somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খ্যাপ মারস কে কে?? [একজন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের অপমৃত্যু]

৩০ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৪:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটা একটি খ্যাপ মারার কাহিনী। এই যুগে খ্যাপ মারা একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। সরকারী ডাক্তার জায়গায় জায়গায় খ্যাপ মেরে বেড়ায়। পাবলিক ইউনিভার্সিটির টিচার রা প্রাইভেটে খ্যাপ মেরে পকেট ভারী করে। খ্যাপ মারা কে আমরা আজকাল ভদ্র ভাষায় ফ্রি লেন্স ও বলে থাকি। যাই হোক, আমার খ্যাপ মারা টা কিন্তু এইসবের মত গুরুতর ছিল না, নিতান্তই নিরীহ টাইপের ছিল। :)

ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা সেই ছোটবেলা থেকেই। হোস্টেলে থাকার সময় ফুটবল-বাস্কেটবল-ভলিভল-টেবিল টেনিস সারা বছর ধরে যতই খেললাম না কেনো শীতকালে ক্রিকেট মৌসুম শুরু হলেই মনে হত, নাহ এটাই আসল খেলা। এটার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে।ক্রিকেট কে এক কথায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তাই অন্যান্য খেলার চেয়ে ক্রিকেট টাই ভালো খেলতাম।

ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি, হঠাৎ মাথায় একটা কেরা উঠল- ফুলটাইম ক্রিকেটার হলেই তো ভাল। লেখাপড়া করার কি দরকার?? শচিন কি লেখাপড়া করসে?? যেই ভাবা সেই কাজ, পরদিনই ভর্তি হয়ে গেলাম দুলু মিয়ার একাডেমিতে। এই একাডেমি অনেক নাম কড়া ক্রিকেটার কে জন্ম দিছে। তাদের নাম আর নিলাম না, তাদের সাথে এক কালে প্র্যাকটিস করসি চিন্তা করলেই একদিকে গর্বিত হই আবার লজ্জাও লাগে। :!> /:)

ছোটবেলা থেকেই এই ধরনের প্র্যাকটিস আর ড্রিলিং এর সাথে পরিচয় থাকায় খাপ খাইয়ে নিতে খুব একটা সময় লাগে নি। মনে মনে বললাম, যাক সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে গাধার মত দৌড়ানি টা এখন কাজে লাগল। মন প্রান ঢেলে দিলাম ক্রিকেট শিখতে। দিন রাত শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। মোজার ভিতর বল ঢুকিয়ে, ঘড়ের সিলিং থেকে সেটা ঝুলিয়ে সারারাত খট খট করে পিটাতাম। আমার এই কঠোর পরিশ্রম দেখে কোচ আমার উপর ফিদা হয়ে গেলো। মাত্র ৭দিনের মাথায় নেটে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। কম কথা??(এটা ছিল আমার প্রথম ভুল)
পোলাপান যেখানে ২-৩মাস গাধার মত ঘাম ঝরিয়ে ও নেটে ঢুকার চান্স পায় না সেখানে মাত্র ৭ দিন?? পোলাপানের হিংসা তো হবেই। (ঠিক সামু তে সেইফ হবার টাইমের সাথে মিলে যায়। আমার সেইফ হতে ৩ মাস লাগেছিল।এখন যদি কাউকে ৭দিনের মধ্যেই কমেন্ট করতে দেখি তো মডুর গুষ্টি উদ্ধার করে পোস্ট দেই /:) /:) )

আমার দ্বিতীয় ভুল ছিল এক প্র্যাক্টিস ম্যাচে সিনিয়র টিমের বিরুদ্ধে ৩চারের বিনিময়ে ৩৫ রান করা। এই পারফর্মেন্সকে পুঁজি করে স্কুলের নির্মান টিমেও ঢুকে গেলাম। সেই সময় নির্মান এর ম্যাচ গুলো খুব ফাটাফাটি হত। পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েরা ও খেলা দেখতে আসত। ;) ;) লোকাল হিরো হবার এটা ছিল পারফেক্ট একটা জায়গা। আমি সেই সময়ের কথা বলছি যখন বাংলাদেশ প্রথম বারের মত আইসিসি ট্রফি জিতে নেয়। তাই সেই সময়ে ক্রিকেট নিয়ে এক অন্য রকমেরই উত্তেজনা থাকত। দিন দিন আমার পারফর্মেন্স বেটার হতে লাগল। ক্লাস সিক্সেই নির্মানে চান্স পেয়ে যাব এমন কানাঘুসা শুনতে পারছিলাম। (সাধারনত সিনিয়র রাই থাকত মূল একাদশে)। টিম ঘোষনার পর নিজের নাম দেখে ব্যাপক খুশি হয়ে আব্বাজানকে জানাই।১মাস পরেই সিজন শুরু হয়ে যাবে...এখন আর ঠেকায় কে।

