somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পরবাসে ছাত্রছাত্রীদের রোজা পালন

০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৮:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতি বছর কয়েক লাখ ছেলেমেয়ে তাদের নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমায় পড়ালেখার খাতিরে। মুসলিম ছেলেমেয়েরা যেখানেই যাক না কেন, তাদের জীবনে রমজান মাসটি বড় একটি ভূমিকা রাখে – অনেকেই কমবেশি চেষ্টা করে রোজা রাখতে। এখানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াতে অধ্যায়নরত কিছু ছাত্রছাত্রীর এবারের রমজান অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো।

ফাতিমাতা সাকো
জন্ম, বেড়ে উঠা দু’টোই গ্যাবনে কিন্তু পারিবারিকসূত্রে আফ্রিকার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত দেশ মালি’র নাগরিক ফাতিমাতা। যুক্তরাষ্ট্রে ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ অধ্যায়নরত ফাতিমাতা নিজেকে মনেপ্রানে একজন মুসলিম ভাবে। রমজান মাসে বাবা, মা, ভাইবোনদের অনুপস্থিতি তাকে কষ্ট দেয়। ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম নিজ দেশের ইফতারের কথা। ফাতিমাতা বলল, “আমরা ইফতারে মূলত ভাত এবং অনেক রকম সবজি দিয়ে একটি খাবার তৈরী করি, উপরে দেয়া হয় মাছ অথবা মাংস। আমরা এটাকে বলি zame।” আমরা যেমন ইফতারে শরবত খাই, মালিয়ানরা ইফতারে গরম দুধ, পানি, চিনি এবং চালের গুরা দিয়ে তৈরী একধরনের ঘন, স্বাস্থ্যকর পানীয় খেয়ে থাকে। আমেরিকাতে একবারই তার কলেজের পাশে অবস্থিত মসজিদে তারাবীর নামাজ আদায় করেছিল ফাতিমাতা। সাধারণত নিজ এপার্টমেন্টেই আদায় করে সে এই বিশেষ নামাজ।

ওয়াজিহা সাবাহাত
লাহোরের মেয়ে ওয়াজিহা অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছে। “যেখানেই থাকি না কেন, রমজান আমার জন্য বিশেষ একটি মাসে – আমি দেশে থাকি কিংবা বিদেশে,” ওয়াজিহা জানালো। এই রমজানে তার বারবার মনে পড়েছে পাকিস্তানী জিলেবী (জিলাপি) আর মায়ের হাতে বানানো পাকোড়ার কথা। সেহরী সময়মত করা হয় কিনা জিজ্ঞেস করতেই ওয়াজিহা বলল, “দেশে সবসময় মা জোর করে সেহরী করাতো, কিছুতেই শুনতো না। কিন্তু এখানে এক গ্লাস পানি খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি, সেটিই আমার সেহরী,” ওয়াজিহার গলাটা ভেজা শোনাচ্ছিল। হয়তো মায়ের কথা মনে পড়েছিল সেই সময়।

খালেদা আহমেদ
নরওয়ের নাগরিক খালেদা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ হার্টফোর্ডশ্যায়ারে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পড়ছে। আর দশটা প্রবাসী ছেলেমেয়ের মত এই রমজানে পরিবারের কথা বারবার মনে পড়ছে খালেদার, কিন্তু তারপরও খারাপ লাগছে না বিদেশে। তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে – ইফতার এবং সেহরী দু’টোই বন্ধুদের সাথে রেঁস্তোরাতে করা হয় খালেদার। তারাবীর নামাজ পড়েছে কিনা যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞেস করতেই খালেদা বলল, “একবারই শুধু পড়েছিলাম। সারিবদ্ধভাবে অনেক মেয়ে এবং মহিলা নামাজ পড়েছিলাম একসাথে। খুব সুন্দর একটি অভিজ্ঞতা ছিল সেটি।”

