somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যা কিছু মানবের মানবিক

২৭ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যা কিছু মানবের মানবিক
রণজিৎ সরকার


এ কথা বললে কেউ আজকাল আশ্চর্য হয় না : মানুষ পরে সামাজিক জীব, আগে একটা জন্তু। জন্তুর যে-সব বৈশিষ্ট্য মানুষেরও তাই। জৈব বৃত্তিতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিতে পার্থক্য নেই : জীব বিজ্ঞানের এ সত্য নতুন কোনো সংবাদ বহন করে না। অথচ আমাদের মানব সমাজে__বিশেষ করে আমাদের মতো শিক্ষা রহিত দেশে বা, যেখানে শিক্ষা কেবল চাকুরি লাভের নগ্ন উপায়,__চেতনাকে সমৃদ্ধ করার অবলম্বন নয়, বরং জৈববৃত্তি পূরণের একটা নিশ্চিত উপায়, সেখানে এই মানবসত্যটি খুব ক্ষীণভাবেও পৌঁছায়নি। যার কারণে যে মানব নিয়ে মানবের কারবার তারা তাদের নিজেদের বোঝে না। অথচ যে কারো জন্যই মানবসম্পর্কিত ধারণা : তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য, তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তার অতীতপরিচয়, এবং ভবিষ্যতের দিকে সে কীভাবে এগুচ্ছে__তার সচেতন, অসচেতন বা অবচেতন প্রয়াসে__এবং কেন এগুচ্ছে তার কারণ জানা জরুরি। মানব সম্পর্কিত পরিচ্ছন্ন ধারণার অভাব অর্থাৎ তার সীমাবদ্ধতা, তার সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রক্ষা করার অভাবের ফলস্বরূপ এই মানবের জন্যই আত্মঘাতী হয়ে উঠে।
মানুষ বোঝুক আর না বোঝুক প্রকৃতি এই বোঝাবুঝির ধার ধারে না, সে তার আহ্নিক ও বার্ষিক গতির নিয়েমে করে চলে মানব শরীরের বিকাশ। কিন্তু শরীরের নিয়মে যেহেতু মন বিকশিত হয় না, তাই তার বিকাশের জন্য প্রয়োজন বহু অতীত অভিজ্ঞতার সমন্বয়__যা তার পূর্বপুরুষের। পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতার মধ্য ক্রমচর্চায় নতুন অভিজ্ঞতা ও উদ্ভাবনার মধ্য দিয়ে মস্তিষ্ক সমৃদ্ধতর হয়ে এগিয়ে চলে। তবে ‘চলে’ বলছি, কিন্তু এমনি এমনি চলে না; আর প্রকৃতিও যেহেতু সেই দায়িত্ব নেয় না, তাই যে-ব্যাক্তির চেষ্টা স্বশিক্ষিত হওয়ার পথে না এগুয়, তার আর পশুর মধ্যে জীবনাচরণের দিক থেকে পার্থক্য খুব কমই থাকে; আর যে-পার্থক্যটুকুও থাকে, জীবন ধারণের দিক থেকে সেই পার্থক্য বিভিন্ন জন্তুতে জন্তুতেও রয়েছে।
আমাদের সমাজে যেহেতু ব্যক্তির জ্ঞানিক চর্চা নানা কারণে ব্যাহত, তাই বাঙালি মন আত্মসচেতন নয়। তাই সমাজে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বস্তগত ও অবস্তুগত বিষয়ে বিভ্রান্তিরও শেষ নেই। একটি অজ্ঞতা আরো নানা অজ্ঞতা সৃষ্টির জনক। সময়ের পরিক্রমায় এটিই ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় অনুন্নতির বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই আমরা এখানে মানব চরিত্রের স্বরূপ বুঝতে কয়েকটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করবো। প্রথমে আসা যাক মানবের জৈবিক ব্যপারে : ক্ষুধা, কাম, ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি এগুলো মানবের এবং পশুর উভয়ের প্রাকৃতিক গুণ। শরীর বিকাশের যে-পর্যায়ে একটি কুকুর কাম অনুভব করে, একজন মানুষও তাই করে। তীব্রতায় ও প্রাদুর্ভাবের সময়ে যদি-বা পার্থক্য আছে, তারপরও শরীর বৃত্তির দিক দিয়ে এই তাগিদে উভয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই।
