রবি শস্যের মৌসুম শেষ।সরিষা অনেক আগেই তোলা হয়ে গেছে।মাষকেলাই আর কেলাই তোলা প্রায় শেষ।পাকা গম ক্ষেতে মাঠ সয়লাভ।সোনালী রঙে ভরে গেছে মাঠ।এবার গমকাটার পালা।গম দিনে ও রাতে সবসময়ই কাটা যায়।দিনের বেলায় মাঠ জুড়ে খাখা রোদ তাই অনেকেই রাতে লন্ঠণ জ্বালিয়ে রাতে গম কাটে।ফুরফরে বাতাস কৃষকের চিত্ত শীতল করে।অনবরত গ্যাচ্ গ্যাচ্ শব্দে গম কাটা চলতে থাকে।রাতে মাঠজুড়ে লন্ঠণের হাট বসে।সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য।কৃষাণীরা বাড়ি থেকে লন্ঠণের আলোর দিকে তাকিয়ে প্রহর গোণে উঠানের কোণে।আর সেই সাথে চলে বিরহ গীত।
ভ্রমর কয়ও গিয়া
কৃষ্ণরে বুঝাইয়া ভ্রমররে ভ্রমর কয়ও গিয়া
ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কিষাণীর বুক চিড়ে।রাধার বিরহ কিষাণীরর হৃদয় বিগলিত করে।উঠানে শীতল পাটি পেতে কৃষাণীরা ছেলেমেয়েদের রূপকথা শোনায়,কিচ্ছা শোনায় ।আনমনে থেকে থেকে বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে বিরহী গীত।ছেলে মেয়েরা মায়ের কষ্টে কাঁদো কাঁদো হয়।একসময় বাচ্চারা উঠানেই ঘুমিয়ে পড়ে।কিষাণী তাদের উঠিয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
অনেক রাতে কাজ সেরে কিষাণ আসে মাঠ থেকে।হাত মুখ ধোয়ার জল এগিয়ে দেয় ,স্বামীকে শরীর মোছার গামছা এগিয়ে দেয়।খেতে দিয়ে হাত পাখায় বাতাস করে ।টুকটাক আলাপ করে।অনাগত ভবিষ্যতের কথা বলে।
এভাবে একসময় গম কাটার পর মাঠ জুড়ে খেলঅ করে খা খা রোদ।শূণ্য মাঠে তখন শুরু হয় চাষাবাদ।সারাদিন জুড়ে চলতে থাকে জমি চাষ।একসাই দু'সাই তিনসাই।তারপর বোনা হয় বর্ষার ধান।
মুর্শিদ মিয়া স্কুল থেকে বাড়ি আসলে সায়েরা বেগম ছেলেকে বাপের জন্য খাবার নিয়ে মাঠে যেতে বলে।
-বাপজান কোন ক্ষেতে গেছে আমি ক্যামনে যামু?
সায়েরা বেগম আঙুল উঁচিয়ে দিক নির্দেশনা দিয়ে বলে
-ঐ যে নদীতে একটা একটা পালতোলা নাও দেখতাছস না?ঐ বরাবর চাইয়া দেখ একটা হাল দেখা যাইতাছে।দেখছস?ঐডা হইল তোর বাপের হাল।অহন আব্বা তুমি তাড়াতাড়ি যাও। বেইন্নাবেলা তোমার বাপ দুইমুঠ পানি ভাত খাইয়া বাইর হইছে আর কিছু খায় নাই।বেইল পইড়া আয়তাছে তাড়াতাড়ি যাও আব্বা। আমি লুঙ্গি দিয়া খাওন সব বাইন্ধা রাখছি।
মুর্শিদ মাথায় খাবারের পুটলি আর হাতে একজগ পানি নিয়ে মাঠে বাবার কাছে যেতে থাকে।
দয়াল মিয়া হাল থামিয়ে রেখে খেতে বসে ।আর বলে
-আইজ এত দেরী হইল ক্যান মুর্শিদ মিয়া?