আনিকা খান
বাংলাদেশের মেয়ে আনিকা ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করছে আমেরিকার মিনেসোটাতে। আনিকা বলল, “ইফতার অনেক সময় করা হয়না ঠিকমত। ক্লাসে থাকলে সাথে থাকা বোতল থেকে দু’ঢোক পানি আর খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙ্গি। বাসায় থাকলে নুডলস অথবা স্প্যাগেটির মত সহজ কিছু তৈরী করি। যখন কিছু করার সময় বা ইচ্ছে থাকেনা তখন ইফতারে ভাত আর ঘরে করা কোন তরকারী দিয়ে ইফতার সেরে ফেলি।” আনিকা আরও বলল, “বিদেশে রোজা রাখাটা অনেক সময় কঠিন। মুসলিম দেশগুলোতে স্কুল-অফিসের টাইম রোজদারদের সুবিধার্থে পালটে দেয়া হয়, কিন্তু বিদেশে তো সেটা হয়না তাই অনেক সময় সবকিছু সামলে রোজা রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।”

অনেক দেশের ছেলেরাই নিজের দেশে অনেক আয়েসে দিন কাটায়। রান্না তো দূরে থাক, নিজের কাপড়, থালাবাসন ধোয়া কোনকিছুই করতে হয়না তাদের। কিন্তু দেশের বাইরে গেলে এসব ছেলেরাই নিজের কাজ নিজেরাই সব করে, জীবনটা অন্যরকম হয়ে যায় তখন।

মাহদিন মাহবুব
ইউনাভার্সিটি অফ সাউথহ্যাম্পটনে ওয়্যারলেস কমিউনিক্যাশন্সে অধ্যানরত মাহদিন যুক্তরাজ্যে যাবার আগে বাংলাদেশে কখনো রান্না করেনি। তাকে রোজার কথা জিজ্ঞেস করতেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, “এখানে আমরা প্রায় ১৮ ঘন্টা রোজা থাকি! অনেক লম্বা দিন। অবশ্য গরম আর বাতাসে আদ্রতা কম থাকায় দেশের চাইতে কষ্টটা অনেক সময় কম হয়।” কিন্তু দেশের মত ঘরে বানানো ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনী দিয়ে ইফতার মাহদিনের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মত এখন।
মাহদিন সুযোগ পেলে মসজিদে গিয়ে তারাবীটা সেরে ফেলে। “ঘরের চাইতে মসজিদে গিয়ে পড়লে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা শান্তি অনুভব করি,” বলছিল মাহদিন।

মোহাম্মাদ হাতিম কারিম উদ্দিন
ভারতের ছেলে হাতিম আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্টে পড়ছে। এই রমজানে ইফতারে সাধারনত কি খাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে হাতিম বলল, “পরিজ, ওটমিল, এনার্জি বার আর মুরগী ভাজি দিয়েই ইফতার করছি বেশিরভাগ সময়।” চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় ভারতে নিজের বাড়িতে এমন ইফতার মেন্যু অকল্পনীয় ছিল হাতিমের জন্য।

দেশের বাইরে রোজার অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে হাতিম বলল, “এখানে রোজা টের পাওয়া যায়না। মসজিদে না গেলে, মুসলিম বন্ধু না থাকলে রমজান কখন এসে চলে যায় অনেক সময় বোঝাই যায় না।” ক্লাস, কাজ করে অসুবিধা হয় কিনা জানতে চাইলে হাতিম জানাল, “এখানের অধ্যাপকেরা অনেক সহায়তা করেন আমার মত ছাত্রদের। সর্বাত্মক চেষ্টা করেন যেন এই রমজান মাসটা আমাদের জন্য সহনীয় হয়। আর তাই বেশিরভাগ সময় একটানা ক্লাস, কাজ করবার পরও খুব একটা খারাপ লাগেনা।”

