somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গানওয়ালা

১৪ ই আগস্ট, ২০১০ রাত ১১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার গানওয়ালার সাথে আমার পরিচয়ের শুরুটা খুব একটা সুখের ছিলনা। তখন নতুন নতুন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। অনার্সের 'ভাব' আর সদ্য কলেজ পেরুনোর 'কাঁচামি'-এ দুয়ে মিলে জগা খিচুরি অবস্থা। না ঘরকা, না ঘাটকা। শুনলাম নবীনবরণ অনুষ্ঠান হবে ডিপার্টমেন্টে। ইচ্ছে ছিলনা নিজেকে জড়ানোর, কিন্তু যখন দেখলাম ক্লাসের কেউ হাত তুলছেনা- অনেকটা নিজেদের মান বাঁচানোর জন্যই শেষ মূহুর্তে হাত তুললাম। হাততালির হল্লা বয়ে গেল। আর আমি 'নেই বনে শেয়াল রাজা'। রিহার্সাল শুরু হল। আমার গুণের মধ্যে একটাই-অনর্গল নচিকেতার গান গাইতে পারি। সুর হোক আর না হোক-উৎরে যাই। দু'একদিনের মধ্যে টাইটেল পেলাম- 'নচিলাশ'। শুরু হিসেবে খারাপ না। সিনিওর দের সাথে আড্ডা, গান, হল্লা-কেটে যাচ্ছে সময়। এর মধ্যে ভুল করে আমার তবলা বাজানোর প্রতিভাটা দেখাতে গিয়েই পড়লাম বিপদে। মূল তবলা বাদক(সৌমিত্র দা) অনুপস্থিত। আমার ডাক পড়ল। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। একজোড়া তবলা আমাকে দেয়া হল রেয়াজ করার জন্য। কথাটা এতদিন খুব একটা শুনিনি। একদিন হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ একজন বলছে- 'হামজা খুব খুশি হবে'। এই কথাটা এর আগেও শুনেছি, কিন্তু আমলে নেই নি। ব্যাপারটা খুব প্রকট হয়ে দাঁড়াল তখনই, যখন যে কোন অভাব, অভিযোগ, কিংবা উদ্বেগ জানাতে যাই কারো কাছে, সবাই একটা কথাই বলে, হামজা আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কি ব্যাপাররে বাবা! ফেরেশতা নাকি? সত্যি বলতে কি, না চাইতেই এতো গুরুত্ব পেয়ে আমার ভেতর একটা অহংবোধ কাজ করছে। মনে মনে বলি, ওসব হামজা-টামজা আমি মানিনা। কে না কে! খোঁজ নিয়ে জানলাম পক্স হবার কারণে সে আসতে পারছে না, তবে প্রোগ্রামের ৩ দিন আগে থেকে তাকে পাওয়া যাবে। ক্যাম্পাসের সেরা গিটারিস্ট সে। একুয়াস্টিক গিটারে তার তুলনা নাকি সে নিজেই! বাব্বাহ! থোড়াই কেয়ার! চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ি।

সেদিন রাইম ভাই আমাকে বগল দাবা করে নিয়ে গিয়ে বললো, ওই যে লাইব্রেরীর সামনে সাদা টি-শার্ট পড়া যে ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছিস, ওই হামজা। আয় পরিচয় করিয়ে দেই।
-হামজা, ওই পলাশ। তোকে ওর কথা বলেছিলাম।
লোকটা অভদ্র। অন্তত হাতটাতো বাড়াবে! সামান্য ভদ্রতাটাও করতে জানেনা নাকি? আবার ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাচ্ছে! আমি মনে মনে ভাবছি।
আমার দিকে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ তুলে আমাকে দেখছেন জনৈক হামজা। তারপর হঠাৎ-
-পলাশ তোমার কাছে কি ম্যাচ আছে? আমি সিগারেটটা ধরাতে পারছিনা।
আমি একটু চমকে গেলাম। পরিচয়ের প্রথম বাক্য যে ম্যাচ চাওয়ার মধ্য দিয়ে হতে পারে, জানা ছিল না। আসলে আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার পকেটে ম্যাচ ছিল। বাতাস এড়িয়ে একটু কায়দা করে উনার সিগারেটটা ধরিয়ে দিলাম। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে, আগের থেকেও গম্ভীর ভাবে বললেনঃ 'অভ্যাস। ভালো। বুঝলাম, অনেকদিন থেকেই খাও।'

মাঝের সময়টুকু ইতিহাস। এই মানুষটি কিভাবে আমার গানওয়ালা হয়ে উঠলেন-সে গল্প পরে বলব।

চার বছর পরের কথা। হামজা ভাই ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছেন। তার একনিষ্ঠ চ্যালা হিসেবে সারাদিন খুব ব্যস্ত দিন কাটিয়েছি। আর কিছুক্ষণ পরেই তার বাস সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়বে। প্রায় দু'শো লোক এসেছে তাকে সি-অফ করতে। সবার প্রিয় এই মানুষটা চলে যাচ্ছে-সত্যি বলতে কি, কারো মুখেই সেদিন হাসি ছিলনা। প্রিয়জন হারাতে কেউ কি চায়?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি এক কোণে, অন্ধকারে। বাসটা ছাড়লেই কেঁদে ফেলার কিঞ্চিৎ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে, নিজেকে লুকিয়েছি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা বজ্র কঠিন হাত আমার কাঁধ ছুঁলো। বলে দিতে হয়না। আমি জানি, এই হাত কার। এটা আমার গানওয়ালার হাত। ভালোবাসা, শাসন, আশ্বাস, নিশ্চয়তা-অনেক সময়েই এই হাত আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। এই হাতের কাছেই আমি গিটার শিখেছি।
হামজা ভাই বললেন, 'কবি, তোমার কাছে কি ম্যাচ আছে? আমি সিগারেটটা ধরাতে পারছিনা।'
আমি হেসে ফেললাম। পকেটে ম্যাচ ছিল। বাতাস এড়িয়ে একটু কায়দা করে উনার সিগারেটটা ধরিয়ে দিলাম। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে, সেদিনের মতই গম্ভীর ভাবে বললেনঃ 'অভ্যাস। ভালো। বুঝলাম, অনেকদিন থেকেই খাও।'
আমরা একসঙ্গে হেসে উঠলাম।
আমি বললাম, আপনার বাস ছাড়ার সময় হয়েছে। ভালো থাকবেন।
হামজা ভাই আমার কাঁধটা ধরে জোরে একটা ঝাকুনি দিলেন। বললেন, 'কবি, যাচ্ছি। যেতে তো হবেই, তাইনা? না গেলে ফিরব কিভাবে? এসে আমরা দুজন একসাথে বাজাব গিটার। আমরা 'নীলাঞ্জনা' গানটা করবই কেমন?

হামজা ভাইয়ের গাড়ি চলে যাচ্ছে। আর আমার কানে বাজছে হামজা ভাইয়ের কাঁপা কাঁপা কথা গুলোঃ
"যেতে তো হবেই। না গেলে ফিরব কিভাবে?"


ছবিসূত্রঃ আন্তর্জাল
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১১:২৪
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×