somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিমালয়ের দেশ নেপাল

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হিমালয়ের দেশ নেপাল

মিজান রহমান

‘‘দেশে দেশে কত না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মর“,
কত না অজানা জীব, কত না অপরিচিত তর“
রয়ে গেল অগোচরে।’’
ভ্রমণের নেশা মানুষের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আদিমকালে মানুষ যে যাযাবর জীবন যাপন করত তার প্রভাব থেকে তখন মানুষ রেহাই পায়নি। আর সে কারণেই পৃথিবীর বিচিত্র রহস্য জানার জন্য মানুষ হয়ে উঠেছে ভ্রমণবিলাসী। স্রষ্টা এই বিশাল পৃথিবীকে বিচিত্র সৌন্দর্যে বিভূষিত করে রেখেছেন। মানুষ একটি সংকীর্ণ সীমানায় আবদ্ধ থেকে তার কিছুই জানতে পারছে না, অথচ তার মনে আছে চোখকে তৃপ্তি দেয়ার অনন্ত আকাক্সক্ষা।
এমনি এক আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের শুর“র সেদিনের প্রথম প্রহরটা ছিল আনন্দের। আকাশে ছিল পরিষ্কার নীল মেঘের ভেলায় ভরপুর, ছিল না কালো মেঘের আবির্ভাব, রোদের খেলায় মেতে ছিল পুরোটা আকাশ। আকাশের টুকরো টুকরো মেঘগুলো হাটুটু খেলছে। এই মেঘের ফাঁকে সূর্য উঁকি দি”েছ বার বার। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা আবার গরম। প্রকৃতিতে যেন চলছে হিমশীতলের খেলা। এমনি এক সময় যেন আমাদের বিমানটি (বাংলাদেশ বিমান) আকাশে উড়তে শুর“ করল। মনে হয় যেন কোনো অজানা গন্তব্যে যা”িছ। আসলে অজানা গন্তব্য নয়। আমাদের জানা গন্তব্যেই যা”িছ আমরা। বেশ কয়েক মাস ধরে ভাবছিলাম আবারও যদি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেতাম তা হলে এবার ভ্রমণটা আনন্দে ভরে দিতাম। এর আগে যতবার বিদেশে গিয়েছি তখন সময়গুলো ছিল টাইট কোথাও ঘোরার বা যাবার সুযোগ পাইনি। এবার হাতে সময় করে নিবো এবং ঘুরবো এ ছিল আমার পরিকল্পনা। সে মোতাবেক বছরের গোড়ার দিকে আমি এবার ইউএনআই (ইউনিয়ন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল)-এর আমন্ত্রণে নেপাল যা”িছ। আমার আর এক বড় ভাই (মিডিয়া ব্যক্তিত্ব) আমাকে যাবতীয় বিষয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। প্রথমে বিশ্বাস হ”িছল না, পরে যখন বিমানের টিকেট আমার হাতে এসে পৌঁছল তখন যাওয়ার সমস্ত পরিকল্পনা এবং গোছগাছ দু’একদিনের মধ্যে সেরে ফেললাম। যেহেতু ট্রেড ইউনিয়নের আমন্ত্রণে যা”িছ সে হিসেবে আমি আমার ইউনিয়নের কাগজপত্র এবং ট্রেনিং সংক্রান্ত কিছু সাপোর্টিং পেপার সংগ্রহ করি। যথাসময় আমরা বাংলাদেশ থেকে তিনজন নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুতে পৌঁছে যাই। নেপাল যেতে বেশি সময় লাগে না, ঘণ্টা তিনেক জার্নি। নেপাল ভ্রমণের আগে বন্ধু-বান্ধবের কাছে শুনেছি নেপালকে নাকি হিমালয়ের কন্যা বলা হয়। নেপাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যেই রওয়ানা করলাম তখনই মনে পড়ছে সেই কথা, তবে প্রমাণ পেলাম না হিমালয় কন্যা বলা হলো কেন। অবশ্য পরে তার প্রমাণ পেয়েছি। নেপাল পৌঁছে সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমরা পাঁচ তারকা হোটেল ক্রাউন প্লাজায় উঠলাম, অবশ্য আগ থেকেই আমাদের হোটেল বুকিং ছিল। নেপালী ট্রেড ইউনিয়ন সং¯’া আমাদের হোটেল বুকিংয়ের দায়িত্বে ছিল। আমাদের ওয়ার্কশপটি শুর“ হওয়ার আগের দিন নেপালে পৌঁছে যাই। সে অনুযায়ী অন্যরাও হোটেলে এসে পৌঁছেন। সার্ক দেশের ওয়ার্কশপ, সবাই বলতে গেলে বাংলাদেশীদের কথা জানেন বা শুনেছেন। আমার আগ থেকেই ভাবনা এবারকার ভ্রমণে কিছুটা আনন্দ করবো এবং কিছু এলাকা ঘুরবো। সে মোতাবেক আমি নেপালি দুই বন্ধুর সঙ্গে ভাব করলাম। বন্ধুটি নেপালি টেলিকমিনিকেশনে কাজ করেন নাম টংকা প্রসাদ হোমাগাইন ও সুনিল সাপকোটা। তাদের আমার হোটেল র“মে আমন্ত্রণ জানালাম। টংকা আমাদের র“মে এসেছিলেন, সাপকোটা আসেননি তার ব্যস্ততার জন্য। তিনি আবার হিমালয় ব্যাংকের কর্মকর্তা। আমাদের প্রতিদিনকার ওয়ার্কশপ শুর“ হয় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। ৫টার পর ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণকারীরা সবাই নেপালকে দেখতে ও ঘুরতে বের হয়। আমার বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। আমরা ঢাকা থেকে যে তিনজন গেলাম তারা এক সঙ্গেই বের হই। তবে বন্ধু হোমাগাইন প্রতিদিনই রাতে আমার র“মে আসেন। তার কাছ থেকে নেপালের টুকিটাকি সব খবর ইতোমধ্যে জেনেছি। তার কাছ থেকে পাওয়া এবং আমার ভ্রমণ সূত্র থেকে জানা নেপালের কিছু তথ্য পাঠককে না জানালেই নয়।
