somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'মা, তুমিও কি আমাকে মেরে ফেলবে?'

১৩ ই আগস্ট, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

'সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় 'মা' শব্দটি ভীতির কারণ হয়ে উঠছে সন্তানের কাছে। কেন এমন হচ্ছে? সন্তান কেন মায়ের কাছেই বোধ করছে চরম অনিশ্চয়তা? ব্যবচ্ছেদের চেষ্টা করেছেন ফারাহ্ দিবা
'


মা, তুমিও কি আমাকে মেরে ফেলবে?' প্রশ্নটা কিছুক্ষণের জন্য থমকে দেয় হৃৎপিণ্ডের গতি। এ কেমন প্রশ্ন? কেন এ প্রশ্ন? একটু পেছনে চলে যাই। আদাবরের নবোদয় হাউজিংয়ের হুমায়রা আয়েশা এশা ও তাঁর সন্তান শামিউল, জুরাইনের রীতা ও তাঁর দুই সন্তান পাবন-পায়েল, খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের তমা ও তাঁর সন্তান তানহা, মতিঝিলের দক্ষিণ কমলাপুরের বিলাসী এবং তাঁর দুই সন্তান রজনী ও রায়হান।
সর্বশেষ দুই বছরের কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে বনানী রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন তেজগাঁও কুনিপাড়ার মাকসুদা। ঘটনার বিবরণের কোনো প্রয়োজন নেই জানি। কারণ, সাম্প্রতিক এ নামগুলো ভুলে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবে প্রকারভেদ করা যায়। দুজন মা_রীতা ও বিলাসী স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এবং সন্তানকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে যাওয়ার ভরসা করতে না পেরে সন্তানসহ আত্দহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। বাকি দুজন মা গোপন, সম্পর্কের কারণে বলি দিয়েছে তাঁদের সন্তানকে।
মায়ের কোল সন্তানের জন্য নিরাপদতম স্থান। অস্থির, বিপদসংকুল এ পৃথিবীতে যখনই কোনো সন্তান ভয় বা আঘাত পেয়েছে, মাকেই আশ্রয় করেছে। জীবন সায়াহ্নেও তীব্র মনঃকষ্টে মানুষ ফেলে আসা মায়ের কোল খোঁজে। যেন দুই হাতে আগলে মা তাঁর সন্তানকে দেবেন নিরাপদ পৃথিবী। কিন্তু ওপরের নামগুলো কি প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয় না এই চিরন্তন সত্যকে? এত দিন বাবাদের নিষ্ঠুরতার কাহিনী শোনা গেছে অনেক। আজও রয়েছে এ নিষ্ঠুরতা। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মায়েরাও। তবে কি মায়েরা বাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন নিষ্ঠুরতায়?
সন্তানরা তাহলে কার কাছে নিরাপদ? কেন এ উন্মত্ততা? নিষ্পাপ শিশুর হাসি, ছোট্ট নরম হাতে মাকে জড়িয়ে ধরা, আধো বোলে, সুরেলা কণ্ঠে 'মা' ডাক_কিছুই কি আর মায়ের মনকে আর্দ্র করে না? নিজের গর্ভজাত সন্তানের হত্যাকারী কিভাবে হয় মা? বিশ্লেষণ তো দূর, জবাবও মেলে না। জবাব খুঁজি অন্য মায়েদের কাছে। মোহাম্মদপুর গার্লস প্রিপারেটরি অ্যান্ড হাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার বলেন, 'পুরুষদের নিষ্ঠুরতা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু মেয়েরাও অসহনশীল হয়ে পড়েছে। বোধ হওয়ার পর থেকেই একজন মেয়েকে সহনশীলতার শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তাকে শেখাতে হবে, একজন মেয়ে যখন মা হবে, তাকে স্বামীর নির্যাতন এবং পৃথিবীর সব সমস্যা জয় করার শক্তি অর্জন করতে হবে। স্বামীর সঙ্গে সহাবস্থান সম্ভব না হলে দূরে সরে যাক। কিন্তু তার ওপর রাগ করে নিজের এবং সন্তানের ক্ষতি করা হেরে যাওয়ার নামান্তর। পুরুষকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। ূগঠনমূলক চিন্তা এবং আত্দমর্যাদা অর্জন করতে হবে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, সামনে আরো ভয়ঙ্কর দিন আসছে। এগুলো বন্ধ করতে হলে শাস্তি প্রদান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন পুরো নারীসমাজের সামগ্রিক মোটিভেশন।'
যে নারী নিজ সন্তানের হত্যাকারী, তাকে কি মা বলা যায়? এই পাশবিকতার শিকড় কত গভীরে? আজিমপুরের গৃহবধূ পাপিয়া বলেন, 'আমি নির্বাক। টেলিভিশনের খবরে শামিউলের লাশ দেখে আমার ছোট্ট ছেলের চোখে যখন আতঙ্ক দেখি, বুক কেঁপে ওঠে। অবুঝ প্রশ্ন_ওর কী হয়েছে আম্মু? কোনো উত্তরই দিতে পারি না। কী বলব? আমি অতি সাধারণ মা। সন্তানের মঙ্গল চিন্তায় কত কী চুপচাপ সহ্য করেছি। এসব কী ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের বাচ্চারা এসব দেখে বড় হচ্ছে। কিভাবে মানুষ করব ওদের?' ঘরে ঘরে এমন প্রশ্ন অনেক আছে। কিন্তু সমাধান বা ঘটনার বিশ্লেষণ নেই। বাচ্চাদের ওপর এসব ঘটনার যে প্রভাব পড়ছে, তা আরো ভয়াবহ। মা-বাবাকে ঝগড়া করতে দেখলেও তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। এমনকি দুষ্টুমি করলে মায়ের শাসনেও তারা আতঙ্কিত, সাম্প্রতিক একটা খবরে এ ভয়াবহতা প্রকাশ পেয়েছে। একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা মা এবং ব্যবসায়ী বাবার দাম্পত্য কলহে আতঙ্কিত হয়ে মেয়ে মাকে প্রশ্ন করেছে_'মা, তুমিও কি আমাকে মেরে ফেলবে?' অধিকাংশ হত্যার পেছনে কারণ হিসেবে রয়েছে পরকীয়া প্রেম। কখনো মায়ের, কখনো বাবার। এ সম্পর্কগুলোর কারণ খতিয়ে দেখতে গেলে বেরিয়ে আসবে দাম্পত্য জীবনের অনেক অন্ধকার। কে দায়ী, পুরুষ না নারী? এ প্রশ্ন এখানে অবান্তর। উভয়েরই ভেবে দেখার সময় এসেছে, আমাদের আচরণগত সমস্যা সভ্যতা, সমাজ, সর্বোপরি আমাদের সন্তানদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে।