-আব্বা আইজ স্কুল দেরীতে ছুডি দিছে হেরলাইগা দেরী হইয়া গ্যাছে।
দয়াল মিয়া খায় আর ছেলেকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে।ছেলে বাবার দিকে চেয়ে থাকে। বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে।
-ইসকুল থাইক্কা আইসা খাইছস?
-খাইছি
-এই ভাত কইডা খাইয়া নে।খাইয়া বাসনডা ধুইয়া রাখ আমি কামডা শেষ করি।
মুর্শিদ খুব খুশি হয়।মাঠে বসে খাবার মজাই অন্যরকম।সিঁদলের ঝাল ভর্তা মুখে লাগলে চোখ মুখ দিয়ে জল পড়া শুরু হয়।তারপর আস্তে আস্তে সবঠিক হয়ে যায়।মুর্শিদের ইচ্ছে করে বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে এসে মাঠে বসে খায়।মাঠে বসে খাওয়ার অন্যরকম মজা
খাওয়া শেষ হলে মুর্শিদ বাসনটা ধোয়ে রাখে।জামি চাষ আরেকটু বাকি।মুর্শিদ বাবার লাঙলের দিকে চেয়ে থাকে।দয়াল মিয়া লক্ষ করে ছেলের এই চেয়ে থাকা ।ডাক দিয়ে বলে এদিকে আয়তো দেখি ।লাঙলের কটিটা ধর।মুর্শিদ ভয়ে ভয়ে কটি ধরে।মাটি ভেদ করে লাঙল এঁকে বেঁকে চলে।মুর্শিদের চোখে শিহরণ।সে পারছে।দয়াল মিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে।নির্দেশনা দেয়।
কিছুক্ষণের ভেতর মুর্শিদের হাত ধরে আসে।বলে আব্বা হাত ব্যাদনা করতাছে।দয়াল মিয়া লাঙলের কটি ধরে হাল শেষ করে।ছেলেকে বলে
-গরু গুলারে নদীর পাড় থাইকা ঘাষ খাওয়াইয়া বাড়িত চইলা আইস বিয়ানের আগে।
দয়াল মিয়া লাঙল আর জোয়াল কাধে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়।
মুর্শিদ গরু চরাতে থাকে নদীর পাড়ে পাড়ে।গুরুগুলিকে ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরার খেয়ালে মেতে উঠে ।
এলুমিনিয়াসের বাসনটা হাতে নিয়ে নদীর বুক সমান পানিতে ডুব দিয়ে অনবরত কাঁদা তুলতে থাকে বাসন ভরে।কাঁদা তুলে পাড়ের কিনারে এসে ঘেটে ঘেটে বাইন মাছ বের করতে থাকে।সে আনন্দে উৎসাহে ধরতে থাকে মাছ।সাদা বাইন কালো বাইন আর তারা বাইন।গরু চরে খেতে থাকে ঘাস।মাছ ধরা শেষ করে মাছগুলোকে বাসনের সাথে পেচিয়ে সান্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে আসে।
সন্ধ্যার পর হাত মুখ ধোয়ে সুর করে পড়তে থাকে-
' আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে'
আষাঢ় মাস।জমির ধানের চারা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।পুরো মাঠ জুড়ে সবুজ ধানের ক্ষেতে বাতাস ঢেউ খেলে যায়।এ যেন ফসলের মাঠ নয় এক সবুজ জলের নদী ।ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠে সেই নদীতে।দিন রাত ঝুম বৃষ্টি ।মেঘ ডাকে সেই সাথে ডাকে কুলা ব্যাঙ।শামুক ঝিনুক নদী থেকে জমিতে উঠে আসে।কাঁদা মাটিতে গর্ত করে বিছানা পাতে।জমির আলে আলে শাদা ডিম ছাড়ে।জট লাগানো ছোট ছোট অসংখ্য ডিম।