মাতৃজঠর থেকে শিশুর ক্ষুধা-প্রবৃত্তির সৃষ্টি। জন্ম হয়েও সেই সূত্রে এই বৃত্তি তার হ্রাস পায় না। যেহেতু শরীর বিকাশের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন অপরিহার্য, প্রয়োজন-পূর্ত্তিও তাই অনিবার্য। প্রাণির খাদ্যের দাবি মূূলত প্রকৃতির-ই দাবি : সকল প্রাণির উপর প্রকৃতির যা কিছু আবদার রয়েছে, খাদ্যের দাবি সেখানে আদিমতম। সেই দাবি পূরণে ব্যর্থ হওয়া মানে প্রকৃতির গ্রাসে নিজেকে বিলীন করে দেয়া, কিন্তু তা অর্জন করে নিতে হয়, তাকে শরীরে অভ্যস্থ করে নিতে হয়। প্রকৃতি কোনো প্রাণির কথা চিন্তা করে তার ভাণ্ডার গড়েনি এই পৃথিবীতে, বরং প্রকৃতির মাঝে প্রাণিজগত একে অপরকে খাদ্য করেই বেঁচে বা টিকে আছে। তাই প্রতিটি প্রাণিরই বেঁচে থাকতে হয় নিজ দায়িত্ব নিয়েÑতার হাজার বছরের পরিক্রমায় এভাবেই সে নিজের দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে থেকে থেকে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেঁচে থাকার জন্য তাকে আর নতুর করে ভাববার প্রয়োজন পড়েনা,__প্রকৃতিগতভাবে সে স্থির করে কোনটি তার অস্তিত্বের জন্য শুভ এবং কোনটি অশুভ। অস্তিত্বসংগ্রামের এই সহজাত বৈশিষ্ট্যটিকে বলা যায় ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতোই একটি স্বতস্ফূর্ত সহজাত নির্বাচন। এই স্বতস্ফূর্ত সহজাত নির্বাচনই মানুষের সকল অপরাধ প্রবণতার উৎস। কারণ অস্তিত্ব টেকাতে সে চাইবেই : ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোনো পথে হলেও।
মনে রাখতে হবে যে, প্রকৃতি আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখেনি বরং আমরাই প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে উত্তীর্ণ হয়ে বেঁচে আছি। তাই বেঁচে থাকার চেষ্টায় প্রাণিকূল প্রকৃতির সঙ্গে বিরতীহীন এক অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত। এই যুদ্ধে যদি প্রাণিকূল জয়ী হয়, তাহলে প্রকৃতি তাকে বেঁচে থাকার জন্য কিছুটা সময় ছাড় দেয়; আর প্রকৃতির যদি জয় হয় তাহলে প্রাণির পতন অনিবার্য। প্রাণির জন্ম থেকে প্রকৃতির সাথে তার এই অঘোষিত যুদ্ধ চলতে থাকে; তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিরই জয় ঘটে। কোনো প্রাণিই আজীবন প্রাণ ধারণ করে থাকতে পারে না,__কেবল ততটুকু সময় বেঁচে থাকে যতটুকু সময় প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব চালিয়ে যেতে তার জীবনীশক্তির সমাপ্তি ঘটে না।
মানুষ বুঝেছে প্রকৃতিকে বদলানো যাবে না আমূলে, তাকে মানিয়ে চলতে হয়; তাই মানিয়ে চলতে প্রকৃতির আবদারগুলোকে সে পূরণ না করে পারে না। তাই সে যখন ক্ষুধা অনুভব করে, খাদ্যের পূরণ তখন না করলেই নয়__ক্ষুধা তার আদিমতম জৈবিক চাহিদা! ক্ষুধার মতো কামও তেমনি। তাই মনুষ যখন কাম অনুভব করে কামের পূর্ত্তি তার অনিবার্য। প্রকৃতির এগুলো হলো স্বাভাবিক আবদার : তাকে বেঁচে থাকতে হলে এগুলোকে তার পূরণ করতে হয় : স্বাভাবিক উপায়ে যদি না হয়, অস্বাভাবিক উপায়েও।
আমরা কোনো বিকৃত কাম-পরিচয় পেলে ঘৃণা করি, কিন্তু বুঝতে চাই না যে, তার প্রয়োজনের স্বাভাবিক পথ অবরুদ্ধ! তাই যখন সেই অবরুদ্ধ পথটিকে সচল করতে আমরা চাই না, তখন প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতাকে অগ্রাহ্য করে মনোবিকারকেই পৃষ্ঠপোষকতা দেই। আবার বিপরীত ভাবে আমরা প্রত্যাশা করি সমাজে কোনো যৌনবিকার যেন না থাকে! খুব কি স্ববিরোধী নয় এটি?
বিস্ময়কর মনে হলেও সত্য যে মানুষের অপরাধপ্রবণতা দূর করতে চেয়ে আমরা হাজার হাজার বছর ধরে এই ধরনের স্ববিরোধী কার্যের পরিচয় দিয়ে এসেছি এবং এখনো দিচ্ছি। অপরাধ দূরের উদ্দেশ্যে অপরাধীর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু বুঝতে চাওয়া হয়নি কোনো কারণ ছাড়া কার্য যেহেতু উৎপন্ন হয় না, স্বাভাবিক ও সহজ পথ ছেড়ে মানুষের এই অস্বাভাবিক পঙ্কিল পথ গ্রহণেরও কোনো কারণ থাকতে পারে! অথচ তৎপরতা দেখা যায় শাস্তির বিধান করতে, যে-কারণে অপরাধ সংগঠিত হলো তা দূর করতে সামান্য চেষ্টা নেই!