এমন সময়ের এক বৃঃস্পতিবার বড় ভাইয়া বলল
- আগামী শুক্রবার ফ্রি আসস?
- বিকালে প্র্যাক্টিস আসে। কেন?
- খ্যাপ খেলতে যাবি?
- খ্যাপ কি? :||
- আরে একটা প্ল্যায়ার শর্ট পরসে, তার জায়গায় খেলবি?
- খেলব । (খুশি হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন শুধু প্র্যাক্টিস ই করে গেলাম...অনেক দিন কোন ম্যাচ খেলা হয় না।) এটা আমার তৃতীয় ভুল।
- সকালে রেডি থাকিস। কুমিল্লা যাওয়া লাগবে।
এইখানে একটা কথা বলে নেই, আমার চাচাতো ৩ ভাই ই বেশ ভালো ক্রিকেট খেলত। কিন্তু আমার ফ্যামিলি তাদের সেই প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেয় নি। আমিও তখন লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়াদের সাহায্যেই প্র্যাক্টিস করছিলাম। কিন্তু ক্রিকেট খুব বিলাসিতার খেলা। এটা খেলতে গেলে কিছু জিনিস কিনতে হয়। কমপক্ষে একটি প্রাকটিস ব্যাট, একটি ম্যাচ ব্যাট আর একটি গার্ড না হলে তো খেলাই যাবে না। এত টাকা পাব কই? আব্বাজানকে বললে তো সরাসরি জবাই করে দিবে। তাই আমার ছোট চাচাকে গিয়ে ধরলাম। আমাকে অবাক করে এগুলো কিনেও দিল, সাথে বোনাস হিসেবে একটি হেলমেট ও।(আমি খান্দানের ছোট ছেলে, তাই ভাইয়াদের মানা করলেও আমাকে মানা করে নাই)

