somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিভক্তি নয়, প্রয়োজন একটি অর্থবহ জাতীয় ঐক্যমত

২৯ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিভক্তি নয়, প্রয়োজন একটি অর্থবহ জাতীয় ঐক্যমত
জয়নুল ইসলাম

একটি জাতি বা দেশকে সগৌরবে টিকে থাকতে জাতীয় ঐক্য একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে শুধু বিবেচিত নয়, একে প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে না পারলে জাতির সগৌরবে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। আমাদের মত উন্নয়নশীল অথচ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা একটু বেশিই বটে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, সামগ্রিক বিষয়ে দুরে থাক, কিছু অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়েও ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে জাতি হিসেবে আমরা আজও শতধা বিভক্ত। যা মোটেও কাম্য নয়। আমাদের বিভক্তি জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় থেকে শুরু করে সর্বত্র। এ বিভক্তি এমনকি খেলার মাঠ পর্যন্তও বিস্তৃত।

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা সংগ্রামকে ঘিরেও আমাদের মাঝে বিভক্তি স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আজও আমাদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করছে। এ বিভক্তি থেকে বুদ্ধিজীবি সমাজও মুক্ত নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বিভক্তি সৃষ্টির পেছনে তারাই মূল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

রাজনীতিকে ঘিরেই আসলে আমাদের মূল বিভক্তি। বিএনপি-আওয়ামী লীগে বিভক্ত রাজনৈতিক দুটো এখন রূপ নিয়েছে জোট-মহাজোটে। তাই আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তিও আর বিএনপি-আওয়ামী লীগে সীমাবদ্ধ নয়। এ বিভক্তিরও রূপ এখন জোট-মহাজোটকে কেন্দ্র করে। সকল দেশেই কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক বিভক্তি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বিভক্তি রয়েছে রিপাবলিকা ডেমোক্র্যাটে, ভারতে তেমন কংগ্রেস-বিজেপিকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তাদের এ বিভক্তি কখনই জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান করেনা। সহজ কথায় জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে এসব দেশে দেখা যায় জাতীয় ঐক্যের চমৎকার উদাহরণ। জাতীয় স্বার্থের বেলায় বিজেপি-কংগ্রেসের সুর একসূত্রে মিলে যায়। তাইতো আমরা দেখি মুম্বাই হামলা নিয়ে তাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়নি। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসৎ ইচ্ছা কাজ করেনি। এ রকম বিষয় দেখি আমরা আরো অনেক দেশের ক্ষেত্রে। কিন্তু কোন দেশেই রাজনৈতিক মতভেদ জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে মুখ্য হয়ে উঠে না।

বাংলাদেশে দেখা যায় ঠিক তার উল্টো রুপ। এখানে রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে যেমন রয়েছে চরম বিভাজন, তেমনি এ বিভাজন তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও। এ বিভাজন আজ চরম আকার ধারণ করায় অনাকাঙ্খিত এক পরিবেশের তৈরী হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক বা সকল ক্ষেত্রে মতবিরোধ এতই বেশী যে, ভিন্নমত একেবারেই সহ্য করার অবস্থা নেই। একদল ক্ষমতায় আসলে অপর দলের হয় বেহাল দশা। অপর ছাত্রসংগঠনগুলোর অবস্থা হয় আরো করুণ। প্রতিপক্ষ দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হলে থাকতে পারেনা, পারেনা ঠিকমত ক্লাস করতে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার জন্য একদলের কর্মীদের হাতে অপর দলের কর্মীদের লাশ হওয়ার সংবাদ এদেশে এখন যেন এটা আর আজব কিছু নয়।

আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন এখন আর দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এ বিভাজন আজ সাত সমুদ্র এবং তের নদী পাড়ি দিয়েছে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এটা ছড়িয়ে পড়েছে প্রবাসীদের মধ্যে। তাই আজ পত্রিকার পাতায় এমনও সংবাদ শিরোনাম দেখতে হয়- ‘লন্ডনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যকার হাতাহাতিতে সম্মেলন পন্ড’, ‘বিদেশে বাংলাদেশের মন্ত্রীকে কালো পতাকা প্রদর্শন’ ইত্যাদি। এসব বিভক্তি নিশ্চয়ই দেশের সম্মান বৃদ্ধি করে না, তারপরও আমরা বিভক্তির মাত্রা দেশে এবং দেশের বাইরে প্রতিনিয়ত বাড়িয়েই চলছি।