অপরাধ প্রবণতা শাস্তির বিধানে সামান্যও পরিবর্তিত হয় না এবং হয়নি কখনো এই মানবইতিহাসে। সমস্যা মোকাবেলা যদি প্রকৃতই করতে হয়, তাহলে প্রয়োজন বিজ্ঞানমনষ্কতা, অর্থাৎ দরকার এমন একটি মনষ্কতা যা অপরাধ সংগঠন হওয়ার ভেতরকার কারণগুলো সম্পর্কে ভাবে; এবং প্রকৃতির এই নিয়মের রাজ্যে মানুষের অপরাধ প্রবণতাকে কোনো না কোনো নিয়মের অধীন বলে মনে করে, যা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধীন নয়, বরং প্রাকৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের অধীন। মানুষও-যে প্রকৃতির আর সকল উপাদান : গ্রহ তারা নক্ষত্রর মতো নিয়মের দ্বারা পরিচালিত, যার নিজের ইচ্ছ-অনিচ্ছার চেয়ে বড় প্রাকৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবেশের সীমাবদ্ধতা__এটা বোঝা উচিৎ। তাই তার যে কোনো কার্য হোক, আর তা তথাকথিত সমাজের চোখে অপরাধ হোক, সেটি ব্যক্তির একমাত্র ইচ্ছার ফল নয়, পরিস্থিতিরও চাপ বটে। চুরি থেকে শুরু করে ধর্ষণ খুন পর্যন্ত সকল অপরাধই ব্যক্তির একার ইচ্ছার ফল নয়, বরং বলা যায় তার ইচ্ছা নয়, তার প্রয়োজন তার সীমাবদ্ধতা তাকে এই কাজে সম্পৃৃক্ত করে। কিন্তু যখন এইসব কাজে শাস্তি দেওয়া হয় কেবল ব্যক্তিকে, তা কি মেনে নেওয়া যায়?
লোভ, ঈর্ষা, হিংসা, প্রতিহিংসা শব্দগুলো নিয়ে মানুষের শিশুতোষ-বিরুদ্ধাচরণের শেষ নেই;__বিষয়গুলো খুব-যে জঘন্য এতেও কারো সন্দেহ নেই! কিন্তু ভাবলে দেখা যায় এর প্রত্যেকটির জন্মানোর স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, এবং যৌক্তিক ভিতও রয়েছে : মূলত মানবের মনে বঞ্চনা থেকেই এগুলোর জন্ম। কিন্তু আমরা বঞ্চনাকে দূর না করে লোভ, ঈর্ষা, হিংসা ও প্রতিহিংসাকে দূর করতে চাই। সমাজে যখন একজন বা একটি শ্রেণি নিজেকে অন্য সমাজের ও ব্যক্তি থেকে নিচের বিবেচনা করে, তখনই সেই উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে তার লোভ জন্মায়। এই লোভকে আকাঙ্ক্ষা বলা যেতে পারে। লোভ হলো আকাঙ্ক্ষার নেতিবাচক প্রতিরূপ। ব্যাক্তি তার নিজস্ব চেষ্টায় উদ্দিষ্ট কোনে স্থানে নিয়ে যেতে মানসিক যে প্রেষণা অনুভব করে তাকে আকাঙ্ক্ষা বলা যায়; আর লোভ সেটিই যোগ্যতা যেখানে স্থূল, সামান্য বা অনুপস্থিত হলেও প্রাপ্তির প্রত্যাশা সেই অনুপাতে স্থিতিশীল থাকে না। সামাজিক অর্থে ইতিবাচক লোভকে আকাঙ্ক্ষা বলে এবং যে আকাঙ্ক্ষা সামাজিক ক্ষতি আনে এ-ই লোভ। মানবসমাজে লোভ মূলত সহজাত, যেহেতু সম্পদের অসম বন্টনে, এবং বণিকদের আধিপত্যপ্রবণতায় একচেটিয়া অপলাভে প্রভূত-মানুষের বঞ্চনাভোগও আজ সমাজে স্বাভাবিক ও সহজাত বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অর্থ অপরিহার্য, অর্থপ্রাপ্তির জন্য তাই অপরিহার্য লোভ। যখন ব্যক্তির তুলনায় অপরে বেশি সম্পদশালী হয়, অথচ ব্যক্তির এখনও সেই প্রাপ্তি ঘটেনি, তখন ব্যক্তি-অস্তিত্ব টেকাতে তার সহজাত স্বতস্ফূর্ত নির্বাচন প্রবৃত্তি থেকে জন্ম নেয় ঈর্ষা। ঈর্ষা ক্রমশ পুঞ্জিভূত হয়ে জন্ম দেয় হিংসার। হিংসা ঘাতক। ব্যক্তির পক্ষে অসহনীয় ঈর্ষাই হিংসায় রূপ লাভ করে ব্যক্তির মানসিকতার স্বাভাবিক স্থিতি রক্ষা করে। মানব মনে অনুভূতির রূপান্তর বা অবস্থান্তর বা মাত্রা পরিবর্তন হলো মানব মনের স্বাভাবিকতা রক্ষার প্রক্রিয়া। এর মধ্য দিয়ে মানসিক বিকৃতি রক্ষা পায়। তাই দেখা যায় হিংসা মাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে কার্যে রূপান্তরিত হলে ব্যক্তির উত্তেজনা কমে আসে, তার ভেতর স্বাভাবিকতা আসে। প্রকৃতির মাঝে কোটি বছরের পরিক্রমায় মানুষের বিকাশ এগিয়েছে এবং অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছে এভাবেই। ব্যর্থরা ঝরে গেছে।