কৃষকেরা জমির আগাছা পরিষ্কার করে।খড়ের পেচানো বেণীর আগুনে ক্ষণে ক্ষণে চলে তামাক সেবন।শামুক কুড়ানি বালিকার দল হাড়ি হাতে বের হয় ।জমির আলে আলে শামুক কুড়ায়।জমির পানি নালা বেয়ে বেয়ে নদীতে পড়ে ।সেই পানির সাথে উজান বেয়ে বেয়ে উঠে আসে মাছ।কৈ ,পুটি ,শিং মাগুর ,শোল ,টাকি।জমির কোথাও একটু পানি জমা থাকলে সেই পানিতে মাছ কিল বিল করে।যখন আকাশে মেঘ ডেকে উঠে ছেলে মেয়ে জোয়ান বুড়ো কেউ ঠেলা কেউ পলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে।ছোট খালের দুপাড়ে জোট বেঁধে ঠেলা চালিয়ে মাছ ধরতে থাকে।টেংরা, গোলসা মাছে ডালা ভরে যায়।পাট ক্ষেত গুলোতে কৈ মাছ কানখা মেলে মেলে বেয়ে উঠে।ছেলে বুড়োরা পাট ক্ষেতে কৈ মাছ ধরে।নদীর কাছাকাছি নিচু জমগুলোতে জোয়ারের পানি চলে আসে।সেই পানিতে দল বেঁধে বোয়াল মাসে ডিম ছাড়তে।জমির আলে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে মা বোয়াল মাছ আর পেটের মধ্যে পাতি বোয়ালেরা অনবরত ঠোকরায়।নাভি দিয়ে ডিম বের করে।কোথাও কোথাও বাঙলা আর পোটা মাছ দল বেঁধে খেলা করে।ঠিক ঠাক পলো চালাতে পারলে একসাথে ধরা পড়ে দেড় থেকে দুইশ পোটা মাছ।এসময় নিচু জমিগুলোতে মানুষ দল বেঁধে পলো নিয়ে আস্তে আস্তে হাটতে থাকে হাঁটু পানিতে।পিনপতন নিরবতায় সতর্ক চোখ মাছের রাগ খুঁজতে থাকে।পানির কোথাও শব্দ হলে সেই শব্দ ধরে এগিয়ে চলে।ছপাং করে পলো চালিয়ে সেই পলোর উপর উঠে বসে।ভেতরের বোয়াল মাছ যত বড়ই হোক ঝাপটা ঝাপটি করে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।আর সেই সুযোগে বুরুজের মত সূঁই কানখার ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে আটক করে।
দয়াল মিয়া ছেলেকে নিয়ে পলো হাতে বের হয়।মেঘ অনবরত ডেকে চলেছে।হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে নিচু জমির কাছে চলে আসে।পলো উঁচু করে সতর্ক পা চালায় দয়াল মিয়া।মুর্শদ একটি উঁচু জমির আলে দাঁড়িয়ে থেকে বাবাকে খেয়াল করে।দয়াল মিয়া কয়েকবার পলো চালায় কিন্ত্ত কোন মাছ ধরা পড়ে না।মুর্শিদ বাবাকে পলো চালাতে দেখলেই উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে।যখন দেখে কোন মাছ ধরা পড়েনি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।দয়াল মিয়া অনেক বার পলো চালিয়ে ক্লান্ত এবং সেই সাথে কিছুটা বিরক্ত।আজ একটা মাছও পলোর ভেতর আটকাচ্ছে না।হঠাৎ একজায়গায় পানির নড়াচড়া দেখে দয়াল মিয়া সতর্ক পা চালায়।খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়।পানিতে একটুও শব্দ হতে দেয় না।ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ছপাৎ করে পলো চালিয়ে উঠে বসে পলোর উপর।আর সেই সাথে প্রচন্ড তোলপাড় শুরু হয়।পলোর ভেতর মাছ আটকা পড়েছে।