somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থাকছে না

২৯ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ৭:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও তৎপরতা নিষিদ্ধ থাকাসংক্রান্ত বিধান পুনরুজ্জীবিত করেছেন। একই রায়ে পঁচাত্তরের আগস্টে ঘোষিত সামরিক শাসনকে বেআইনি ঘোষণাসহ ‘সব ধরনের সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে চিরকালের জন্য বিদায়’ জানিয়েছেন। অতীতে সামরিক ফরমানকে সংবিধানের ওপর স্থান দেওয়ার জন্য আপিল বিভাগ অনুশোচনা করে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট এর আগে ভুল করে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন। আপিল বিভাগ আরও বলেছেন, সামরিক আইন জারি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে সংসদ আইন প্রণয়ন করতে পারে
আপিল বিভাগ ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছেন। পুনঃস্থাপিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদও। তবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র সংশোধনের ঝক্কি-ঝামেলা ও মানুষের দুর্ভোগের কারণ দেখিয়ে নাগরিকত্বের পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ রাখা হয়েছে।
আপিল বিভাগ ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছেন। পুনঃস্থাপিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদও। তবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র সংশোধনের ঝক্কি-ঝামেলা ও মানুষের দুর্ভোগের কারণ দেখিয়ে নাগরিকত্বের পরিচয় ‘বাংলাদেশি’ রাখা হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে এ ক্ষেত্রে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ৬ অনুচ্ছেদটি অবিকল বহাল রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। ওই ৬ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, বাংলাদেশের নাগরিকেরা বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। পঞ্চম সংশোধনীতে বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশি করা হয়েছিল। এখন আপিল বিভাগ ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় সমুন্নত রাখলেন। হাইকোর্ট প্রস্তাবনাসহ ১০টি অনুচ্ছেদ বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আদলে পুনরুজ্জীবনের আদেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ এর মধ্যে মাত্র তিনটি বিষয় সংশোধন বা পরিবর্তন সাধন করেছেন।
বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে বিএনপি সম্প্রতি লিভ টু আপিল (আপিল অনুমতির আবেদন) করে। আপিল বিভাগ গত ২ ফেব্রুয়ারি তা খারিজ করেন।
আপিল বিভাগের ১৮৪ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলাম। আপিল বিভাগের অপর পাঁচ বিচারক বর্তমান প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, বিচারপতি বিজন কুমার দাস, বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি এস কে সিনহা রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। কেউ আলাদাভাবে কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি। রায়ে পরোক্ষভাবে হলেও পঞ্চম সংশোধনীর প্রশংসা ও চতুর্থ সংশোধনীর সমালোচনা রয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে চতুর্থ সংশোধনীর কোনো ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তেমন পর্যবেক্ষণ ছিল না।
আপিল বিভাগের রায় দানকারী বিচারপতিরা গত মঙ্গলবার (২৭ জুলাই, ২০১০) পূর্ণাঙ্গ রায়ে সই করেন। একই দিন সন্ধ্যায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর কার্যালয়ে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের অবহিত করেন।