আমরা সামাজিক স্খলনের কথা বলি : মূলত জৈববৃত্তির সামাজিক বিকাশে বাধা আসলেই এর উৎপত্তি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম-এর পূর্ত্তি অনিবার্য; যদি তা না হয়, তাহলে এদের সহযোগী বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রাদুর্ভাব ঘটবেই__যাকে আমরা লোভ, ঈর্ষা, হিংসা ও কার্য বলে এতক্ষণ আলোচনা করেছি। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-কাম-এর প্রয়োজন পড়েছে অথচ তা পূরণ করা হয়নি, তা হয় না। কারণ ইতিবাচক পথ না পেলে তা নেতিবাচক পথের আশ্রয়ে পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করবেই। নেতিবাচক আশ্রয়ের প্রকাশ দু’ভাবে ঘটে : সামাজিক ক্ষতি দিয়ে, না হয় ব্যক্তিগত ক্ষতি দিয়ে। অর্থাৎ হয় সমাজ না হয় ব্যক্তি : সমাজ যদি ক্ষতির সম্মুখীন যদি না হয়, তাহলে ব্যক্তি অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যেমন ধর্ষণ। ব্যক্তির তীব্র কাম পূরণ না হতে হতে এমন এক উত্তেজক অবস্থায় পৌঁছে যায় সে ব্যক্তি হিসেবে দুর্বল হলে ধর্ষণের দিকে ধাবিত হয়, সম্পর্ক-অসম্পর্ক বিচার করে না, সমাজ-মিথ বিচার করে না; আর তা যদি না হয়, যদি তার ভেতর শিক্ষণের প্রভাব পড়ে থাকে যা দমন করতে শেখায় তার কামকে, এবং তাকে সম্পর্কের মিথে নিযে দাঁড় করায়, তখন দমিত কাম অন্য দিকে ঘুরে প্রভাব ফেলে সামগ্রিক কর্মস্পৃহা ও ব্যক্তিত্বে। সুতরাং বোঝা যায় ক্ষতি হবেই__যে ক্ষতিই হউক না কেন সেই ক্ষতি ঘুরে ফিরে আমাদের সমাজেই প্রভাব ফেলবে ঘাতক রূপে।
ক্ষুধা ও কামের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য না বোঝার ফলে আমরা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যকে অবহেলা করেছি, ফলে মানব উন্নতিই ব্যহত করেছি। মানব উন্নতির জন্য মানবের দৃষ্টি বৈজ্ঞানিক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বিজ্ঞানে আস্থার দরুণ মানুষের সহানুভূতিশীলতা বাড়ে এবং মানুষের নানা আচরণে কার্যকরণ-বৈশিষ্ট্যে মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পায়। আর তখন কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যক্তিকে স্খলিত হতে দেখলে বুঝতে পারে নিশ্চই সমাজের নৈতিক বা বিকাশের স্তরে কোনো গলদ রয়েছে। তার অপরাধপ্রবণতা মূলত ওই গলদপ্রক্রিয়ারই ফল__ব্যক্তি তার জন্য একাই দায়ী নয়, সমাজও সেখানে দায়ী। ব্যক্তির যদি সেই অপরাধের দরুণ শাস্তি ভোগ করতে হয়, তাহলে সমাজও শাস্তির দাবীদার;__সামাজিক বিধি, মূল্যবোধ, সমাজের মানুষের প্রবণতা এর সঙ্গে যুক্ত।
আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষ সততা নিয়ে জন্মায় না। তাই সামাজিক অর্থে শঠ ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা কোথায়, একে কীভাবে দূর করা সম্ভব এবং দূর কার পাক্ষে করা সম্ভব__এগুলো আলোচনার কার প্রয়োজন। যদি উপায় নাও থাকে, চেষ্টায় তা পাওয়া সম্ভব। যে কারণে সমাজে সততার বদলে শঠতা, প্রেম-স্নেহের বদলে পীড়ণ-অত্যাচার সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে মানুষ হত্যা করতে উদ্ধত হয়, ধর্ষণ করে, সে কারণগুলো সমাজ থেকে বিলোপ করতে হবে। নীতিশিক্ষা দিয়ে সকল স্তরের মানুষের মনুষ্যত্ব রক্ষা সম্ভব নয়__এ কথাটি মনে রাখতে হবে।
অতীতে এবং চিন্তার উন্নতির এই সময়েও আমাদের ধারণা মানুষের অপরাধপ্রবণতা, তার খলতা, তার চরিত্রহীণতার জন্য ব্যক্তি কেবল নিজেই দায়ী, তাই সে সমস্যা দূর করতে আমরা কেবল ব্যক্তিকেই অভিযোগ করেছি, ব্যক্তিকেই সাড়াতে চেয়েছি এবং বলে এসেছি এবং এখনো বলছি যে, মানুষের অপরাধ-প্রবণতার কারণ তার অশিক্ষা। সে কারণে দেখতে পাই সমাজে সবসময় একটি নীতি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে সভ্যতার শাব্দিক বিকাশের শুরু থেকে; এবং করা হযেছে পৃথিবীর সর্বত্রই__যেখানে সভ্যতা মাথা চাড়া দিয়েছে, এবং যেখানে সভ্যতার ক্ষীণ প্রবাহটুকুও আছড়ে পরেছে, এই নীতিশিক্ষা সেখানেও প্রবাহমান।
