সিগনালটা দারুণ লাগে। গোল বার্লির কৌটার মতো ভেতরে লালসবুজ আলো জ্বলছে। কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন। সিগনালের আলো রঙিন চশমার মতো।

বৈশাখী মেলা বসতো আমাদের রেলওয়ে মাঠে। সেই সাদা ডাঁটের রঙিন চশমা ছাড়া চলতো না। আর লাগতো বিড়ালের ছবি আঁকা বেলুন। আমি নিজেও ভেবেছিলাম বেলুন রং করবো। কারণ ছবি আঁকতে ভাললাগতো। ক্রেয়নে প্রকৃতির দৃশ্য আঁকতাম। লুকিয়েই রাখতাম সেগুলো। এক মামা ছবি দেখে বিস্মিত। সে জোর করে পাঠিয়েছিল ইউনিসেফের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায়। একদিন খবর পেয়ে অবাক হয়েছি। ওখান থেকে সম্মাননা পুরষ্কার দিয়েছে আর নগদ দুশো টাকা। সম্মাননাটা বুঝি নি। কিন্তু টাকাটা রাতের ঘুম হারাম করেছে। রাত জেগে থাকতাম। জেগে একবার ভেবেছি বই কিনবো - মার্ক টুয়েন আর জুলভার্ণ দুজনের পুরো সেট। আরেকবার ভেবেছি থাক ব্যাঙ্কে রাখি।

লোকটা তার কাল চশমাটা পরে নিয়েছে। জানলার কাচ নামিয়ে কাঠের বেঞ্চিতে মাথা দিয়ে ঘুম ঘুম। আমার মাথায় একটা হাস্যকার প্রশ্ন ঘুরছে। আমাকে লোকটা তুমি বলতে পারতো। এইচএসসি পাশ করা একটা ছেলেকে ছোকরাই মনে হয়। সবাই তুমিই বলে। কিন্তু লোকটা কেন বললো না? লোকটা যে শিক্ষিত এবং ভদ্র তাতে সন্দেহ নেই। পাশের বিল্ডিং বন্ধু বদরুল থাকে। তাদের মাঝবয়সী দারোয়ান তাকে ডেকেছিল, "শোন, তুমিই তো জহির, না? তোমার বন্ধু বদরুল বলেছে, এই বইটা দিতে"। কতবড় সাহস! দারোয়ান হয়ে বাড়িওয়ালার ছেলেকে বলে তুমি! কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলিনি।
লোকটা মনে হয় স্বপ্ন দেখে ফেলেছে। ধরফরিয়ে উঠে বসে তার পর চোখ স্থির করে কিছু একটা দেখে। ট্রেনে আজ ভীড় কম। বেশ খানিকটা দুরে বসে আছে একটা মহিলা। বেশ মোটাসোটা, তার স্বামী কিছুক্ষণ পর পর উঠে হাঁটা হাঁটি করছে। লোকটা মনে হয় খুব পান খায়। দাঁত টকটকে লাল। আর ঠোঁট বাকিয়ে কথা বলে।
একটা স্টেশন পরে গানের আওয়াজ পাই। বগীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসছে অন্ধ ফকির

এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া এতসুন্দর গড়াইয়াছে সাঁই।

দরাজ গলায় গান শুনে সবাই চুপ হয়ে গেছে। ট্রেনের ঝক ঝক শব্দে গানগুলো কেন বুকের ভেতর ঢুকে যায়?

দুনিয়াটা আসলেই এমন কেন? ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টের সামনে দেখা দৃশ্যটা মনে পড়ে । কর্তার পরনে দামি জামা, চোখে সানগ্লাস। মাত্র দুটো ব্যাগ। সেটা লোকটা নিজে নিতে পারতো। না নিয়ে দুটো ৬/৭ বছরের ছেলেকে দিয়ে টানাচ্ছে। লোকটার বাচ্চা সেই ছেলেটার সমবয়সী। নিজের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আর কুলি শিশুর টানতে কষ্ট হচ্ছে, লোকটার কেন এতটুকু মায়া হলো না?