এবার আসল কথায় আসা যাক, তবে তার আগেও নেপাল সম্পর্কে কিছু ভূমিকা না দিলে নয়।
নেপাল শব্দের সঠিক উৎপত্তি এখনো জানা যায়নি, তবে সকলের মত অনুসারে নেপাল নামটির দু’টি শব্দ যেমন নে এবং পাল। নে থেকে এসেছে পবিত্র আর পাল থেকে এসেছে গুহা। তা হলে নেপাল অর্থ দাঁড়ায় পবিত্র গুহা।
নেপালের পেছনের ইতিহাস ঘাটলে যা জানা গেছে, নেপালের একটি ঐক্যবদ্ধ রাজ্যরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ১৭৬৮ সালে। ১৮১৫-১৬ সালে আ্যংলো-নেপাল যুদ্ধের শেষে নেপাল বৃটিশ রক্ষণাধীন বাফার স্টেট হয়। রাজা থাকলেও ১৮৪৬-১৯৫১ সাল পর্যন্ত নেপাল ছিল প্রবল প্রতাপশালী ভূস্বামী রানারদের শাসনাধীন। ১৯২৩ সালে বৃটেন নেপালকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি জানায়। ১৯৫১ সালে নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রজা বিদ্রোহের ফলে রানাশাহির অবসান হয়, রাজতন্ত্র ফিরে আসে। রাজা হন দেশের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান, বৃটিশ ধাঁচে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম হয়। ১৯৬০-৬১ সালে রাজা মহেন্দ্র রাজতন্ত্র বাতিল করে চরম রাজতন্ত্র কায়েম করেন, সংসদ বাতিল হয় ১৯৯১ সালে প্রজা আন্দোলনের ফলে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে। রাজা বীরেন্দ্র হন দেশের প্রধান।
প্রশাসন ও সংবিধানের দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায়, দেশ শাসিত হয় ১৯৯০ সালের ৯ নভেম্বর প্রবর্তিত সংবিধান অনুসারে। রাজা হন দেশের প্রধান। জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রিসভার হাতে দেশের শাসনভার। দ্বি-কক্ষ জাতীয় সংসদ-উ”চকক্ষ হাউস অব কাউন্সিল, নিুকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ। নিুকক্ষ সদস্য সংখ্যা ২০৫, পার্লামেন্ট সদস্য সংখ্যা ৬০১। প্রধান রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেস, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী), ইউনাইটেড মার্কসিস্ট, সদ্ভাবনা পার্টি, মধেসী জনাধিকার ফোরাম, তরাঈ মধেসী লোকতান্ত্রিক পার্টি এছাড়াও কয়েকটি আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি রয়েছে নেপালে।
বর্তমানে নেপাল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। দেশটির প্রধানমন্ত্রী গত ৩০ জুন ২০১০ তারিখ প্রেসিডেন্ট রামবরণের কাছে পদত্যাগপত্র দেন, তবে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, নয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই কাজ চালিয়ে যাবেন। দেশটির আয়তন ১৪০৮০০ বর্গ কি.মি.। জনসংখ্যা ২৪ মিলিয়ন, নেপাল উন্নয়নশীল দেশ, এর রাষ্ট্রীয় নাম ফেডারেল প্রজাতন্ত্র অব নেপাল, প্রধান শহর কাঠমাণ্ডু, প্রধান প্রধান গোষ্ঠী হিন্দু, গুরং, মাগার, তামাং, ভোটিয়া, রাই, লিম্বু ও শেরপা। ভাষা নেপালী, এছাড়াও হিন্দি, লুম্বিনি, মান্দারীসহ ইংরেজি প্রচলন রয়েছে। বেশিরভাগ লোক হিন্দু। কাঠমাণ্ডু প্রাচীন শহর ও হিন্দুদের তীর্থ¯’ান। নেপালে বিশ্বের বিখ্যাত বিখ্যাত উঁচু পাহাড় রয়েছে। পাহাড় বেষ্টিত দেশ এটি। পৃথিবীর ১০টি সর্ববৃহৎ পাহাড়ের মধ্যে নেপালেই ৮টির অব¯’ান। নেপালিরা পাহাড়কে দেবতাতুল্য মনে করেন। সীমানার হিসাব করলে দেখা যায়, ভারতের উত্তরে, ভারত ও চীনের মধ্যে অব¯ি’ত পর্বতময় দেশ। এর দক্ষিণে গঙ্গা। নেপালের মুদ্রার নাম নেপালিজ রূপি তবে ভারতের রূপির সমাদর এখানে লক্ষণীয়। দেশের বিখ্যাত পাহাড়গুলোর মধ্যে