মেনে নিতে হয়, এই সমাজ-যে তার কোনো বিশেষ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেই নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিল; সেই বিবেচনায় নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে চেয়েছে তার সর্বত্রই__এমনকি এই শিক্ষার অনুরণন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষার কাঠামোতে। কিন্তু নীতিশিক্ষা অন্যান্য শিক্ষার মতো নয় : একটি গল্প পাঠ করলে পাঠক ঘটনা জানতে পারে, চরিত্র জানতে পারে__না জেনেও উপায় নেই তার;__তেমনি স্থাপত্যবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যৌতিষবিদ্যা পাঠ করলেই জানা যায়, সে অনুসারে আচরণ করতে বাধা নেই কারোÑকারণ এখানে ব্যক্তির স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় না। কিন্তু নীতি পাঠ করলেই মানুষ নৈতিক হয়ে ওঠে না, কারণ উক্ত শিক্ষাকে আচরিত করতে গেলেই ব্যক্তি তার প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে নীতির একটা স্পষ্ট বিরোধ লক্ষ করে, তাই পারিপার্শ্বিক চাপে যদি-বা সে নীতির বিরোধিতা করতে পারে না, কিন্তু মন থেকে মেনেও নিতে পারে না।
প্রতিটি মানুষের মনে সহজাতভাবে প্রাণিজগতের একটা বৈশিষ্ট্য আছে : তার অস্তিত্ব রক্ষা করা প্রবণতা।__এবং এই অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে সকল নীতিই তার কাছে তুচ্ছ। নীতি একটি সাময়িক ব্যবস্থা, কিন্তু স্থায়ী উপশম নয়, কাজেই ব্যক্তিকে নীতি দিয়ে কিছু সময় থামানো গেলেও সবসময় থামানো সম্ভব হয় না, সুযোগেই সে বিকশিত হয়__সততা সুযোগের অভাব__এই অর্থেই সত্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু পৃথিবীময় নৈতিকতার ছড়াছড়ি, মানুষের এই প্রবণতা না বুঝেই, সমাজ, দর্শন, সাহিত্য এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে লক্ষ করা যায়। এবং আমারাও উপদেশ দিতে গেলেই সেই মহান গ্রন্থগুলো থেকে, এবং কিছুটা নিজেদের অভিপ্রায়ের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে অন্যকেও এই নীতিই দিতে চেষ্টা করি।
এই-যে ধর্মগ্রন্থগুলোর নীতি যা নির্দিষ্ট ধরনের মানবিক প্রবণতাগুলো দূর করবে বলে রচিত হয়েছিল এবং তার পেছনে তাই অতিলৌকিক নানা ভয় দেখানো হয়েছিল, যার ফলে সেই ভয়-ভীত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির অহং-এ বরবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, এই জীবনই শেষ নয়, শাস্তির জন্য আরো একটি জগৎ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে! মৃত্যু পরবর্তী জীবন কোনো কোনো ধর্মে আছে, কোনো কোনো ধর্মে নেই, কিন্তু মৃত্যুর পর নরক সকল ধর্মেই__নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু নরকের এত আগুন, এত ভয় মানুষের নীতিশিক্ষার প্রয়োজন মেটাতে পেরেছে কি? যদি পারতোই তাহলে বহিরাবরণের এই সভ্য সমাজে, ভেতরে ভেতরে, এত অসভ্যতা দেখা যেত কি? নীতিবিদ্যায় প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত পড়ুয়া তিনিও অনৈতিক হয়ে উঠেন! একজন ডাক্তার পিতা, একজন ইঞ্জিনিয়ার পিতা, একজন শিক্ষক পিতা, তার সন্তানদের কাছে নীতির অভিধান হলেও, অনৈতিক রোজগার তার নিজের ও তার পরিবারের কাছে স্বতস্ফূর্ত আনন্দের উৎস হয়ে উঠে কেন? ব্দ্ধৃ মা যে কখনো সন্তানকে সমস্ত জীবন সামান্য অনৈতিক শিক্ষার পাঠ দেয়নি, তার জ্ঞানানুসারে, তিনি কী করে জিগ্যাস করেন ‘বাবা উপরি কামাই কত?’ এবং যদি উপরি থাকে তাহলে সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানি স্বীকার করে উপরে হাত তুলেন, না হলে বিপন্ন বোধ করেন__তখন নীতিশিক্ষার কথা কি তার মনে থাকে?__আসলে একথা হয়তো কেউ অস্বীকার করবেন না যে, নীতি পরে রয়েছে শুধু আমাদের জরাজীর্ণ গ্রন্থে, এবং আমাদের প্রকাশমান কথা বলার উপাদানে, তা ছাড়া মূলত অনৈতিকতাকেই, তর্কাতীতভাবে, মনে মনে আমরা সবাই মেনে নিয়েছি। বর্তমান মানুষের দিকে তাকালে এটা কি প্রমাণিত হয় না-যে, সহস্র বছরের নীতিবিদ্যা কত ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে? হাজার বছরের নীতিশাস্ত্র, ধর্ম গ্রন্থের ভয়, শিক্ষাগুরুর পরামর্শ, মায়ের নির্দেশ সবকিছুই কি মানুষের প্রয়োজনের সামনে বিলীণ হয়ে যায়নি?