মাছটা ঝাপটা দিয়ে পলোসহ দয়াল মিয়াকে একহাত উপরে ছুড়ে দেয়।দয়াল মিয়া পলোর উপরে বসা থাকায় আবার পলোসহ মাছে উপরে আছড়ে পড়ে।দুই পাশের ধান গাছ ধরে দয়াল মিয়া পলোর উপর চেপে বসতে চায়।মাছটা আক্রোসে তাকে উল্টে ফেলতে চায়।ধান গাছ ছিড়ে সব একাকার হয়ে যায় মাছ তবুও ক্লান্ত হয় না।দয়াল মিয়ার ভয় হতে থাকে মাছটা তাকে ধীরে ধীরে নিচু পানির জমিতে নিতে থাকে।কিন্ত্ দয়াল মিয়া হার মাতে চায় না।সে প্রাণ পণে পলোর উপর বসে দুপাশের ধান গাছ মুঠোমুঠো ধরে লড়াই করতে থাকে।হাতের ইশারায় মুর্শিদ মিয়াকে কাছে আসতে বলে।মুর্শিদ একটা আতংক নিয়ে বাবার পলোর নিকট যেতে থাকে।কাছে গলে দযাল মিয়া ধমক দিয়ে বলে পলোডার উপরে উঠে বসতে বলে।বাপ বেটা দুইজন পলোর উপর বসে দুইহাতে দুপাশের ধান গাছ আকড়ে ধরে দাঁত খিঁচিয়ে বসে থাকে।ভেতররের মাছটা ও প্রাণ পণ ঝাপটাতে থাকে।মাছ আর মানুষের লড়াইয়ে একসময় মাছ পরাজিত হয়।ক্লান্ত হয়ে হা করে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে পলোর ভেতর মাছটা অর্ধেক শরীর ভেতরে বাকি অর্ধেক বাহিরে।মুখটা পড়েছে ভেতরে।যার কারণে এটাকে আটকানো গেছে।দয়াল মিয়া মাছটার শ্কতি পরীক্ষা করে ।আস্তে আস্তে পলোর মুখ দিয়ে ভেতরে হাত দেয়।এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ।হাত ভুলে মাছের মুখে গেলে সর্বনাশ।এককামড়ে হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।কয়েকবারে প্রচেষ্টায় কানখা খুঁজে বের করে মোটাসূঁইটা ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে একটা আন্ধা গিট্টু দেয়।তারপর পলো সাথে বেঁধে উপর্যোপরি
আঘাত করতে থাকে মাছটাকে।তারপর ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে আসে শুকনো জমির দিকে।শুকনো জমিতে তুলে মাছের দিকে তাকিয়ে বাপ বেটা দুজনেই অবাক।দয়াল মিয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে এইডা মাছ না জানোয়ার রে?মুর্শিদ মাছ দেখে আৎকে থাকে।ভয়, আতংক,আনন্দ ,উচ্ছাসে মুখে কোন কথা আসেনা।দুজনেই খেয়াল করে মাছের নাভি দিয়ে ডিম বের হচ্ছে।দয়াল মিয়া ছেলেকে একগোছা ধান গাছ ছিঁড়ে আনতে বলে।সেই ধান গাছ পুটলির মত পাকিয়ে মাছের নাভিতে ঢুকিয়ে দেয়।তারপর পলোটা উল্টিয়ে মাছটাকে রেখে মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে।পেছনে পেছনে দয়াল মিয়া।একসময় মাছের নাভিতে আটকানো পুটলিটা বের হয়ে যায়।ডিম বেয়ে বেয়ে পড়তে থাকে দয়াল মিয়ার গাল বেয়ে নাক বেয়ে।ছেলেকে শুনিয়ে দয়াল মিযা বলে ডিফাড মনে অয় ছুইট্টা গ্যাছে মুর্শিদ।ডিমতো সব পইড়া যাইতাছে ।ছেলে বলে পড়ুকগা আর ইকটু বাড়িত আইসা গ্যাছি আব্বা।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:০৮