কয়েকটি উ”চতাসহ-ঊাবৎবংঃ -২৯০২৮ ংভ, কধহপযবহলঁহমধ-২৮১৭৯ংভ, খযড়ঃংব২৭৮৯০ংভ, গধশধষঁ-২৭৭৬৫ংভ, ঈযড়-ড়ুঁ-২৬৯০৬ংভ, উযধঁষধমরহ-২৬৭৯৪ংভ, গধহধংষঁ-২৬৭৫৬ংভ, অহহধঢ়ঁৎহধ-২৬৫৪৫ংভ. যারা বেড়াতে যাবেন তাদের জন্য নেপালে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় ও তীর্থ¯’ান রয়েছে যেমন-এভারেস্ট (পৃথিবীর সর্বো”চ পর্বতশৃঙ্গ), পশুপতিনাথ মন্দির, অন্যপুন্যা, পোখরা, গোল্ডেন গেট, বাকতাপুর দরবার স্কোয়ার, বুদ্ধনাথ মন্দির, হনুমান দোকা, চুং নারায়ন মন্দির, কাঠমাণ্ডু স্কোয়ার, সম্ভুনাথ মন্দির, বিরগঞ্জ, লুম্বিনি, নেপালিজং, পাটনা ইত্যাদি। এছাড়াও অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে সেগুলো ভ্রমণের বেশ সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও নেপালী ট্যুরিজম অনেকগুলো অফার দেয় পর্যটকদের যেমন-অফাবহঃঁৎব ঃড়ঁৎ, ঈঁষঃঁৎব ঃড়ঁৎ, ডরষফষরভব ঃড়ঁৎ, ঘবঢ়ধষ ঃৎধাবষ চধপশধমব, ঘবঢ়ধষ ঠধপধঃরড়হং চধপশধমব বঃপ.
প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ মেচী অঞ্চল, কোশী, সগরমাথা, জনকপুর, বাগমতী, নারায়ণী, গণ্ডকী, লুম্বিনী, ধরলাগিরী, রাপ্তী, কর্ণালী, ভেরী, সেতী ও মহাকালী অঞ্চল বিখ্যাত।
এতো নেপালের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা গেল। তাদের সংস্কৃতি ও নিজস্ব কিছু কালচার সম্পর্কেও ধারণা নেয়া উচিত। যেমন নেপালের সাধারণ খাদ্য তালিকায় রয়েছে- ভাত, মাছ, ডাল, তরকারি আচার বা চাটনি। নেপালীদের বছর শুর“ হয় মধ্য এপ্রিলে। নেপালের সাপ্তাহিক ছুটি শনিবার। এ দেশে নেয়ারী সঙ্গীতে ঐকতান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহƒত হয়, অধিকাংশই বাজাতে হয় ঘষে ঘষে, তবে বাঁশি ও বাঁশি জাতীয় আরও কিছু বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র খুব কম ব্যবহƒত হয়। নেপালী লোকসঙ্গীতের বেশ কদর রয়েছে। চিরায়ত লোকগল্পগুলো মূলে রয়েছে বাস্তবতা, প্রেম-ভালবাসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দানব-দেবতার মধ্যদিয়ে প্রকাশ পায় প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতি।
যারা নেপালের ভ্রমণে যাবেন তাদের জন্য বিষয়টি জেনে রাখা ভালো। আমরা নেপালে ভ্রমণ করি ওয়ার্কশপে অংশ নেয়ার সুবাধে, সেহেতু হাতে তেমন কোনো সময় ছিল না, যা সময় পেয়েছি তা কিš‘ কাজে লাগিয়েছি। বিমানে নেপাল যখন যাই তখন বিমানে বসেই নেপালের এক বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়। তাদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলি। এক পর্যায় তাদের কাছে আমাদের বিস্তারিত ভ্রমণের বিষয় বলি। ঐ নেপালী বাসিন্দারা ঢাকাকে ভালোভাবে চেনেন, তাদের আপন একজন ঢাকার আরআরআইতে গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। সুতরাং ঢাকায় তারা বহুবার আসছেন এবং থেকেছেন। যাক সে কথা। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে একদিন তারা হোটেলে এসে হাজির, তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সত্যি সত্যি তাদের বাসায় গেলাম। রাতের খাবার খেলাম। ঢাকার মতো আপ্যায়ন, সব দেশেই অবশ্য ভালো মানুষ আছেন তারাও হয়তো তাই। না হলে আমাদের আর হোটেল থেকে তাদের বাসায় নিয়ে যেতেন না। এতে প্রমাণিত যে সব দেশেই আতিথেয়তার ঐতিহ্য রয়েছে। মেহমান বাসায় গেলে কী করতে হয় তা সকলের জন্যই সমান। আমরা তাদের বাসায় আড্ডা মেরে রাতেই আবার তাদের গাড়িতে করে হোটেলে পৌঁছাই। নেপালের স্মৃতির অনেকটা অংশ তাদের জন্যই তৈরি হয়েছে যা অনেক দিন মনে থাকবে। শহর ঘুরে দেখলাম, আমাদের দেশের মতো ওখানকার মার্কেটগুলো। চেইন মার্কেটও রয়েছে। দাম অবশ্য ঢাকার তুলনায় বেশি। খাবার দাবারেরও দাম রয়েছে তবে এক কথায় ঢাকা শহরে যেমন ঠিক তার চেয়ে মনে হয় যেন একটু বেশি। যদি কেউ ভারত গিয়ে থাকেন তা হলে বুঝতে পারবেন ভারতের চেয়েও মনে হয় দাম একটু বেশি। দোকান পাট, হোটেল, মার্কেট সবগুলো ঢাকার মতো। রাস্তায় অর্থাৎ ফুটপাতের দোকানও রয়েছে অনেক। মাছ, সবজি, মাংস, কাপড়, শুকনো খাবার সবই যেন হাতের কাছে, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। তবে একটু সাবধান- যারা যাবেন তারা পান খাবেন চিন্তা করে। নেপালে পান খেতে ৮/১০ নেপালী র“পির প্রয়োজন। রাতে বেশির ভাগ নেপালী র“টি খান। র“টি সব হোটেলেই পাওয়া যায়। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় ওয়াইন অর্থাৎ এ্যালকোহল জাতীয় সব পানীয় প্রায় দোকানেই বিক্রি হয়। খাবার পর বা কেউ আয়েস করে যে কোনো দোকান এমনকি চায়ের দোকানেও আপনি এ্যালকোহল জাতীয় পানীয় খেতে পারবেন। নেপালে আরও একটি বিষয় লক্ষ করেছি তা হলো- নারীরা এখানে দোকান চালনাসহ অন্যান্য কাজ করেন। রাস্তায় মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল চালাতে দেখা গেছে অনেক নেপালী তর“ণ-তর“ণীদের। তবে একটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি তা হলো রাজধানী কাঠমাণ্ডুকে দেখলে বোঝা যায় সে দেশটির সার্বিক পরি¯ি’তি। উন্নয়নশীল এবং গরিব দেশ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একটা কথা না বলেই পারছি না, উন্নয়নশীল ও গরিব দেশ সত্যি কিš‘ তাদের জীবনযাত্রার মান বেশ ভালোই মনে হলো। জিনিসপত্রের দামও একটু বেশি। তারা কিš‘ জানে যে, পর্যটনের শহর নেপাল তাই পর্যটক দেখলেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। আমাদের দেশের অনেক পর্যটক যান ট্রানজিট প্যাচেঞ্জার হিসেবে। কেউ কেউ উন্নত বিশ্বে যাবার আগে নেপালের টুরিস্ট ভিসা লাগান তাদের ভিসা পাওয়ার সুবিধার জন্য এ বিষয়গুলো নেপালী দূতাবাস জানে। সে দেশে ভিসা দেয়া হয় দু’ভাবে যেমন- ঢাকা থেকে যারা নেবেন তারা গুলশানের নেপালী দূতাবাসে গেলেই যে দিন পাসপোর্ট জমা দিবেন তার পরের দিন ভিসাসমেত পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দেন। প্রথমবার ভিসার জন্য কোনো ফি দিতে হয় না, অন্যদিকে আরেকটি কথা বিমানের টিকেটের দাম আসা-যাওয়া ১৪ হাজার টাকার মতো। এবার টিকেট কিনে নেপালের এয়ারপোর্টে বসেও ভিসা নিয়ে প্রবেশ করার সুযোগ রয়েছে। এক কথায় নেপাল যেতে কোনো কড়াকড়ি নেই, যে কেউ অল্প কিছু কাগজপত্র যোগাড় করেই নেপাল যেতে পারেন। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে নেপালে মানুষ ভ্রমণে আসেন তার একটাই কারণ হিমালয় পর্বত দেখার জন্য। অনেকের সে আশা পূরণ হয় আবার কারো কারো হয় না। কাঠমাণ্ডু থেকে হিমালয় পর্বত ২০০ কি. মি. দূরে, যেতে সময় লাগে ৬ ঘণ্টার মতো। যেতে লোকাল গাড়ি বা নিজস্ব গাড়ি ব্যবহার করা যাবে, নিজস্ব বলতে রেন্ট-এ কারের গাড়ি। ভাড়া জনপ্রতি ৪০০ টাকা। হিমালয় চীনা নেপাল-সীমান্ত এলাকায় পোখড়া জেলায় অব¯ি’ত। দার“ণ পর্যটন স্পট সেখানে মনে হয় পৃথিবীর সেরা পর্যটনের জায়গা, আসলেই তাই, না দেখলে বোঝা মুশকিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে মনে হয় রাব্বুল আলামিন এত সুন্দর করে পৃথিবীকে নির্মাণ করেছেন। সত্যি অবাক না হয়ে কেউ পারবেন না যে, এত সুন্দর করে এতগুলো পাহাড় কেমন করে সৃষ্টি হলো। এ জন্যই তো নেপালকে বলা হয় হিমালয়ের কন্যা, হিমালয়ের দেশ। পৃথিবীর ইতিহাসবিদরা এই পাহাড়গুলো নিয়ে কতনা গবেষণা করেছেন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে বছরের পর বছর পাহাড়ে চড়া ও এর ইতিহাস খুঁজেছেন গবেষকরা। আরও কিছু তথ্য জানা উচিৎ যারা নেপালে ভ্রমণে যাবেন, তা হ”েছ- নেপালে ইন্টারনেটে কোড এনপি, কলিং কোড +৯৭৭, সময় ¯’ান এনপিটি (ইউটিসি+৫:৪৫), আবহাওয়া গরম-ঠাণ্ডা।
