somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আনন্দধামে মনসা

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৯:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[মনসা মঙ্গল নিয়ে সামান্য কিছু পড়া-শোনা হয়েছিল। কিন্তু এর পরিবেশনা চোখে না দেখলে মূল সুর বুঝা কঠিন। এরমধ্যে মনসার পুরাণ’ দেখার চমৎকার একখানা সুযোগ পেয়ে গেলাম। কুষ্টিয়া যেতে হবে। না করার কোন মানে হয় না। নিজেকে একজন অভিযাত্রী মনে হচ্ছিল। পুরাণ সময়কে নিজের মধ্যে ধারণ করে। সে দিক থেকে এটা ছিলো সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো।]

শ্রাবণের পঁচিশ তারিখ। ঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা ছুঁই ছুঁই করতে করতে পাঁককোলা আনন্দধামে পৌঁছলাম। এই ধাম হচ্ছে লালন ফকিরের ঘর। এই ঘরের গুরু ফকির লবান শাহ। মাস কয়েক আগে সাঁইজি দেহ রেখেছেন। যথাক্রমে লালন সাঁই, ভোলা শাহ থেকে কোকিল শাহ হয়ে লবান শাহ ছিলেন। এখন গুরুমাই হলেন জ্যোতিধামের আলো। তাঁকে ক্ষণিক দেখলাম। অনুষ্ঠানের আয়োজক বুড়িমা সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। ভেবেছিলাম বয়স্ক কেউ। পরে দেখলাম সদা হাসি খুশি সেবাঅন্ত প্রাণ একজন মানুষ। বয়স একদম কম। তিনি ফরহাদ মজহারের পরমাত্মা বোন। এই বুড়িমাই আয়োজন করেছেন ‘মনসার পুরাণ’।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম ভোর ছয়টায়। যাত্রায় এর মাঝে বিরতি দিলাম দুইবার। টাঙ্গাইলের রিদয়পুর এবং ঈশ্বরদীর আরশিনগর নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে। আমরা মোট সাতজন। আমি ছাড়া আর আছেন ফরহাদ মজহার, ফরিদা আখতার, সীমা দাস সীমু, রজব আলী ও সামিউল। আর ছিলেন ড্রাইভার আয়ুব আলী। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা পেরিয়ে প্রায় পনের কিলোমিটার ভেতরে পাঁককোলায় অবস্থিত ওই আনন্দধাম। দুইপাশে ঘন পাট ক্ষেত। কোথাও কোথাও চোখের সীমানা আটকে দেয়। কোথাওবা পাট কেটে ফেলা খালি মাঠ। রাস্তার পাশে সুন্দর করে বেঁধে রাখা পাট খড়ি। সবচেয়ে খারাপ লাগল এই শ্রাবণের শেষদিনেও মাঠগুলো শুকনা। বর্ষার জলের চিহ্ন নাই। পাট জাগ দিতে না পেরে কৃষকরা মুশকিলে আছেন।
আমাদের এগিয়ে নিতে ফটকে এলেন ফকির শামসুল আলম। বিশাল শরীরের মানুষ একজন, অথচ পুরা চেহারা জুড়ে শিশুর কোমলতা আর সতেজতা। যেকোন আগন্তুককে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারেন, যেন অনেক দিনের চিনপরিচয়। পরে দেখলাম গুরুমা--বুড়িমা কিম্বা রওশন ফকির, সবার ব্যবহারেই সেই শিশুসুলভ আমন্ত্রণ। মানুষে ভক্তির গুণ হবে হয়ত। যেহেতু মানুষের বাইরে এই সাধকদের আর কোন গুরু নাই, জীবিত মানুষই তাদের জীবন সাধনার গুরু, মানুষের ভজনাই শুধু তারা করেন, ফলে ‘জয় গুরু’ বলে তারা ভাব বিনিময় শুরু করেন। যে শহুরে মধ্যবিত্ত লালন সাঁইকে বাউল মনে করে, সেই মধ্যবিত্ত তরুণদের দেখেছি বন্ধুজনের সাথে দেখা হলে ‘জয় গুরু’ বলে সম্ভাষণ করতে। তবে সবসময়ই তাদের সুরে একধরনের তাচ্ছিল্য আর অবমাননা থাকে। এক ধরনের পুলকও থাকে তার মধ্যে। মনে হয় টিভিতে টারজান সিরিজ দেখে সে ‘আফ্রিকান জংলী’দের কোন সম্ভাষণ রীতি শিখে ফেলেছে, আর সেভাবে সম্ভাষণ করে সে নতুন পুলক অনুভব করছে। কিন্তু আনন্দধামের সাধক মানুষগুলার চেহারায় তাকিয়ে আর মুখে ‘জয় গুরু’ শুনে মনে হল, তাঁর সামনে মানুষ হিশাবে সাক্ষাৎ গুরু হাজির, শুধু সে মানুষেরই ভজনা তাঁরা করেন।

