পরী বানুর আজকাল সময়টা খারাপ যাচ্ছে।কতদিনই বা আর !যতই দিন যাচ্ছে ততই বয়স বাড়ছে ।খদ্দেরের সংখ্যাও দিন দিন কমছে।টাকা পয়সা না থাকায় শরীরের ও চিকিৎসা চলছে না।শরীরে নানা রোগ বালাই বাসা বেঁধেছে।অথচ একটা সময় পরী বানুর কতই না চাহিদা ছিল।নগরের পয়সা ওয়ালা ব্যবসায়ী, বড় বড় রাজনীতিক ,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কত লোকই না তার ঘরে লাইন ধরে থাকত।সে বয়সের কথা ভেবে ভেবে পরী বানু শিহরিত হয়।
পরী বানু তাঁর নিজের বাপ মায়ের দেয়া নামটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেনা।এ ক্ষুদ্র জীবনে কত বার যে নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে তার কোন হিসাবই নেই।সে আজকাল ছোট বেলার কথা মনে করতে চেষ্টা করে।কিন্ত্ত সবকিছু মনে পড়ে না।শুধু মনে পড়ে একটা নদীর পাড়ে তার বাড়ি ছিল।সে নদীতে সে পানকৌড়ির মত ডুবিয়ে বেড়াত।মাছ ধরত।নদীর ঘাটে কত মানুষের আনাগোনা ছিল।বাবা মা আর তিন বোন মিলে সুখের কিংবা দুঃখের সংসার ছিল তাদের।একটা ঝাকড়াচুলের ছেলে প্রতিদিন বাঁশি হাতে বসে থাকত নদীর ঘাটে। তার প্রতিক্ষায়।সেই ছেলেটির মুখ আজ আর মনে পড়ে না।ভালোবাসার কথা বলত।সে মাথা নিচু করে শুনত।লজ্জায় লাল হয়ে যেত।কিছুই বলতে পারতো না।আহ! কী সুন্দর জীবন।
তারপর নদী ভাঙ্গন।নদীর ভয়ঙকর জলে মিশে যায় তাদের সংসার,বাবা মা বোনেরা।জলের বানে ঝাপসা হয়ে যায় ঝাকরা চুলের সেই ছেলের মুখ।আর সেই জলে ভাসতে ভাসতে একসময় দেখে তার দেহ যেখানে ঠেকেছে সেটা একটা অচিন্তনীয় জগৎ।যে জগতের কথা সে কখনো এ জন্মে কিংবা পূর্বের কোন জন্মে ভাবেনি।
আজকাল তার মনে হয় এটা তার জীবনের কোন অংশ ছিল না।এটা অসংখ্য স্বপ্নের ভীড়ে একটা দুঃস্বপ্ন কিংবা সুন্দর একটা স্বপ্ন।সে ভাবতে চেষ্টা করে আমার কোন শৈশব ছিলনা ।আমার কোন জন্ম ছিলনা।কিংবা মৃত্যু।জীবন টা এমনই ছিল অনাদিকাল ধরে ।এমনই ধ্রুব।
মেয়েটাকে নিয়ে তার কষ্ট হয়।জন্মদাতা কত স্বপ্ন দেখিয়ে পালিয়ে গেলো ।ছিপছাপ গড়নের সেই ছেলেটি !মাতালের মত তার ঘরে ছুটে আসত। বলত তাকে ভালোবাসে।দিনের পর দিন তার ঘরে কাটিয়ে যেত।সে বলত এ সমাজের মুখে লাথি মেরে সে তাকে বিয়ে করবে।তার পেটে সন্তান আসে। যখন সন্তানের কথা বলল সে শীঘ্রই বিয়ে করবে বলে যে গেল আর এলোনা।