তাই দেখা যায় পুস্তকের নীতিবিদ্যা পুস্তক বন্ধ হলেই হারিয়ে যায়, কারণ যে-নীতি তার প্রয়োজনাকাক্সক্ষার সূত্র মানে না, তার সীমাবদ্ধতা বুঝে না, তার জৈবিক তাগিদকে অবৈজ্ঞানিকভাবে পরিহার করে__ব্যক্তির স্বতস্ফূর্ত সহজাত নির্বাচন পদ্ধতি তাকে সমূলে পরিহার করে চলে।__কোনো মূল্যেই প্রাণির পক্ষে তার জৈববৃত্তিকে পরিহার করা সম্ভব নয়__এটা বৃথা চেষ্টা মাত্র। জৈবিক বৃত্তিই তার আদিমতম প্রেষণা যার জন্য কোনো শিক্ষণের তার প্রয়োজন নেই__এই শিক্ষাই তার প্রাথমিক উৎস,__আর নীতিশিক্ষা হলো তার দ্বৈতিয়ীকি উৎস। ‘চুরি করা পাপ’__এই নীতি শিক্ষা যে শিখেছে, তার যদি প্রয়োজনীয় অভাব-পূরণের ব্যবস্থা না থাকে তারপরও ব্যক্তি সে কথা পালন করবে, আশা করা যায় না।
তাই সমাজে সততা নৈতিকতা ইত্যাদির পাঠের পূর্বে জানতে চাওয়া উচিৎ : এগুলো পালন করতে ব্যক্তির কী কী সহায়ক সামাজিক শর্ত রয়েছে; এবং ব্যাক্তির প্রাকৃতিক সহজাত বৈশিষ্ট্যকে কতটুকু মানবিক ভাবা হয়েছে? অন্যথায় ব্যক্তি যদি তা পালন না করে, তাহলে তা অস্বাভাবিক নয় কখনো।
কিন্তু বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে এই অস্বাভাবিকতারই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে চলছে। বাঙলার মহামানবেরা বাঙালির চরিত্র সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন এতই বেশি করে যে, সেগুলো নিয়ে একটি আলাদা চরিত্রাভিধান রচনা করা হয়ত যাবে।
তাঁরা একমত যে, পৃথিবীর যত মন্দগুণগুলো আছে তার সবগুলোর অধিকারী, এবং কোনো কোনোটার স্রষ্টা, এই বাঙালি। বাঙালি ভীরু, কপট, অলস, পরশ্রীকাতর, বাহ্যিকভাবে সে কামহীন ভেতরে ভেতরে এক একটি বাঙালি একজন ক্যাসানোভা, বাঙালি পরিচ্ছন্ন ভণ্ড, বাঙালি যত্রতত্র মিথ্যা কথা বলে, সঙ্ঘশক্তি করার চেয়ে ভাঙতে তার চেষ্টা বেশি, মিথ্যা দম্ভ তার আছে, সে কেবল বাঙালি__মানুষ নয়, সে রুগ্ন ও দরিদ্র__শরীরে ও অর্থে যতটা মানসিকতায় তার চেয়ে অনেক বেশি, বাঙালি বাকসর্বস্ব, বাঙালি বাচাল__প্রচুর কথা বলে বাঙালি সামান্য বক্তব্য প্রকাশ করে,__সে প্রকাশ্যে রঙিন মুখ নিয়ে ঘুরে, ভেতরে মুখটি তার কালো কুৎসিত, বাঙালি সততার কথা জীবনভর বলে, কিন্তু জীবনযাপন করে অসততায়, বাঙালি ধর্মের কথা সোরগোল করে বলে ধর্মবিরোধী কাজ করে অবলিলায়, প্রগতির কথা বলে প্রগতিবিরোধী কাজ করে প্রতিদিন, বাঙালি সময়ের মূল্যবোধহীন, বাঙালি নিন্দুক জাতি : তার এলাকার খবর রাখুক আর না রাখুক খারাপ খবরগুলো মুখস্থ করে রাখে, পরনিন্দায় সে আনন্দ পায়; বাঙালি ধর্ষণকারী জাতি, সে পরোন্নতি কাতর, বাঙালি দায়িত্বহীন, বাঙালি সততার ভান করে কিন্তু খুব অসৎ, বাঙালি ইন্দ্রিয়পরায়ণ অথচ আনন্দকে তারা গর্হিত মনে করে, বাঙালি উদ্ভবক নয় তাত্ত্বিকও নয়, কোনো কিছুই উদ্ভাবন করেনি বাঙালি, বাঙালি সুবিধাবাদী, বাঙালি মূল্যায়ণ করতে পারেনা : কারো কোনো কিছুর ভুল মূল্য স্থির হলে তার পুনর্মুল্যায়নে বাঙালি রাজি নয়, সর্বোপরি বাঙালি আত্মঘাতী।__এরকম অসংখ্য অভিযোগ বাঙালির নামে আছে এবং এগুলো হয়ত অসত্য নয় কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে বাঙালির এতো আত্মসমালোচনার পরও, এই জাতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না কেন? বাঙালি চরিত্র থেকে এই বিষয়গুলো দূর না হয়ে কেন নতুনতর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বাঙালির বাড়ছে, তা কি আমরা ভেবেছি?