হিমালয় বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর অনেক দেশের পর্যটক, বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। গত ২৩ মে (সকালে) ২০১০ বাংলাদেশের মুসা ইব্রাহীম প্রথম বাংলাদেশী এভারেস্ট জয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এভারেস্ট জয়ের ইতিহাসও অনেক। ধারাবাহিকভাবে সেগুলো বলতে গেলে প্রথমেই যা বলতে হয়। তা হ”েছ- বিশ্বের সর্বো”চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট। হিমালয় পর্বতমালার এই পর্বতশৃঙ্গে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫৭ বছর আগে। ১৯৫৩ সালে ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের স্যার এডমন্ড হিলারী এবং নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগে সর্বপ্রথম এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করার পর অনেক দেশের অভিযাত্রীর পা পড়েছে সেখানে। ওই সব অভিযাত্রী সর্বো”চ এই চূড়ায় ওঠে নিজেদের স্বপ্ন যেমন পূরণ করেছেন, তেমনি নিজের দেশকেও গৌরবান্বিত করেছেন। এভারেস্ট সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য যেমন-
গঠন : এভারেস্ট পর্বত গঠিত হয় প্রায় ছয় কোটি বছর আগে।
উ”চতা: সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উ”চতা প্রায় ২৯ হাজার ২৯ ফুট।
নামকরণ: ভারতের ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্টের নামে পর্বতটির নামকরণ করা হয়েছে। এর কারণ, স্যার জর্জ সর্বপ্রথম এভারেস্টের অব¯’ান নির্ণয় করেন এবং এর উ”চতা মাপেন। একসময় একে ১৫ নম্বর চূড়া হিসেবে চিহ্নিত করা হতো।
নেপালী ভাষায় এর নাম সাগরমাথা (আকাশের দেবী)
তিব্বতি ভাষায় এর নাম মোমেলংমা (মহাবিশ্বের দেবী মা)।
অব¯’ান: ২৭ ডিগ্রী ৫৯ মিনিট উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৬ মিনিট পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এর অব¯’ান। এই পর্বতের চূড়া নেপাল ও তিব্বতকে আলাদা করেছে।
শৃঙ্গ জয়: ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিউজিল্যান্ডের স্যার এডমন্ড হিলারী এবং নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগে সর্বপ্রথম এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন।
সর্বপ্রথম একা এভারেস্ট জয় করেন ইতালির পর্বতারোহী রেইনহোল্ড মেসনার, ২০ আগস্ট ১৯৮০ সালে।
শীতকালে সর্বপ্রথম এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন পোলিশ পর্বতারোহী লেসজেক চিচি ও ক্রিস্টোফ উইলিস্কি, ১৭ ফেব্র“য়ারি ১৯৮০ সালে।
১৯৭৫ সালের ১৬ মে জাপানের জুনকো তাবেই প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন।
৮ মে ১৯৭৮ সলে পর্বতারোহী রেইনহোন্ড মেসনার ও পিটার হ্যাবেলার অক্সিজেন ছাড়াই এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন! যা একসময় অসম্ভব ভাবা হতো।
২০০৮ সালের ২৫ মে সবচেয়ে বেশি বয়সে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন নেপালের বাহাদুর শেরচান (৭৬)। সবচেয়ে কম বয়সে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়েন যুক্তরাষ্ট্রের জর্ডান রোমেরো (১৩) তাও সম্প্রতি।
সবচেয়ে বেশিরবার এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণের রেকর্ড নেপালের আপা শেরপার। তিনি ২০ বারের মতো ওই চূড়ায় পা রাখেন। প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় দু’বার ওঠার কৃতিত্ব নেপালের নওয়াং গোম্বুর।
প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন দেবাশীষ বিশ্বাস ও বসন্ত সিংহ রায়। দেবাশীষের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় এর বসন্ত সিংহের বাড়ি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে।
সবচেয়ে দ্র“ত এভারেস্ট শৃঙ্গে ওঠার রেকর্ডটি অস্ট্রিয়া পর্বতারোহী ক্রিস্টিয়ান স্ট্যানগলের। তিনি ২০০৭ সালে বেসক্যাম্প থেকে মাত্র ১৬ ঘণ্টা ৪২ মিনিটে পর্বতচূড়ায় পৌঁছান। সবচেয়ে দ্র“ত চূড়া থেকে নেমে আসা রেকর্ডটা ফ্রান্সের জ্যাঁ-মার্ক বোয়াবিনের। তিনি প্যারগ্লাইভিং করে মাত্র ১১ মিনিটে নেমে আসেন বেসক্যাম্পে।
চূড়ায় অব¯’ান: সবচেয়ে বেশি সময় চূড়ায় অব¯’ানের রেকর্ড নেপালের বাবু চিরি শেরপার। তিনি সাড়ে ২১ ঘণ্টা সেখানে অব¯’ান করেন।
অভিযাত্রীর মৃত্যু: এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখতে গিয়ে ২০০৯ সালের শেষভাগ পর্যন্ত ২১৬ জন অভিযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।