কত উৎসাহী ছেলেরা তার ঘরে আসত।এসেই বলত আমি তোমার কাছে দেহ চাইতে আসিনি।তোমার জীবনের গল্প শুনতে এসেছি।একজন পরীবানু হওয়ার গল্প। তারা কথা দিত যে এ গল্প গোপন করবে।প্রথম প্রথম জীবনের গল্প বলতে বলতে বেহুসের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ত।গল্প শুনে কেউ কেউ অনেক টাকা কড়ি দিয়ে করুণা করে যেত।তারপর সেই একই গল্প করতে করতে আর চোখে পানি আসতো না।সেই আবেগ বাধ ভেঙ্গে ভেসে পড়তো না নদীর মত।কেউ কেউ গল্প শুনে দুঃখে বিগলিত হয়ে আহা আহা করতে করতে আদর করে বুকে, পেটে, ঠোঁটে ,শরীরের সবখানে সেই দুঃখগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে যেত।
মেয়েটি পেটে আসার পর সে অনেক কষ্টে সময়টা পাড়ি দিয়েছে।কী নিদারুণ কষ্ট !খেয়ে না খেয়ে।এ অবস্থায় কোন খদ্দর আসতো না তার কাছে।তার কোন ব্ন্ধন না থাকায় মেয়েটিকে তার সবচেয়ে আপন মনে হতে থাকে।ছেলেবেলা থেকেই ফুল বানু মায়ের ঘরে খদ্দের আসলে বুঝতে পারত যে মা'য় ব্যাটার লগে ঐ ঘরে গিয়া টেকা উৎপাদন করতাছে।সে খুশিতে আত্বহারা থাকতো।যেদিন টেকা উৎপন্ন হইব সেদিন ভালাভালা খাওন যাইব।একটা সময় সেই মেয়ের কাছে টেকা উৎপাদনের রহস্য আর গোপন থাকেনি।কমকম করে বুঝতে শিখে।এই অন্ধ গলিতে মেয়েটি ভাবতে শিখে দুনিয়ার সকল মানুষই এইভাবে ,তার মায়ের মতন টেকা উৎপন্ন করে জীবন চালায়।সে ও টেকা ,বেশি বেশি টেকা উৎপন্ন করার স্বপ্ন দেখে ।শুধু বয়সটাই যা সমস্যা।মা'য় কয় এখনো সময় হয় নাই।সে মনে মনে ভাবে কবে যে সময় হইব?সময় হইলে সে যে টেকা কামাইব সে টেকা দিয়া পেট ভইরা ভালো ভালো খাওন খাইব।চুলের লাল ফিতা কিনব।সুবাস তেল মাথায় দিব।মুখে স্নো দিব।
সেদিন পরীবানুর অনেক অনেক আগের পুরনো খদ্দের কি খেয়ালে পরীবানুকে দেখতে আসে।একসময় সে পরীবানুর নিয়মিত খদ্দের ছিল।সে এখন অভিজাত পাড়ায় যাতায়াত করে।এসব নোংরা পল্লীতে তার এখন আর হয়না। বমিবমি হয়।তারপর ও কি মনে করে উঁকি দিতে আসল কে জানে?
এসেই তার মেযেটাকে দেখে কেমন একটা দৃষ্টিতে বারবার তাকাতে লাগল।পরীবানু ব্যাপারটা বুঝতে পারে।
-তোমার মেয়ে কি কামে নামছে নিহি?
-না বাবু সাব অহনও বয়স হয় নাই।
-ক্যান ?দেখতে তো মাশাআল্লাহ ডাঙ্গরই হইছে।হোন কামে নামাইলে প্ররথম দিনটা আমারে দিবা।টেকা পয়সা নিয়া ভাইবো না।আমি আছি তো টেকার চিন্তা নাই।আমি হইছি কাম রসিক বুঝলা ।কাম ছাড়া জীবনে আর আছে কি কও?