ওই রাতে ধামের আগাপাশতলা পরিস্কার আন্দাজ করতে পারছিলাম না। ওর মধ্যেই দুই হাত একসাথে করে ভক্তি বিনিময় করলেন আরেকজন, আবদুল কাদের--মনসা পুরাণের মূল গায়েন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই পালা পরিবেশন করছে তাঁর দল। শরীরে চিকন-চাকন আর রঙে শ্যামলা মানুষ এই আবদুল কাদের। প্রথম দেখায় কোন বিশেষ ব্যাপার নজরে পড়ার মত নাই তার মধ্যে। কিন্তু তার অভিনয় যখন দেখলাম, তখন মুগ্ধ হলাম। এই পালা পরিচালকের পুরাটাই বিশেষ, সাধারণত্ব বলতে কিছু নাই। তাঁর ওস্তাদের নাম নোয়াজ আলী। কাদের পেশাদার অভিনেতা নন, ধামের পাশেই একটা কারখানায় কাজ করেন, শ্রমিক। পালার দিনগুলাতে ছুটি নেন। আর পুরা পালা দেখাতে তার সময় লাগে তিন দিন তিন রাত। এই পালা আবার সাত খণ্ডের। কিন্তু আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। তাই তিনি বেহুলা লখিন্দর-পালা থেকে শুরু করবেন বলে জানালেন।
এই পালার আয়োজনে বাড়তি কিছু থাকে না। কাদের জানালেন, এর জন্য আলাদা করে মঞ্চ বাঁধার কোন নিয়ম নাই। একটা সামিয়ানা খাটিয়ে তার মাঝামাঝি জায়গায় পাটি পেতে গায়ক দল বসেন। হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা ও বাঁশি এইসব বাদ্যযন্ত্র--ইদানিং সাউন্ডবক্স থাকে। ধামের বিশাল বট গাছের নিচে সামিয়ানা টানানো হল। রাত বারোটায় শুরু হল মনসার পুরাণ। আবদুল কাদের ভক্তি জানিয়ে মুরুব্বীদের অনুমতি চাইলেন প্রথমে। এরপর ধুপ জ্বালানো হল। ধুপ জ্বালিয়ে যিনি চারদিক গন্ধে ডুবালেন তিনিও একইভাবে ভক্তি দেখালেন। প্রথমে তিনটা দেশাত্মকবোধক গানের সুর তোলা হল বাদ্যযন্ত্রে। বুঝা গেল এইসব যন্ত্রে তাদের দখল ভালো। তবলায় ছিলেন মইর উদ্দিন আর হারমোনিয়ামে আকীম উদ্দিন। এরপর দৌড়ে এসে ঢুকলেন তিনজন অভিনেত্রী। আসলে তারা পুরুষ। চরিত্রের দরকারে নারী সাজ নিয়েছেন। পালা শুরু হল বন্দনা দিয়ে। সরস্বতী, মনসা, শিব সহ অনেকের বন্দনা করা হল প্রায় মিনিট দশেক। পাশাপাশি নাচও।
নারী চরিত্রে অভিনয় করছিলেন--মিজানুর, ইযারুল ও নূরুজ্জামান। মুখে রঙ মেখে, শাড়ী পরে সেজেছিলেন। মনসা, সনকা ও কালনাগিনী--তিনটা চরিত্রেই তারা অদল বদল করে অভিনয় করেছেন। করুণরসের যে আর্তি মিজানুর ছড়ান, সে আর্তি দর্শককে দখল করেই পরে থামে। তিনি বাউল মিজান নামে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। চৌদ্দ বছর ধরে এই পালায় অভিনয় করছেন। পড়া লেখা জানেন না তিনি। কিন্তু মনসার পুরাণ পুরা মুখস্ত। তার স্ত্রী লেখাপড়া জানেন। স্ত্রী তাকে মনসার
পুরাণ পড়ে শোনান। তার কাছে কালিপদ দাসের মনসার পুরাণ বই আছে। কোন প্রম্পটারের বালাই নাই। মুখস্ত থেকেই মুহূর্তেই যেকোন চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। তিনি জানালেন, এই কাজ ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। মিজানুর অবশ্য এই দলের অভিনেতা না। অন্য দলে অভিনয় করেন। এখানে পরিচালক কাদেরের অনুরোধে কাজ করছেন। অভিনয় কার কাছে শিখেছেন জানতে চাইলে বললেন, তার একজন ওস্তাদ ছিল। যিনি মারা গেছেন। নাম বললেন না। বললেন, ওস্তাদ থাকতে হয়। ওস্তাদ ছাড়া কিছুই হয় না। তাই তিনি এখন একজনকে ওস্তাদ সাজিয়ে রেখেছেন। ওস্তাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই দলের হারমোনিয়াম বাজনাদার আকিম উদ্দিন বলেন, ওস্তাদ ছাড়া কিছুই হয় না। তিনি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললেন, শিক্ষক আর ওস্তাদ এক জিনিস না। অবাক হলাম! শিক্ষা আর দীক্ষার ফারাক এক কথায়ই স্পষ্ট করে দিলেন আকিম উদ্দিন।

বাকি অংশটুকু এখানে পড়তে পারেন

একই ভ্রমন নিয়ে ফরিদা আখতারের লেখা
পাঁককোলা গ্রামে মনসা

এই লেখা দুটি চিন্তা ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত। এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
এইছাড়া একই বিষয়ে আরো একটি লেখা
মনসা মঙ্গলে বাংলার ভাবের হদিস
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১০:০০
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×