ভোরে উঠেই ব্যাগ নিয়ে দুই ভাই বেড়িয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম মামুলি টেপ টেনিস ম্যাচ হবে। মাঠে নেমেই মাথার উপর বাজ ভেংগে পরল। আয় হায়...আমার গার্ড আনি নাই :(( :( /:) :|| X( X(( :#> । শুধু ম্যাচ ব্যাট টা নিয়েই চলে আসছি। এখন কি করি?? লজ্জায় ভাইয়া কে কিছু বলতেও পারছি না। আর এই দিকে বুকে ড্রামের বারি মারা শুরু হয়ে গেছে। ভাইয়া কে বলতেই এক রাম ঝাড়ি খাইলাম। আমাকে নাকি আবার ওপেনিং নামা লাগবে, এটা শুনে কলিজার পানি শুকায় গেল।এখন কি করি?? মরে গেলেও অন্যের গার্ড পরব না। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আন্ডির উপর দিয়ে ভাইয়ার গার্ড টা প্লেস করে একটা গামছা দিয়ে আচ্ছাসে কাছা বেধে নিলাম /:) /:) । বেধে তো নিসি এখন তো আর হাটতেই পারি না, দৌড়াব কেমনে?? অনেক কষ্টে দুনিয়ার সাহস এক জোট করে ফেস করতে নামলাম। সারাক্ষন ভয়ে ছিলাম, এই বুঝি চিপা দিয়ে গার্ড পরে গেল।এমন যদি হয় মান-ইজ্জত পুরা ফালুদা হয়ে যাবে। এটা চিন্তা করে এতদিনের প্র্যাক্টিসে শিখা ক্রিকেটের অর্থডক্স টেকনিক গুলো বেমালুম ভুলে গেলাম। মুরালির মত বল না দেখেই ব্যাট চালানো শুরু করলাম...ক্রিজে ২ ওভার টিকেছিলাম। :(
খেলা শেষ হইল। বোলারদের নৈপুন্যে সেদিন ম্যাচ ও জিতেছিলাম। ৪০০টাকা ও পাইলাম। আসলে পাইসিলাম ৫০০ টাকা, ১০০টাকা ভাইয়া কমিশন রেখে দিসে। বুঝেন অবস্থা... X((
পরদিন গেলাম যথারীতি প্র্যাক্টিসে। নেট এ যাব, পায়ে প্যাড পরছি এমন সময় শুনি কোচের হুংকার...
খ্যাপ মারস কে কে??
আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল। কাল যে আমি খ্যাপ খেলে আসছি এটা কোচ জানল কিভাবে?? নিশ্চিত কেউ চুকলি কাটসে কোচের কাছে। স্বীকার করলাম...শাস্তি হিসেবে আমার নেটে নামা নিষিদ্ধ করা হল, সাথে উপরি হিসেবে প্রতিদিন ৫রাউন্ড এক্সট্রা দৌড়। বিমর্ষ হয়ে গেলাম। হিরো হবার সব স্বপ্ন চূর্ন-বিচূর্ণ হয়ে গেল। আমার নাম হয়ে গেল খ্যাপ মারা দুখী। সিনিয়র তো সিনিয়র, জুনিয়র রা পর্যন্ত আড়ালে আমাকে পচাইত। প্রতিদিন প্র্যাক্টিস করতে যেতাম, কিন্তু ব্যাট ধরার সুযোগ মিলত না। এটা যে কি পরিমান মানসিক কষ্ট দিত সেটা বুঝাতে পারব না। ভাবলাম সব শেষ... :(
পরদিন নির্মানের প্রথম ম্যাচ। ১৫জনের টিমে আমাকে রাখা হল দেখে একটু আশাবাদী হয়ে উঠলাম।যাক খেলতেও পারি। কোচ হয়ত মাফ করে দিসে। কিন্তু তখন কি আর জানতাম আমাকে নিয়ে তামাশা করা হবে?? ম্যাচ শুরু হবার আগে জানতে পারলাম আমি দ্বাদশ খেলোয়ার। লোটা-কম্বল আর পানির বোতল নিয়ে মাঠে মাঠে দৌড়াব শুধু। এদিকে আব্বাজান কে দাওয়াত দিয়ে রাখসি। নির্ঘাত উনি আসবেন খেলা দেখতে। এখন আমার এই মুখ কই লুকাব? মাঠে নেমেই মনে হল সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই আমাকে টিজ করছে...খ্যাপ মারা দুখী...খ্যাপ মারা দুখী...খ্যাপ মারা দুখী। লজ্জা আর লজ্জা... :(( :(( /:) X(
আমার কচি হৃদয় এটা সহ্য করতে পারল না। সব ছেড়ে-ছুড়ে দিলাম। কোচিং-নির্মান-একাডেমির খেতা পুড়ি। কোন ভদ্র মানুষ এগুলা খেলে?? সব অশিক্ষিতের দল...(আংগুর ফল টক) /:) /:)
কিন্তু যাকে একবার ভালোবেসে ফেলেছি তাকে ছেড়ে যাই কিভাবে?? পারলাম না ছাড়তে। শুরু করলাম খ্যাপ মারা। আজকে এইদিকে খ্যাপ তো কালকে ঐদিকে খ্যাপ। ধীরে ধীরে আমার রেট ও বেড়ে গেল। ৫০০থেকে আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল। শেষ খ্যাপ টা মেরেছি গত মাসে মেরেছি ৫০০০টাকায়।এখন আর ব্যস্ততার জন্য তেমন খেলা হয়ে উঠে না। তবুও ফাঁক পেলেই খেলি। এটা ছিল আমার প্রতিশোধ। নিজের উপর প্রতিশোধ...

আজকে সবার মত আমিও মন খুলে আশ্রাফুল কে গালি দেই। ভাবি ওর জায়গায় আমি থাকলে দেখায় দিতাম...আমি কি জিনিস। কিন্তু বাস্তবতা হল আমার সেই ক্যালিবার নেই, সেই ধৈর্য নেই, সেই সহ্য শক্তি ও নেই, যা একজন ক্রিকেটার হতে গেলে লাগে... :-&

তার চেয়ে এই ভালো আছি...খ্যাপ মারা দুখী...একজন ফ্রি লেন্স ক্রিকেটার। B-)) B-))


[উৎসর্গ করলাম ক্রিকেট পাগল সকল ব্লগারকে যারা একসময় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ]
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১০:৩৬
৬৭টি মন্তব্য ৬৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×