প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা

শিশুদের এ আতঙ্কের জন্য গণমাধ্যমও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। যতটা নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটে, ততটা নৃশংসতার সঙ্গে গণমাধ্যমগুলো তা প্রকাশ করে। এ ব্যাপারে এটিএন বাংলার সংবাদ বিভাগের প্রধান জ. ই. মামুন বলেন, 'এটা আসলে গণমাধ্যমগুলোর ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতার ব্যাপার। খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য এভাবে বিস্তারিত দেখাতে হবে, এটা ঠিক নয়। আমেরিকার টুইন টাওয়ার বিপর্যয়ে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। কিন্তু কোনো খবরে একটা লাশও দেখানো হয়নি।
এ খবর কি মানুষ বিশ্বাস করেনি? অথচ আমাদের বিডিআর হত্যাকাণ্ডে কত বীভৎসভাবে লাশগুলো দেখানো হয়েছে। সাম্প্রতিক এসব শিশুহত্যার খবরের ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি_আমরা বীভৎসভাবে দেখাইনি। আসলে বর্তমানে সাংবাদিকদের রয়েছে সুশিক্ষার অভাব। গণমাধ্যমগুলো তাদের স্বাধীনতা কতটুকু কাজে লাগাবে, এ ব্যাপারে সরকারের কঠিন নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। এখনই সচেতন না হলে সমাজব্যবস্থায় যে ধস নামবে তার জন্য আমরাই দায়ী থাকব। এ দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।'

মনোবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ

পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্লেষণযোগ্য। পশু-পাখির মধ্যেও সন্তানের জন্য ভালোবাসা রয়েছে। মানুষের মধ্যে নেই তা নয়। কিন্তু যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তাতে মনে হচ্ছে মানুষ ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা হারাতে বসেছে। চূড়ান্ত বিকৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। একাত্তরেও জন্মেছে লাখো যুদ্ধশিশু। মায়েরা তাঁদের স্বীকৃতি দিতে পারেননি। কিন্তু মেরে ফেলেননি। অথচ সামান্য সংসারের অশান্তি সহ্য করতে না পেরে মায়েরা কিভাবে এমন করছেন? এ নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ কী? "আগে বিদেশি নিউজ চ্যানেল খুললেই এমন সব নৃশংস খবর পাওয়া যেত।
তখন মনে মনে ভাবতাম, অন্তত আমাদের দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই। আজ সেই শান্তিটুকুও বিলীন। আমরা মনোবিজ্ঞানীরা অনেক আলোচনা করেছি। অনেক কারণই পেয়েছি। কিন্তু মনে হয়েছে, সঠিক জায়গাটা ধরতে পারছি না। প্রচণ্ড মানসিক স্ট্রেস থেকে নিউরোলজিক্যাল অনেক সিমটম দেখা দেয়। ডাক্তারের কাছে গেলে কোনো কারণ ধরা পড়ে না। ফিজিওলজিক্যাল ডিজঅর্ডারের কারণে ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে দেখা যায় কনভারশন ডিজঅর্ডার। কোনো কারণে সঙ্গীকে পছন্দ না হওয়া, বনিবনা না হওয়া, শারীরিক অতৃপ্তি_এমন আরো অনেক কিছু মিলে স্বামী বা স্ত্রী যে কারো মনে অন্যের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে পারে, মানসিকভাবে নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে। এ থেকেই সব অশান্তির শুরু। সমাধানের চেষ্টা না করে আমরা এটাকে বাড়িয়ে তুলি। একসময় স্বামীর ওপর রাগ করে মেয়েরা নিজেকে এবং সন্তানকেও হত্যা করার মতো পাশবিকতা করছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে 'স্যাকটিশিয়াস ডিজঅর্ডার'ও বলে।" বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরীন ওয়াদুদ।
তিনি আরো বলেন, এ সমস্যাগুলো যাতে না বাড়ে এবং এর ক্ষতিকর প্রভাব যেন শিশুদের ওপর না পড়ে সে দায়িত্ব আমাদেরই। খবরগুলো প্রচারের আগে টেলিভিশন কর্র্তৃপক্ষের উচিত সতর্কবাণী প্রচার করা যে 'শিশু ও দুর্বল হৃদয়ের মানুষের না দেখাই ভালো।' এটা দায়িত্বশীল সব দেশেই ঘটে। শুধু আমাদের দেশে এর প্রয়োগ নেই। মা-বাবার দায়িত্ব সন্তানকে টেলিভিশনের সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাদের বোঝানো যে এগুলো মানসিক অসুস্থতা ছাড়া কিছুই নয়। সমস্যা যখন শুরু হয় তখনই মনোচিকিৎসকের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কাউন্সেলিং করা উচিত। প্রয়োজনে চিকিৎসাও করতে হবে।


সৌজন্যে কালের কন্ঠ
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীবাদ, ইসলাম এবং আইয়ামে জাহেলিয়া: ঐতিহাসিক ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

লিখেছেন মি. বিকেল, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৪



আইয়ামে জাহিলিয়াত (আরবি: ‏جَاهِلِيَّة‎) একটি ইসলামিক ধারণা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী আরবের যুগকে বোঝায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়কাল ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×