মূলত বাঙালির সীমাবদ্ধতাগুলো যেই মহামানবেরা দেখিয়েছন তার অবস্থানে দাঁড়িয়ে সেগুলো তাঁরা দেখেননি, তার দুর্বলতার যুক্তিগুলোকে বিবেচনা করেননি আন্তরিকতা নিয়ে তার মতো করে। বরংচ তার কার্যগুলোকে বারবার অঙ্গুলিসঙ্কেত করতে চেয়েছেন এমনভাবে, যেমন করে কোনো প্রতিপক্ষ কোনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য করে; তার দুর্বলতা শুধরানোর জন্য, দুর্বলতা ও মানবিক ত্র“টিগুলো দূর করতে সমস্যার মূলে সচেতনভাবে আঘাত না করে, সমস্যামানে আঘাত করে পুঁজিবাদী মানবিক দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছেন তাঁরা। যে উপনিবেশ এখন আর নেই, কিন্তু যে-ঔপনিবেশিক মানসিকতা এখনো রয়েছে, যে মানসিকতা প্রচার করে ইউরোপ প্রাচ্যের ধন সঞ্চয় করেছে প্রতীচ্যে, বাঙালি মহমানবদের এই আত্মসমালোচনা মূলত তারই ফল। বাঙালির, দীর্ঘদিনের পরাধীনতায়, যে-স্থায়ী শাসকতুষ্টির মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, এবং সেই প্রয়োজনে শাসক গোষ্ঠীর সামনে নিজেকে ডিক্লাস্ট দেখানোর যে-প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল, এবং পাশাপাশি যেই শ্রেণি থেকে তিনি চ্যুত হয়েছেন তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-পরিহাস করে নতুন জাতে উঠার সুখানন্দ প্রকাশের যে প্রবণতা দেখা দিয়েছিল এই আত্মসমালোচনা হলো এরই অভিব্যাক্তি । যেখানে নিজ জাতির অনুন্নতির বেদনা নয়, ‘নিজে সেখান থেকে উত্তরিত হয়েছি __এই আনন্দই মূখ্য।
দুর্ভাগ্যের বিষয়-যে মহামানবদের আত্মসমালোচনার এই গুণ সমস্ত ক্ষুদ্র মহামানবদের মধ্যেও আজ সংক্রামিত। আশ্চর্য্যরে বিষয় হলেও সত্য যে, সমস্ত বাঙালির কাছেই বাঙালি আজ ঘৃণ্য হলেও, কোনো বাঙালির সে লজ্জ্বার গ্লানি নেই, সেগুলো শুধরানোর চেষ্টাও নেই! মনে রাখতে হবে সাধারণ ভাবেনা, সে কেবল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে,__পরিবর্তিতত পরিস্থি’তি সে মেনে নেক আর না নেক, সে মানিয়ে নেয়, এবং সে অনুসারে আচরণ করে। তাই তার আচরণে প্রচলিত বা বিশেষ অর্থে যদি নিন্দনীয় হয়, তাহলে তার জন্য সে একা দায়ী নয়, তার পারিপার্শি¦ক ভাবজগত এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও দায়ী। আর যেহেতু ঠক বাছতে গেলে গা উজার হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই উক্ত নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্যর বাস্তবতাকে সড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, ব্যক্তিকে নয় : গ্যাংগ্রিন হলে হাত কাটা যায়, পা কাটা যায়, গলা কাটা যায় না। ভাবগত বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বদল না করা পর্যন্ত মানুষের মানসিকতার বদল করা যাবে না।__সকল স্তরের মানুষকে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই।
বাঙালির আত্মসমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে, আরেকপক্ষকে দেখা যায় ঠিক বিপরীত এবং আরো একটি অবৈজ্ঞানিক পথ নিতে : তাঁরা মনে করেন যে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগুলোর মধ্যে বাঙালির এমন অনেক গুণ আছে যে, যা পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তে পাওয়া যাবে না। ‘ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই এই বসুন্ধরা’র মতো এই বাঙালিও ধন্যি। বাঙালি বিদ্রোহী জাতি, বিপ্লবী জাতি, দমানো তাকে সহজ নয়, প্রয়োজনের সময় সে ঠিকই মাথা চারা দিয়ে উঠে, মেধায় বাঙালির মত পৃথিবীর কম মানুষই আছে, পৃথিবীর কম জাতিরই বাঙালির মতো এতো উচ্চ ঐতিহ্য আছে, মানুষে মানুষে এতা সম্প্রীতি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাঙালি খুব শান্তিপ্রিয় জাতি, অল্পতেই খুব তুষ্ট, কোনো কোনো জরিপ দেখিয়েছে বাঙালি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জাতি, বাঙলার মানুষ সরল, অতিথিপরায়ণ__অতিথি তাদের কাছে দেবতার সমতূল্য__অতিথি তাদের কাছে ভগবান স্বরূপ, প্রয়োজনে নিজের স্ত্রীকে অতিথির শয্যায় পাঠিয়ে দিতে সে কুণ্ঠিত নয়।__মন্দগুণের মতো ভালো গুণও এমন আরো পাওয়া যাবে যা দিয়েও হয়ত আরো একটি চরিত্রাভিধান দাঁড় করানো সম্ভব।__যেখানে, রয়েছে আবেগের আতিশয্য, অতিরিক্ত উচ্ছাস, যার অনেকটা ফাঁকা কথার মতো অন্তঃসারশূন্য!__এই ফাকা কথা হলো সেই আত্মসমালোচনার আরেকটি ফল।