পরী বানুর মুখ থেকে কথা সরে না।তারপরও সে ভেবে দেখার কথা বলে।
যাবার সময় বাবুসাব ফুলবানুর হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট ছুঁড়ে দিয়ে যায়।আর বলে যায়
- বায়না দিয়া গেলাম পরী তোমার মেয়ের প্ররথম দিনডা যেন্ আমার লাগি থাহে।
পরীর শরীর খুব খারাপ যাচ্ছে।ঘরেও খাবার নেই।মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে অসহায়ের মত মেয়েটিকে দেখতে থাকে।শীর্ণ শরীর,রোগারোগা,চোখ দু'টি কোটর থেকে বেরিয়ে আছে।তবুও কী একটা মায়ায় সারাটা মুখ ভরে আছে।
তারপরই সে আঁচলে মুখ মুছতে থাকে ।এ সুন্দর শিশুটিকে ও সারাজীবন এ অন্ধকার গলিতে পঁচে মরতে হবে।মানুষের ক্রমাগত ঘৃণা আর আলো বাতাসহীন জীবন!সে প্রায়ই ভাবে অর্থহীন কিছু ভাবনা।এসব ভেবে ভেবে সে একসময় ক্ষান্ত দেয়।ভেবে আর কি হবে?জীবন তাদের এ গলিতেই সীমাবদ্ধ।বাহিরের আলোর স্বপ্ন দেখে তাদের কোন লাভ নেই।একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আর বাবুসাবের প্রস্তাবের কথা ভাবতে থাকে।ভয়ও আছে প্রথম ধাক্কা সামলানুটাই কঠিন।সে অনেককেই দেখেছে প্রথম বার কাজ করতে গিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত ঘটনা গড়িয়েছে।গতবছর তো রক্তপাত বন্ধ না হওয়ায় একটা মেয়ে মারাই গেল।
কি করবে আর ভেবে পায় না।এদিকে ঘরে খাবার নেই।তার শরীরের জ্বরজ্বর ভাবটা আরো বেড়েই চলেছে।অভাবের তাড়ানায় সে তার মেয়েটাকে একটু বড় বড় দেখতে থাকে।শেষে বাবুসাবকে খবর দেয়।আর মেয়েকে যতটুকু পারে কলাকৌশল সব বুঝিয়ে দেয়।
বাবুসাব পান খেতে খেতে ঘরে ঢুকে।
-কৈ পরী কতদিন পর তোমার ঘরে আবার ঢুকলাম হ্যা?
-বাবু,মেয়েটা আমার এই প্ররথম,ইকটু দয়ামায়া রাইখেন।
-আরে কোন চিন্তা কইরো না।কামকলা আমার সব জানা আছে।
ফুরবানুকে খুলতে খুলতে বাবুসাব খুব আনন্দ লাভ করে।কতদিন পর কুমারি মেয়ের মজা নিতে যাচ্ছে সে।আনন্দে তার চোখ চিক চিক করে।
ফুল বানু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবুসাবের চোখের দিকে ।নিম্নাঙ্গের দিকে।শিশু মনের প্রশ্ন সে না লুকিয়ে বলে-
-আপনের ইয়েটা এত বড় ক্যান?
আহা! বাবুসাবের যেন এ প্রশ্নটি শোনার জীবন জীবন সাধ ছিল।হাসিতে সে ফেটে যেতে থাকে।সে যতই হাসতে থাকে মেয়েটি ততই কুকড়ে যেতে থাকে।
এভাবে, ঠিক এইভাবে ফুল বানুরা হয়ে উঠে বাবুসাবদের হাসির খোরাক । সারা জীবনের জন্য।হাসির সেই শব্দ অন্ধগলির চিপাপথ ছাপিয়ে বাইরে আসে না।আসতে পারেনা।
উৎসর্গঃ
আমাদের সমাজ ,সমাজের সুশীল এই ফুল বানুদের কে সম্মান করে বলেন 'সেফটি বাল্ব'।সমাজকে সেইফ রাখার মহাপবিত্র দায়িত্ব তারা পালন করে চলেছে।তারা না থাকলে সভ্য সমাজে বাবুসাহেবেরা অশান্তি সৃষ্টি করতো।বাবুসাহেবদের কুদৃষ্টি থেকে সুশীল সমাজ রক্ষা পেত না।সমাজটা ধ্বংস হয়ে যেত।সুশীলগণ বউ মেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটাতে পারতো না।সেই সেফটি বাল্বদের .............