সকল ক্ষেত্রেই বিস্তৃত আমাদের এ বিভক্তি শুধু আমাদের নিজদের মধ্যে নয়। এটা ভিন দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। তাই ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমাদের কোন জাতীয় ঐক্য নেই, নেই কোন জাতীয় নীতি। একদল ভারতকে অন্ধভাবে সমর্থন করি এবং সকল কিছু দান করে দেই। আরেক দল করি অন্ধ বিরোধিতা। আমাদের এ বিভক্তির মাঝেই ভারত তার স্বার্থ হাসিল করে নিয়ে যায়।

জাতীয় দুর্যোগের সময়ও বিভক্তি আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনা। বিডিআর বিদ্রোহের কারণে দেশের স্বাধীনতা যখন বিপর্যযের মুখোমুখি তখনও আমরা দলাদলি ভুলে একই প্লাটফর্মে দাড়াতে পারিনি। বরং মর্মন্তিক এ ঘটনাকে নিয়ে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে আমরা লিপ্ত থাকার চেষ্টা কম করিনি। আমরা এখনো এ নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যস্ত।

জাতীয় পরিচয় নিয়েও আমাদের বিভাজন মারাত্মক। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও আমরা বাংলাদেশী-বাঙালী বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। একদল ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষীদের সাথে মিলিয়ে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করে বাঙালী হিসেবে। আরেক দল পশ্চিম বঙ্গ কিংবা ওদের আমাদের জাতীয়তার সম্পর্ক নেই বলে বাংলাদেশী পরিচয় ধারণ করার পক্ষপাতি। অথচ এ ক্ষুদ্র বিতর্ক অতি সহজেই সমাধান করা যায়। আর তা বাঙালী ও বাংলাদেশী উভয়টি মেনে নিয়েই। নৃতাত্ত্বিক ভাবে আমরা অবশ্যই বাঙালী, কিন্তু জাতিগত ভাবে আমরা বাংলাদেশী। কারণ ভারতের বাঙালীরা তাদের জাতীয় পরিচয় কখনই বাঙালী দাবি করে না। তাদের জাতীয় পরিচয় ভারতীয়। যদিও তারা নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালী। যেমন অস্ট্রিয়ার অধিবাসীরা নৃতাত্ত্বিক ভাবে জার্মান বংশোদ্ভুত হলেও তাদের জাতীয়তা কিন্তু অস্ট্রিয়ান, কোনভাবেই জার্মান নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের মূল হল ইংলিশ। তাই বলে তাদের জাতীয়তা ইংলিশ হয়ে যায়নি, তাদের জাতীয়তা আমেরিকান। এভাবে এসব ক্ষুদ্র বিষয়গুলো অতি সহজেই সমাধান করে জাতীয় ঐক্য মজবুত করা যায়।

এসব বিষয় ছাড়াও আমরা শতধা বিভক্ত। আমাদের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষ আর ধর্মপন্থিদের মাঝে ব্যপক বিভাজন লক্ষ্যনীয়। আবার ধর্মপন্থিদের মাঝেও রয়েছে বিভিন্ন দল উপদলের বিভক্তি। এছাড়াও আমরা আজ আরো নানাভাবে বিভক্ত। ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, আবাহনী-মোহামেডান, ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান সহ নানা ভাবে। এসব ক্ষেত্রে বিভক্তি দোষনীয় না হলেও অনেক সময় তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। যা খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়।

অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের ঈর্ষনীয় ঐক্যের ক্ষেত্র পরিলক্ষিত হয়। যেগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করতে পারতো। যেসব উপাদানের অভাবে আমাদের পার্শবর্তী ভারতের ঐক্যবদ্ধ চরিত্র আজ হুমকির সম্মুখীন।

বাংলাদেশের মাত্র কয়েক ভাগ উপজাতি ছাড়া সবাই একই নৃগোষ্ঠি থেকে উদ্ভুত। বেশীরভাগ (প্রায় ৯৫%) মানুষের ধর্ম ইসলাম, বাকিরা অন্যধর্মাবলম্বী হলেও বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মুক্ত। আমাদের শতভাগ মানুষের ভাষা বাংলা, যদিও কিছু আঞ্চলিক ও উপজাতীয় ভাষা রয়েছে। কিন্তু প্রায় সবাই বাংলায় কথা বলতে পারে। সবাই একই সংস্কৃতির চর্চা করে। এসব চমৎকার সমতা থাকা সত্ত্বেও আজ আমরা শতধা বিভক্ত। একটি জাতি হিসেবে সগৌরবে টিকে থাকতে হলে সকল ক্ষুদ্র মতবিরোধের উর্ধ্বে উঠে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে একটি অর্থবহ জাতীয় ঐক্যমত।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Click This Link
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×