বিপজ্জনক এলাকা : খুম্বু আইস ফল। সেখানে ১৯ জন অভিযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন।
অভিযাত্রী দল: এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অভিযাত্রী দল এভারেস্ট জয়ে গেছে চীন থেকে। ১৯৭৫ সালে ৪১০ জনের একটি অভিযাত্রী দল ওই অভিযানে অংশ নেয়।
বর্তমানে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এভারেস্ট নিয়ে নানা সমস্যার মধ্যে অব¯’ান করছেন। তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে নানা পরিবর্তন হতে শুর“ করেছে গোটা বিশ্বে তার আঁচ এভারেস্টেও লেগেছে। তাই ইউরোপ থেকে আমেরিকা কিংবা আফ্রিকা থেকে এশিয়া। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা পরিবর্তন আর উষ্ণতা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তার বাইরে নয় কোনো অঞ্চলই। কিš‘ তারপরও বৈশ্বিক উষ্ণতার এই প্রসঙ্গ যখন চলে আসে হিমালয় অঞ্চলের কথা তখন সেটি যেন পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ফেলে দেয় বাড়তি দুশ্চিন্তায়। কেননা, বিশ্বের আর দশটা অঞ্চলের চাইতে এক হিমালয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলেই পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে তার সঙ্গে তুলনা চলে না অন্য অনেক ক্ষতিরও। তার উপর হিমালয় ও হিমালয়ের হিমবাহগুলোর সঙ্গে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য যেভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাতে করে এখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সামান্যতম ত্র“টিও যে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে সেটিও ক্রমেই ভাবিয়ে তুলছে বিজ্ঞানীদের।
মূলত হিমালয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ব্যব¯’া নিয়ে চিন্তা করার আগে যে বিষয়টি বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা। ইতোমধ্যেই হিমালয় অঞ্চলের পরিবেশ নিয়ে সমীক্ষা চালানো একাধিক সং¯’ার রিপোর্টে উঠে এসেছে যে বিশ্বের অন্য যেকোনো অঞ্চলের চাইতে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি। এর ফলে একদিকে যেমন বহু বছর ধরে জমাটবাঁধা হিমালয়ের হিমবাহগুলো গলে সৃষ্টি করছে ভয়ংকর বন্যার অন্যদিকে একের পর এক পর্বতশীর্ষ বরফশূন্য হয়ে যাওয়ায় আগামীতে তা খড়ার মতো চির¯’ায়ী দুর্যোগের শংকাও জাগিয়ে তুলছে। নেপালের হাইড্রোলজি বিভাগের দীর্ঘমেয়াদী এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি বছর হিমালয়ের তাপমাত্রা দশমিক শূন্য ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস করে বাড়ছে? জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হারের চাইতে যা অনেকাংশেই বেশি। অন্যদিকে নেপাল হাইড্রোলজি বিভাগের এই সমীক্ষার সূত্র ধরে গেল বছর নিজস্ব প্রক্রিয়ায় একটি বিস্তারিত ও অনুসন্ধানমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করে ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ানও। গার্ডিয়ানের এই প্রতিবেদনে দেখা যায় গত ৫০ বছরে নেপালের তাপমাত্রা গড়ে ১.৬ ডিগ্রি করে বেড়েছে। বিশ্বে তাপমাত্রা যে হারে বেড়েছে এ হার তার দ্বিগুণ। তবে সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো হিমালয়ের চূড়ায় এই তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। হিমালয়ে বা তার আশপাশে এভাবে তাপমাত্রা বাড়লে তাতে ভয়াবহ এক বিপর্যয় ঘটতে পারে। আর এই বিপর্যয়ের প্রভাব যে শুধু এই অঞ্চলের মানুষের উপরই পড়বে তা নয়, বরং বিশ্বের প্রতি চারজনের একজন এর প্রভাবে ভুগবে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে শুধু নেপালের নদীগুলোই ভারত ও বাংলাদেশের ৭০ কোটি মানুষকে পানি সরবরাহ দিয়ে থাকে। কিš‘ হিমালয়ে যদি পর্যাপ্ত বরফ না থাকে, মওসুমী বৃষ্টি কম হয়, অথবা হিমবাহ গলে যাওয়ার হার পাল্টে যায় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার কৃষি, কারখানা, পানি সরবরাহ এবং শহরগুলোর অধিবাসীদের মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