ধর্মভিত্তিক দল থাকবে না: বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মসংক্রান্ত কয়েকটি বিধান ছিল। পঞ্চম সংশোধনীতে তা বিলোপ করা হয়। হাইকোর্টের রায়ে বিসমিল্লাহ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আইনমন্ত্রী মনে করেন, এটি সংবিধানের অংশ নয়। আপিল বিভাগের রায়েও এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। পঞ্চম সংশোধনীতে ১২ অনুচ্ছেদটি পুরোপুরি বিলোপ করা হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত সংবিধানে ১২ অনুচ্ছেদটি অনুপস্থিত। শুধু লেখা আছে ‘বিলুপ্ত’। মূল অনুচ্ছেদে লেখা ছিল, সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র দ্বারা কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, ধর্মের অপব্যবহার, ধর্ম পালনের কারণে ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে। এখন ১২ অনুচ্ছেদ ফিরে এল। তবে এই অনুচ্ছেদটি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিভাগে। তাই এর কোনো লঙ্ঘন ঘটলে তা আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হবে না। কিন্তু ৩৮ অনুচ্ছেদের বিলুপ্ত অংশ ফিরে আসায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে। পঞ্চম সংশোধনীতে এটিও বিলোপ করা হয়। এখন ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করা বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোনো প্রকারে তার তৎপরতায় অংশ নেওয়ার অধিকার কোনো নাগরিকের থাকবে না।
সামরিক শাসন: বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সামরিক শাসনকে অনন্তকালের জন্য অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। এটিকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। আপিল বিভাগ তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল গ্রহণযোগ্যতা পাবে না, বৈধতা পাবে না। খন্দকার মোশতাক আহমদ, বিচারপতি সায়েম ও জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আপিল বিভাগ বলেছেন, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন চিরকালের জন্য নিন্দিত থাকবে। ভবিষ্যতে আর কোনো অজুহাতেই—নীতিগত, মতবাদ কিংবা তত্ত্বগত কোনোক্রমেই তার বৈধতা বিচার্য হওয়া উচিত নয়। কারণ সামরিক শাসন একটি জাতির কষ্টার্জিত মর্যাদা, সম্মান ও গৌরবের পরিপন্থী। এটা বাংলাদেশের জনগণের মানমর্যাদায় বিরাট আঘাত হানে। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিটি সৈনিকের মর্যাদার জন্যও ক্ষতিকর। তাদের কাজ এটা লক্ষ করা যে প্রজাতন্ত্রের সংবিধান যাতে কেউ স্থগিত, ধ্বংস, ক্ষতবিক্ষত না করতে পারে।
হাইকোর্ট সামরিক শাসন জারির সঙ্গে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার পরমর্শ দিয়েছেন। তাঁর কথায়, এদের শাস্তি দিলে আর কেউ এ ধরনের আস্পর্ধা দেখানোর দুঃসাহস পাবে না। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই অভিমতকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমর্থন করেছেন।
প্রস্তাবনা: সংবিধানের প্রস্তাবনাকে আপিল বিভাগ বলেছেন, ধ্রুবতারা। এর মানে হলো প্রস্তাবনা রাষ্ট্র ও তার জনগণকে পথ দেখায়। প্রস্তাবনা হলো সংবিধানের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সংসদও এটা বদলাতে পারে না। মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির অংশগ্রহণকে ‘জাতীয় মুক্তি’ ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যে পরিচালিত বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে জাতীয় মুক্তি ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম মুছে ‘জাতীয় স্বাধীনতা’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়। মনে করা হয়ে থাকে, এর মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কয়েক দশকের ‘মুক্তির সংগ্রাম’কে অস্বীকার করা হয়েছিল। এখন আবার তা আগের অবস্থায় ফিরবে। এ প্রস্তাবনাতেই লেখা ছিল, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও প্রাণোৎসর্গের চেতনা ছিল চারটি। এগুলো হবে সংবিধানের মূলনীতি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। পঞ্চম সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্র শব্দটি রেখে একটি ব্যাখা দেওয়া হয়। বলা হয়, সমাজতন্ত্র মানে হবে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার। আর নতুন করে এখানে যোগ করা হয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, এখন তা থাকবে না। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই হবে বাংলাদেশ সংবিধানের চার মূলনীতি। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে এই চার মূলনীতি লেখা ছিল। বলা ছিল, এই চার মূলনীতি হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলসূত্র। এমনকি আইন ও সংবিধান ব্যাখ্যারও সূত্র হবে এই চারটি বিষয়। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে এই অনুচ্ছেদটিতেও পরিবর্তন আনা হয়। বলা হয়, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কার্যাবলির ভিত্তি। এখন এটিও আর থাকল না।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ: বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের শিরোনাম ছিল জাতীয়তাবাদ। এখানে লেখা ছিল ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’ এটি অবিকল ফিরে এল। পঞ্চম সংশোধনীতে এটি সম্পূর্ণ বিলোপ হয়। বসানো হয় একটি নতুন অনুচ্ছেদ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সঙ্গে একমত হন যে বিদ্যমান অনুচ্ছেদটি থাকা নিরর্থক। বর্তমানে এতে স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহ দান এবং এতে কৃষক, শ্রমিক ও নারীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার বিষয়ে বলা আছে। বাহাত্তরের সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদটি বিলোপ করা হয়েছিল। এতে বলা ছিল, ‘মানুষের ওপর মানুষের শোধন হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে লেখা হলো, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।
পররাষ্ট্র: পঁচাত্তরের পর বাংলাদেশকে রাতারাতি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। মূল সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ পূর্ণ বহাল রেখে পঞ্চম সংশোধনীতে একটি বাক্য যুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ ও জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ হাইকোর্ট এই বাড়তি বাক্যটি বিলোপ করেছেন। আপিল বিভাগ এ সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন।
গণভোট: বাহাত্তরের সংবিধানে সংবিধান সংশোধনের জন্য কোনো গণভোটের বিধান ছিল না। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ পরিবর্তন বা সংশোধন করার পথ খোলা ছিল। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বদল করা হয়। আর এই পরিবর্তন যাতে ভবিষ্যতে কেউ সহজে না পাল্টাতে পারে, সে জন্য কয়েকটি অনুচ্ছেদকে রক্ষাকবচ দেওয়া হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হয়েছিল, সংবিধানের প্রস্তাবনার অথবা ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮, ৮০, ৯২ক অনুচ্ছেদ অথবা ১৪২ অনুচ্ছেদের কোনো বিধানাবলির সংশোধনের ব্যবস্থা রয়েছে, এমন বিল পাসে সংসদ যথেষ্ট নয়। তাকে তা গণভোটে পাস করাতে হবে। জিয়াউর রহমান ৯২ক অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সংসদকে পদানত করেছিলেন। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ৯২ক সংযোজনকে গণতন্ত্রের জন্য একটি ভয়ঙ্কর বিষয় বলে চিহ্নিত করেন। ’৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে ৯২ক বিলুপ্ত হয়। বর্তমানে প্রস্তাবনা ৮, ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটের ব্যবস্থা আছে। তবে এখন মূল সংবিধানের বিধান ফিরে এল। সে কারণে বিশেষ সংসদীয় কমিটিকে যেকোনো সংবিধান সংশোধন বিল পাস করাতে গণভোট করতে হবে না।
বিচারক নিয়োগ: হাইকোর্টের রায়ের দুটি নির্দিষ্ট বিষয়কে আপিল বিভাগ অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছেন। মূল সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করার বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে তা বিলোপ করা হয়। বিচারপতি সায়েম একটি সামরিক ফরমান দিয়ে সেই অংশটি ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান পরে তা রদ করেন। হাইকোর্টের রায়ে বিচারপতি সায়েমের সামরিক ফরমানটি পুনরুজ্জীবিত করার আদেশ দেন। কিন্তু এখন আপিল বিভাগ একমত হননি। বলেছেন, যে আইন রদ হয়ে গেছে এবং পঞ্চম সংশোধনীতে যা পাস হয়নি, তাকে বাঁচিয়ে তোলার সুযোগ নেই।