ফাঁকা কথাগুলো বাদ দিয়ে আত্মসমালোচানার বিষয়গুলোতে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে,
বাঙালিচরিত্রের যতসব খলতা তা সকলই বিরূপ পরিস্থিতির ফল : অর্থনৈতিক শোষণের কবল থেকে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হওয়ার দরুণ, এবং পাশাপাশি ক্ষমতায় পুনরায় পৌঁছানোর চেষ্টা এবং তার উপর্যুপরি ব্যর্থতা তার চরিত্রের খলতার জন্য দায়ী। কারণ সে দেখেছে এক দিকে সম্পদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে পাহাড়ের মতো, আর অন্য দিকে মরুভূমির কাঠিন্য ভোগ করতে হচ্ছে তার নিজেকে। হাজার বছর ধরে পুঁজির ও সম্পদের অসম বন্টন এবং অসম ভোগ ব্যক্তিকে খল করে তুলেছে ক্রমশ। তাই যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে যেতে চাওয়ার স্বপ্ন না দেখে পারে না, সেখানে পৌঁছুতে কপট-প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়,__প্রয়োজনে একে অপরের লাশের উপর দাঁড়িয়ে নিজে বড় হতে চায় এবং একেই জীবনসংগ্রাম বলে, নিজের দেশকে বিক্রিী করে, নিজের পরিজনের ক্ষতি বয়ে আনে সে সর্বোাপরি আত্মঘাতী হয়! বাঙালির চরিত্রের উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় সেগুলো বেশিরভাগই প্রতারণামূলক; আর মানুষ কখন প্রতারণার আশ্রয় নেয়? যখন সে দেখে তার অস্তিত্ত্ব বিলীনের দিকে অথচ রাষ্ট্রস্থানীয় বা কতৃত্বস্থানীয় কারো সে দিকে নজর নেই, এবং নজর দেওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই, তখন সে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। প্রতারণা-প্রবণতার সৃষ্টি মূলত অন্যের প্রতি সামগ্রিক অনাস্থা এবং নিজের চেষ্টায় বিকশিত হওয়ার যথার্থ্য সুযোগের অভাব থেকে। তাই এই বাঙালি চরিত্রে তার সামগ্রিক প্রতারণামূলক প্রবণতার ঐতিহাসিক কারণ আমাদের অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, এবং দেখতে হবে যে এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য মূলত কে দায়ী : ব্যক্তি, না আমাদের ভঙ্গুর রাষ্ট্র শাসন ও অর্থব্যবস্থা?
মজার ব্যপার হচ্ছে এই যে, অভিযোগের প্রশ্ন যখন আসে তখন আমরা বেমালুম ওই ক্ষেত্রগুলোর কথা ভুলে যাই, এবং এমন স্থানে ইঙ্গিত করি, বস্তুত সমস্যার মূল যেখানে নেই! সমগ্র জাতিকে ভুলিয়ে দিয়েছে আমাদের রাষ্ট্র যে, আমাদের চরিত্রের খলতার জন্য তারও কিছুটা অবদান রয়েছে! শুধু তেল, চাল, নুন, স্বর্নের দাম নয়, বর্হিদেশীয় বাণিজ্যনীতি ও কেবল চুক্তির মধ্যে নয়, আমাদের দায়বোধ ও দায়িত্বহীনতার সঙ্গে, আমাদের চরিত্র ও চরিত্রহীনতার সঙ্গেও রাষ্ট্রব্যবস্থা সংযক্ত__খুব নিবিড় ও প্রবলভাবে যুক্ত ।
ব্যক্তিকে কপট প্রতিযোগিতায় নামিয়ে, পরস্পর খুনোখুনিয় মত্ত রেখে, মানুষকে কীট বানিয়ে তুলেছে গোপনে থেকে পুঁজিতন্ত্র,__তার পাশবিক বৃত্তিকে জাগিয়ে তুলেছে কপট প্রতিযোগিতায়, কিন্তু নিজে দায়িত্ব নিচ্ছে না, বরংচ চাচ্ছে নীতির দোহাই দিয়ে তা আড়ালে রাখতে, আবার আইন প্রণয়ন করে বিচারালয় প্রস্তুত করে শাস্তি দিচ্ছে পরিস্থিতির শিকারকে!
পৃথিবীব্যাপী, শিকারী-সন্দেহে, এক শিকারের চোখ কেবল অন্য শিকারে আবদ্ধ রেখে, শিকারী আর কতকাল গোপনে নিরাপদ থেকে এই মানবিক প্রতিক্রিয়াগুলোকে বলবে অপরাধ?
ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০০৯











































২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×