আতঙ্কের বিষয় হলেও সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হিমালয় অঞ্চলে যে বিপর্যয়ের কথা বলা হ”েছ সেটি এখন আর ভবিষ্যতের কোনো শংকা নয়, বরং অতিমাত্রায় বর্তমান। হিমালয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির একাধিক বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুর“ করেছে এখানে। নেপালের উত্তরাঞ্চলে হিমালয়ের উপত্যকা ল্যাংট্যাং এর মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া লিরাং হিমবাহের বরফ গলে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এই হিমবাহ। লিরাং-এর গা বেয়ে তৈরি হ”েছ নতুন নতুন হ্রদও। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের হিসেবে, নেপালে হিমবাহ থেকে কমপক্ষে ২ হাজার হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে? বেশি মাত্রায় বরফ গলার কারণে অনেক ক্ষেত্রে হ্রদের তীর ভেঙ্গে আকস্মিক বন্যার আশংকাও করছেন বিশেষজ্ঞরা? এ প্রসঙ্গে নেপাল ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টেগরেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্ট বা আইসিআইএমওডি-র গবেষকরা বলছেন, ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এরকম হ্রদের তীর ভেঙ্গে বড় ধরনের কমপক্ষে ৫টি বন্যা হয়েছে নেপালে? আর দু’টি হয়েছে তিব্বতে এবং একটি ভুটানে ?
আসলে শুধু লিরাং হিমবাহই নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর প্রভাব এখন চোখে পড়ে গোটা হিমালয় অঞ্চলের বহু ¯’ানেই। চার দশক আগে নেপালের এভারেস্ট অঞ্চলে ইমজা হ্রদটি ছিল ছোট্ট একটি পুকুরের মতো? এখন এটি প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা ৯০০ মিটার চওড়া আর ৯২ মিটার গভীর এক হ্রদ? হ্রদটির তীর ভেঙ্গে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে? আর তা হলে পানির প্রবল স্রোত আশপাশের লোকালয়ে সুনামির মতো ভয়াবহ আঘাত হানতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলে আরো কমপক্ষে ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ হ্রদ রয়েছে বলেও সতর্কতা জারি করেছেন এই বিশেষজ্ঞরা।
দুঃখের বিষয় হলো শুধুমাত্র হিমবাহ আর পাহাড় চূড়াই নয় বরং জলবায়ু বিপর্যয়ের এই রেশ এখন অনেকটা মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে অব¯ি’ত বিভিন্ন এলাকা আর সমতলেও। অন্নপূর্ণার সর্বো”চশৃঙ্গ কালি গান্ধাকি উপত্যকার জমসম শহরে গত বছর শীতের সময় কোনো বরফ পড়েনি। এ সময় সেখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রা ছিল ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে যা এক পর্যায়ে কমে দাঁড়ায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কিš‘ এই তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আসার কথা। তা না হলে পানি বরফ হবে না। এর ফলে প্রায় ১২০০ হিমবাহ থেকে আসা পানির ধারা গান্ধাকি নদী হয়ে গঙ্গায় এবং তার পরে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। নেপালের এমপি সুনীল পান্ট বলেছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন আর বরফ জমছে না। ফলে মওসুমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যা”েছ না চাষের কাজে। এখন শীতের সময় ভীষণ ঠাণ্ডার কারণে লোকজন আর পাহাড় থেকে নেমে আসেন না। এখন তারা শীতের সময়ে পাহাড়ে মরিচ চাষ করেন। তারা গম চাষ করতে পারেন না। এভারেস্ট থেকে ৪০০ মাইল পূর্বে জমসম এর এই অব¯’ার কারণে সেখানকার অনেকেই বলাবলি করছেন যে তারা যেন মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বেঁচে আছেন। অন্যদিকে এমপি লাকি শেরপা বলেন, লোকজন মনে করেন না তাদের সামনে একটি ‘আগামী’ সকাল আসবে।
