১
কুত্তার লুল হারাম, জানস না? – বলে করিমন চেঁচায়। যা, এই নাপাক জন্তু ফালাইয়া দিয়া আয়।
পাঁচ বছরের সন্তান কালাইম্যা ইতিমধ্যে কুকুরের বাচ্চাটাকে ভালবেসে ফেলছে। সে ফেলতে চায় না। সে লুকিয়ে লুকিয়ে তার পাতের ভাত সঞ্চয় করে। কুকুরছানাটাকে খেতে দেয়। বাচ্চাটার ছোট মুখ। কুচ কুচ করে খায়।
করিমন ব্যস্ত থাকে। নৌকার ছইয়ের মতো বস্তির ঘরটায় কালসিটে ভাব, দুপুরে প্লাস্টিক পোড়ানো গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে যায়। পাশের গার্মেন্টসের ঝুট সস্তায় কিনে সবাই এসব দিয়ে রান্না করে। করিমন প্রথম যখন গ্রাম থেকে আসে তখন তার বমি আসতো। কিন্তু গরীবদের নাক খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়। তার স্বামী মিল্লাতবাম ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। করিমনেরও বাসা বাড়ির কাজ দরকার। খুঁজছে। এই বস্তির আগে সে আগারগাও ছিল। পুলিশ উচ্ছেদ করার পর একমাস ধরে খিলগাঁও তালতলাতে।
করিমনের ঘরে একটা আয়না ঝোলানো। বড় চিরুনী। বায়ু চড়ার কদুর তেল, পাউডার, স্নো। এই প্রসাধন এবং আসবাব নিয়ে তার সংসার। নিচে বিছানো তেলচিটচিটে কাঁথা। সেখানে টিনের থালায় কালাইম্যা খায়।
করিমন ঘরের বাইরে থেকে মাছের সালুনের ডেকচিটা ভিতরে আনে। ছালুনের গন্ধে চারদিক ছেয়ে যায়।
কালাইম্যা শান্ত ছেলে। দরকারের বেশী খায়না। আজকে সে বলে, আম্মা আইজকা বড় খিদা লাগছে। একটু মাসের সালুন দিবা? তার মা দুপুরে মাছ দেয় না। মসুরীর ডাল আর ভাত দিয়ে দুপুর চলুক। কালাইম্যার বাপ আসলে রাতের বেলা সবাই মাছ ভাত খাবে।
ছেলেটার কথায় তার মায়া লাগে। সে শোল মাছের লেজের ছোট টুকরা ভেঙে ছেলেটার পাতে দেয়। ছেলেটা গোপনে মাছটা রেখে দেয়।
এই, খাওয়া শেষ অইছে? অইলে ঘুম দে। আর কুত্তাটা ছাইড়া দে। এইডা দেখলে তোর বাপ ক্ষেপবো।
কালাম্যা হু করে। একটু পরে কুত্তাটাকে বাইরে নিয়ে তার জামার ভাঁজ থেকে শোলমাছের খন্ড খেতে দেয়। এমন স্বাদের মাছ কুকুর ছানাটা আগে খায়নি মনে হয়। সে আহ্লাদে কেউ কেউ করে।
২
বস্তির উল্টাদিকের ঘরে অল্পকিছুক্ষণ পরেই কান্নার রোল ভেসে আসে, আল্লারে, কী করলা রে, মইন্যার বাপরে, তুমি কই গেলা রে.।ও খোদারে আমারে কেউ নাইরে। করিমন চোখটা একটু বন্ধ হয়েছিল। সে উঠে দৌড় দেয়। গিয়ে দেখে মইন্যার বাপ বেহুশ। মুখে ফেনা। সে ভয় পায় কিন্তু মইন্যার মার হাত চেপে ধরে, আফা, দেরী করন যাইবো না। তারপর দৌড়ে একটা রিক্সা যোগাড় করে হাসপাতালে নেয়। পাশের ঘরের হুসনার কাছে সে রেখে যায় কালাইম্যাকে
মেডিকেল হাসপাতালে পৌছানোর পর, মইন্যার বাপকে বারান্দায় ফেলে রাখা হয়। বাতাসের দমকায় হঠাৎ হুঁশ আসে মইন্যার বাপের। সে তখনো মরে নাই কিন্তু শুধু অস্পষ্ট শব্দ করতে থাকে। করিমন কোন দিন হাসপাতালে আসে নাই। অস্থির থাকে। কেউ তাদের কে ভিতরে নেয় না। করিমন গিজগিজ মানুষের ভীড়ে দৌড়ে যায়, এক সাদা এপ্রন পরা লোককে বলে, ডাক্তর ভাইজান, আমগো খুব বিপদ, ভাইজানরে একটু বাঁচান। ডাক্তার চশমার ফাঁকে এক দৃষ্টিতে দেখে বলে, ঠিক আছে অপেক্ষা করেন। লোক আসবে ।বলে গট গট করে চলে যায়।