তাহা আলহুদায়ার
লিবিয়ান আরব তাহা যুক্তরাজ্যে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন্সে পড়ছে। অন্য পরবাসী ছাত্রছাত্রীর মত তারও এই রোজায় বারবার মনে পড়ছে নিজ পরিবারের সদস্যদের কথা। “সোহর (সেহরী) এর সময় দেশের কথা খুব মনে পড়ে,” তাহা জানাল। “তার উপর এখানে আশেপাশে খুব একটা বেশি মুসলমান মানুষ না থাকায়, রোজার মাসটায় নিজেকে কেমন যেন একা মনে হয়। কিন্তু তারপরও ভাল লাগে যখন মসজিদে তারাবী পড়তে যাই। বাসার কাছে মসজিদ থাকায় খুব বড় একটা সুবিধা হয়েছে,” বলল তাহা।

আবুবকর কানাদ্‌জী
মালির ছেলে আবুবকর অধ্যায়ন করছে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমেরিকায়। রোজার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, “আমাদের দেশে ঘরের মেয়েরাই খাওয়া দাওয়ার সব ব্যবস্থা করে তাই কখনো ইফতার, সেহরী নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি আগে। তাছাড়া মালিতে রোজার বিশেষ খাওয়াগুলো পরিবারের সবাই একসাথে বসে খায়। এখানে মা, বাবা, ভাইবোনদের অনুপস্থিতি সবসময় অনুভব করি।”

তারাবী পড়া হয় কিনা জানতে চাইলে আবুবকর বলল, “আমাদের দেশে আমরা জামাতে তারাবী পড়ি। জামাত ঘরে, মসজিদে দুই জায়গাতেই হয়। তারাবীর নামাজ রোজার একটি বড় অংশ আমার দেশে কিন্তু এখানে জামাতে পড়া হয় না, একাই তারাবীর নামাজ বাসায় আদায় করি আমি।”

প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে অনেক মুসলিম ছেলেমেয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যায় উচ্চশিক্ষার আশায়। দেশের কথা সবসময়ই তাদের মনে পড়ে আর বিশেষ করে মনে পড়ে রমজানের মত বিশেষ উপলক্ষ এলে।

তারা নিজের পরিবারে অনুপস্থিতি অনুভব করে, স্মৃতিচারন করে বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটানো ইফতারের সময়গুলো। বাতাসে খুঁজে নিজ দেশের ইফতারের মনমাতানো খাবারের সুবাস। কিন্তু জীবন বয়ে যায় আর তাইতো তারা নতুন দেশে নিজেদের মানিয়ে নেয়, পরবাসে নতুন জীবনে নিজেদের মত করে রমজান পালন করতে শিখে।




সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৭:৩৯
১৮টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বর্গের নন্দনকাননের শ্বেতশুভ্র ফুল কুর্চি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৭


কুর্চি
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : কুরচি, কুড়চী, কূটজ, কোটী, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, বৃক্ষক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শক্রিভুরুহ, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, মল্লিকাপুষ্প, গিরিমল্লিকা।
Common Name : Bitter Oleander, Easter Tree, Connessi Bark,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচলের (সচলায়তন ব্লগ ) অচল হয়ে যাওয়াটই স্বাভাবিক

লিখেছেন সোনাগাজী, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬



যেকোন ব্লগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর, একটি ভয়ংকর খারাপ খবর; ইহা দেশের লেখকদের অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় ও নীচু মানের লেখার সরাসরি প্রমাণ।

সচল নাকি অচল হয়ে গেছে; এতে সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

হরিপ্রভা তাকেদা! প্রায় ভুলে যাওয়া এক অভিযাত্রীর নাম।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২২ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৩


১৯৪৩ সাল, চলছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। টোকিও শহর নিস্তব্ধ। যে কোন সময়ে বিমান আক্রমনের সাইরেন, বোমা হামলা। তার মাঝে মাথায় হেলমেট সহ এক বাঙালী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!

এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×