নেপালের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মকর্তা সিমন লুকাস মনে করেন, শীতে নদীর পানি প্রবাহ এরই মাঝে মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অন্য দেশের তুলনায় নেপালের জন্য এর প্রভাব যে কতটা ভয়ংকর সেটাও স্পষ্টতই বোঝা যা”েছ। শীতে বরফ না পড়ায় বসন্তে কোনো ফসল চাষ করা যা”েছ না। ওদিকে খোশি নদীটি ‘দুঃখের নদী’ নামেই পরিচিতি পেয়েছে। নদীতে পানি আসতে শুর“ করে তখন সেই পানি বিস্তৃত এলাকার কৃষি জমি ভাসিয়ে নেয়। ৬ ফুট পর্যন্ত গভীর বালুতে ঢেকে যায় জমি। এসব বালু পাহাড় থেকে বয়ে আনে পানি। আর উর্বর পলিমাটির পরিবর্তে পানি বেয়ে আসা এই সর্বনাশা বালুই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে কৃষি জমির। শুধু তাই নয়, এখন সবার মধ্যেই এই আতঙ্ক কাজ করছে যে ভবিষ্যতে হয়তো এই অববাহিকায় এমন ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকবে। এদিকে কলকাতায় অব¯ি’ত জাদবপুর স্কুল অব ওশিনোগ্রাফির পরিচালক সুগাতা হাজরা বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে যত তাড়াতাড়ি সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতা বাড়ার কথা তার চেয়ে দ্র“তগতিতে বাড়ছে বঙ্গোপসাগরের পানিপৃষ্ঠের উ”চতা। এ কারণে উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও হ”েছ আগের যেকোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি। তার হিসাব মতে, প্রতি বছর বন সংলগ্ন সাগর দ্বীপে সমুদ্রপৃষ্ঠ ৩.১৪ মিলিমিটার করে বাড়ছে। অথচ বিশ্বে এ হার এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক বা তার চাইতেও কম।
দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, হিমালয় ও তার অববাহিকায় মানুষের দীর্ঘদিনের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড যে ভয়ংকর বাস্তবতার জš§ দিয়েছে তা থেকে রাতারাতি বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। তবে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এইসব নেতিবাচক প্রভাবের বৃত্ত থেকে এ অঞ্চলকে বের করে আনতে হলে অত্যন্ত দ্র“ততার সঙ্গে হিমালয়কে তার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসতে সহায়তা করতে হবে। অতীতেও আমরা দেখেছি যে, প্রকৃতিকে বিরক্ত করা না হলে সে নিজেই তার যতœ অনেক ভাল নিতে জানে। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর বাংলাদেশের সুন্দরবনও এই নিয়মেই আবার জেগে উঠেছিল। কাজেই হিমালয়ের হিমবাহগুলোকে এদের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরিয়ে আনতে বৈশ্বিক তাপমাত্রার দ্র“ত নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এই অঞ্চলে হিমালয় ধ্বংসকারী মনুষ্য আচরণ নিয়ন্ত্রণেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই হয়তো আগামীতে আবারও দেখা মিলবে বরফা”ছাদিত স্বাভাবিক ও সুন্দর হিমালয় কন্যাদের।
সবশেষে ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু কথা বলে শেষ করা যেতে পারে। সে প্রসঙ্গে বলতে হয়, সভ্যতা সংস্কৃতির নব নব রূপায়ণের নিদর্শন মানবমনকে দেশ-দেশান্তরে আকর্ষণ করে। ভূগোলের পাঠ অজানা দেশের দ্বার খুলে দেয়। ইতিহাসের বিবরণ অতীতের ছবি এঁকে যায়। দেশভ্রমণের ফলে মানুষ ভূগোল আর ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে। শিক্ষার জন্য দেশ ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভূগোলের জ্ঞান কতকগুলো তথ্যমাত্র পরিবেশন করে। চোখের সামনে দেখতে পেলে সে জ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইতিহাসের অতীত কাহিনী স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক ¯’ান ভ্রমণ করলে। ভূগোল আর ইতিহাস এমনভাবে দেশভ্রমণের ফলে মুখর হয়ে ওঠে। একজন মনীষী বলেছেন, ‘নিজের দেশ ছেড়ে যে কোথাও যায় না, সে কুসংস্কারে ভরপুর থাকে।’ ভ্রমণ সহিষ্ণুতা শিক্ষা দেয়, ভ্রমণ মানুষকে জ্ঞান দান করে। ভ্রমণ তথা ¯’ান পরিবর্তনে প্রাণশক্তি বাড়ে। যাই হোক সম্ভব হলে দেশ বিদেশ ভ্রমণ করবেন আনন্দ পাবেন হয়ে উঠবেন একজন ইতিহাসের সাক্ষী।


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×