অপ্রয়োজনীয়: হাইকোর্টের দেওয়া ২৪২ পৃষ্ঠার রায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে আছে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদসংক্রান্ত আলোচনা। এই অনুচ্ছেদটির শিরোনাম হলো ‘ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী’। বাহাত্তরের সংবিধানেই এর মাধ্যমে সংবিধানে যোগ করা হয়েছিল চতুর্থ তফসিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ধারাবাহিকতা, গণপরিষদের কার্যক্রম ইত্যাদিকে সুরক্ষা দিতেই এই তফসিল করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সামরিক শাসকেরা তার অপব্যবহার করেন। পঁচাত্তরের ২০ আগস্ট থেকে ’৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত যা কিছু ফরমান জারি ও কাজ করা হয়েছে, তাকে ঢালাও বৈধতা দেওয়া হয়। এবং সে জন্য ওই তফসিলে ৩ক যুক্ত করা হয়। এখানেই বলা আছে, সামরিক আইনে যা কিছুই করা হোক না কেন, কোনো আদালতে তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, এর কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এ ধরনের বাক্য সংযোজন সংসদের এখতিয়ারবহির্ভূত। আপিল বিভাগ বলেছেন, একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও এই তফসিলে নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত যাবতীয় পর্যবেক্ষণ অপ্রয়োজনীয়। সে কারণে তা হাইকোর্টের রায়ের অংশ নয় বলে ঘোষণা করা হলো।
প্রশংসা ও সমালোচনা: আপিল বিভাগ মূলত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে রায় দেন। তাঁরা বিবেচনায় নেন, দ্বিতীয় সংসদ তার সংবিধান সংশোধন ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে যা করতে পারত না, সামরিক ফরমান দিয়ে তা করেছে এবং সংসদে পাস করিয়ে নিয়েছে। এটাকে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ বৈধতা দেননি। আপিল বিভাগ বলেন, বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার যে বিধান ছিল, তা চতুর্থ সংশোধনীতে বদল করা হয়। পঞ্চম সংশোধনীতে বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ৪৪ অনুচ্ছেদ যেমন ছিল, তা ফিরিয়ে আনা হয়। এটা ছিল আইনের শাসন ও জনকল্যাণমুখী।
আপিল বিভাগ বলেন, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারক অপসারণে সংসদের মাধ্যমে অভিশংসনের বিধান ছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে তা বদলে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাই পঞ্চম সংশোধনীতে আনা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান ‘অধিকতর স্বচ্ছ’। বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ১০২(১) অনুচ্ছেদে থাকা মৌলিক অধিকার কার্যকরে হাইকোর্টের অধিকার বিলোপ করা হয়। ১৯৭৭ সালে সামরিক ফরমানের মাধ্যমে হাইকোর্ট সেই ক্ষমতা ফিরে পান। সুতরাং পঞ্চম সংশোধনীর এই কাজটিও উপকারী। বৃহত্তর জনস্বার্থে তাই এই সংশোধনীও মার্জনা করা হলো।
বাকশাল করার বিধানটি সংবিধানে ১১৭ক নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ দিয়ে চতুর্থ সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছিল। আপিল বিভাগ বলেন, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ও সংসদীয় নির্বাচনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অস্বীকার করা যায় না। বরং তাদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্র বিকশিত হয়। উপরন্তু ১১৭ক অনুচ্ছেদটি সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসামঞ্জস্য ছিল। সুতরাং পঁচাত্তরের ৮ নভেম্বরের এ সংক্রান্ত ফরমানটিও মার্জনাযোগ্য।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব: আপিল বিভাগের দীর্ঘ রায়ে সংবিধান সংশোধনে নির্দিষ্টভাবে শুধু একটি ক্ষেত্রে জোরালো আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে। বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম লিখেছেন, ‘সংবিধানে বিচার বিভাগের কী অবস্থা, তার উল্লেখ না করলে আমাদের সিদ্ধান্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটি হলো বাহাত্তরের সংবিধানের মূল ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অবিকল পুনরুজ্জীবিত করা দরকার। নইলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পূর্ণ অর্জন সম্ভব নয়। আমাদের একান্ত আশা, সংসদ এই দুটি অনুচ্ছেদকে যত দ্রুত সম্ভব বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়ে আনবেন।’ প্রসঙ্গত, এই দুটি অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি-বদলি ও শৃঙ্খলা বিধানসম্পর্কিত।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×