তার পর আধাঘন্টা আর কোন খোঁজ নাই। বারান্দায় ভো ভো মাছি ঘুরে। মইন্যার বাপ খিঁচতে থাকে থেমে থেমে । মইন্যার মা সেইখানে উপুর হয়ে আছড়ে পড়ে। করিমন এমন সময় এক ডাক্তারকে আসতে দেখে। ডাক্তারের সামনে তখন বিরাট ভীড়। করিমন ভিড় ঠেলে চিৎকার করে। একজন প্রহরীর মতো লোক তাকে সর সর করে দুরে সরিয়ে দেয়।
মইন্যার বাপের চোখ একটু খুলেছিল। কিন্তু এখন টকটকে লালটা দুর্বল হয়ে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ডাক্তারটা মনে হয় অনেক বড় কেউ। সে থপ থপ করে কাছে এসে নুয়ে পড়ে ।আরো কয়েকটা রোগী বারান্দায়। ক্রমানুসারে দেখতে দেখতে মইন্যার বাপের দিকে নজর দেয়। তারপর মইন্যার বাপের অবস্থা দেখে গম্ভীর ভাবে বলে, এখুনি তার ব্লাড টেস্ট লাগবে। আপনি মেডিএইড ডায়গনস্টিক্সে ল্যাবে যান। ধানমন্ডী ৩ নম্বরে। তারপর ফোনে মেডিএইডকে বলে দেয়, হ্যালো, একজন পেশেন্ট কে পাঠাচ্ছি। যা যা লাগে করবেন। বিলের কপি পাঠাবেন।
করিমন বলে ওঠে, ডাক্তর সাব উনি মনয় বাঁচবোনা। আল্লার দুহাই তারে এইখানে রাইখ্যা কিছু করেন। আর আমগো পয়সা নাই। ডাক্তার .হুম করে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর এক জুনিয়র ডাক্তার এসে তাকে জায়গা খালি করতে বলে। হাসপাতালের বাইরে বারান্দায় রোগী রাখার নিষিদ্ধ। মইন্যার মা ডাক্তারের পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে, আল্লাগো, আপনেরা আমার সোয়ামীরে বাঁচান। ডাক্তার বলে, ছাড়ুন পা। যত্তসব।
কিছক্ষণ পর মইন্যার বাবা মৃত্যু নিশ্চিত হয়। এক সহৃদয় ডাক্তার লাশ সরানোর তদারিক করতে করতে বলে ওঠে, উনি তো সিরিয়াস পেশেন্ট, ঠিক মতো না খেয়ে ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছিলেন। শেষ টাইমে এনে কী লাভ। আমরা সরি। উইকুডন্ট ডু এইথিং।
মইন্যার মা এখন চিৎকার করে গালি দিচ্ছে। তার আর কোন সম্বল নাই।
৩
বস্তিতে মৃত্যুর ছায়া। মইন্যার বাপের লাশ দাফন হয়েছে। মইন্যার মার চারপাশে সব মহিলারা। হায়াত মউত সব উনার ইচ্ছা। সেই কথাটা তাকে বোঝাচ্ছে।
হঠাত্ কালাইম্যা অবুঝের মতো বলে, আম্মা, চাচায় কেমনে মরছে? আল্লায় নিছে?
করিমন মুখ সামলাতে না পেরে বলে, ঐ কুত্তার বাচ্চাগো লাইগ্যা আইজকা মানুষটারে বাঁচান গেলো না।
৪
কালাইম্যা কিছুতেই মায়ের কথাটা বুঝতে পারে না। তার কুত্তার বাচ্চাটা কিন্তু অনেক লক্ষী, ভাত খাওয়ার পর তার পিছন পিছন এসেছে। অনেক সুন্দর করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কেউ কেউ শব্দ করেছে। তাহলে কি এমন কুত্তার বাচ্চা আছে যারা মানুষ কে মেরে ফেলে?