আমি বুক পকেটে হাত দেই। সিকি আধুলি মিলিয়ে দুটাকা পাই। অন্ধ লোকটার হাতে সেগুলো তুলে দেই। চশমা পরা বুড়োটা আমাকে দেখে হালকা হাসে। তারপর প্রথম বারের মতো প্রশ্ন করে, আপনি, কোথায় যাবেন?

আমি দ্বিতীয়বার আপনি শুনে লজ্জাই পাই। লোকটা কি ২ টাকা দিতে দেখে কি এই প্রশ্নটা করলো? তা কেন হবে? আর লোকটা কম করে হলে ৭০ হবে। বলি, না না আমাকে তুমিই বলবেন। আমি তো অনেক ছোট। তারপর দম নিয়ে বলে ফেললাম, আমি শ্রীরামপুরে যাব। আপাতত রাতটা কোন হোটেলে কাটাবো। তারপর ফিরে যাবো দুদিন পর।
-মানে? লোকটা তুমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছ?

লোকটার প্রশ্ন শুনে ভাল লাগলো না। কিন্তু তাকে আন্তরিক মনে হওয়ায় গড় গড় করে বলে ফেলি, পালিয়ে আসিনি। তবে মিথ্যে বলেছি। এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব ঠিক ঠাক, আর উনি বললেন না উনি বাতিল করেছেন যাওয়া। বাসার সবাই জানে সেই ভাইয়ের বাড়িতেই উঠবো।
-মিথ্যে বলেছ মানে তুমি পালিয়েই এসেছ! না না না এতো ঠিক করো নি। রাস্তায় কিছু হলে? আর বাবা মায়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার মোটেও ঠিক না।

আমার লোকটাকে আর নিরীহ লাগছে না। তবে তার কথার যুক্তি আছে। আমি একটু ব্যাখ্যা করতে থাকি
-আসলে আমার বাসায় আমার কোন স্বাধীনতা নাই। মা সারাক্ষণ চোখে রাখে। আমি এইচএসসি পাশ করেছি। অথচ কোথাও একা যাওয়া মানা। সন্ধায় ফিরতে দেরী হলে কৈফিয়ত দিতে হয়, দুটাকা কোখায় খরচ করেছি। বলুন এগুলো কি বেশী নয়। যার বাড়িতে যাওয়ার কথা সে এভাবে শেষ মুহুর্তে না বললেও পারতো। এখন ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবো। লোকটা তার চশমা খুলে হাতে মুছতে মুছতে বলে,
-দ্যাখো আমিও একসময় খুব দুরন্ত ছিলাম। বাবা মাকে অসহ্য লাগে একটা বয়সে। কিন্তু বিশ্বাস করো এক সময় তুমিও এমন হবে। বাচ্চারা যেমন ছুরি পেলে দুর্ঘটনা করে, তোমরা বড় হলেও অনেক কিছু শিখতে বাকি। ভুল হলে বাবা মায়ের খারাপ লাগে। তোমাকে এভাবে অনিশ্চিত ছেড়ে দিতে আমার খারাপ লাগছে। তুমি আমার সঙ্গে চলো।
আমি প্রথমে ভাবি। লোকটাকে তো আমি চিনিনা। এভাবে যাব কেন? ছেলে ধরা কেউ যদি হয়? পরে আবার মনে হয়, ছেলে ধরারা এত ধাড়ি আমাকে নিয়ে কী করবে? আর তেমন হলে নিশ্চয়ই এত সুন্দর উপদেশ দিতো না। সাদা সিমেন্টের সাইনবোর্ডে লেখা নগরকান্দি স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ করে। বুড়ো লোকটা নেমে যাওয়ার আগে আবারও প্রশ্ন করে।

মনের ভিতর যুদ্ধ করে লোকটাকে কেমন যেন পছন্দ হয়। আর এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করি। বললাম চলুন।

--------------------
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৫৫
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×