somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : তেপান্তরের মাঠের খোঁজে

২৬ শে জুলাই, ২০১০ বিকাল ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির পেট্রোবাংলা ঘেরাও কর্মসূচির মিছিলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরে এই লাঠিপেটার ঘটনা ঘটে। ৮০ শতাংশ রপ্তানির সুযোগ রেখে দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি (পিএসসি) না করার দাবিতে এই ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কমিটি।লাঠিপেটায় প্রায় ৭০ জন আহত হয়েছে বলে কমিটি দাবি করেছে। এর মধ্যে কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল হকসহ ৩০-৩৫ জনের জখম গুরুতর। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নগরের বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন বলে কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
...এরই প্রতিবাদে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন। মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম দীপুও উপস্থিত। তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ওপর আঘাত তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছে। অধ্যাপক আরিফ আজ কালো প্যান্টের ওপর সাদা ফতুয়া পরেছেন । সকাল থেকেই গনগনে তাত ঝরছে ঢাকা শহরে, আড়ংয়ের ফতুয়াটি ঘামে ভিজে গেছে। মাঝারি উচ্চতার অধ্যাপকটির গায়ের রং শ্যামল, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা-সব মিলিয়ে মেধার দীপ্তি ছড়াচ্ছে। অধ্যাপক আরিফের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সক্রিয় মধ্যবয়েসী কর্মী। নাজমূন নাহার । তিনি মহিলা লালমাটিয়া গালর্স কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার অধ্যাপক আরিফের দিকে তাকিয়ে তিক্ত কন্ঠে বললেন, ধিক! এরা কী ভাবে দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয় অধ্যাপক আরিফ! এর পিছনে রয়েছে পেট্রোবাংলার একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আপনি নিশ্চয়ই তার নাম জানেন। হ্যাঁ, আমি ড. সালমান রশীদ-এর কথা বলছি ।
অধ্যাপক আরিফ হাসলেন। বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন আপা। ড. রশীদের যে বাংলাদেশের প্রতি টান নেই তার কারণ আছে।
অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার অধ্যাপক আরিফ-এর ঘেমে যাওয়া শ্যামল মুখের দিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকালেন ।
অধ্যাপক আরিফ পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছে নিয়ে বললেন, আমাদের ছোটবেলায় নানা আমাদের গল্প শোনাতেন। সালমান কখনও শোনেনি। ভিনদেশি কমিকস পড়েছে।
কি! কি বললেন! অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার গভীর বিস্ময় বোধ করেন।
অধ্যাপক আরিফ হেসে বললেন, ড. সালমান রশীদ আমার ঘনিষ্ট আত্মীয়। বলতে পারেন আমরা একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। আমি আজও তেপান্তরের মাঠ খুঁজছি ... সালমান এই কথার মানে কখনোই বোঝেনি।
অধ্যাপক আরিফের কথায় অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার কেমন হতভম্ব হয়ে যান।
আরিফুর রহমান দীপুও প্রেস ক্লাবের সামনে প্রখর রোধের ভিতরে দাঁড়িয়ে অনেক বছর পিছিয়ে যেতে থাকেন ...
১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসের এক দুপুরে ফুলতলি গ্রামে একা একা ঘুরছিল দীপু। ভাদ্র মাসের ঝকঝকে দিন । মেঘশূন্য নীলাভ আকাশে চিলপাখিদের ওড়াওড়ি। শীর্ণ সোহাগী নদীর পাড়ের মাঠে চিলপাখিদের চলন্ত ছায়া। এই সব নিঝঝুম ভাদ্রের দিনে ফুলতলীর পথ-ঘাট, গাছপালা সব কেমন টানটান হয়ে আছে। তালপুকুরের ওপাশটায় ঘন আমবন। আমবনে রোদের হাট বসেছে। আমবনের বাঁ পাশে তালপুকুর। তালপুকুরে ঝাঁপাচ্ছে ন্যাংটো ছেলের দল ...এইসব দেখতে দেখতে দীপুর ঘোর লাগে। এই দেশ কী নির্জন! শ্যামল! সুন্দর! এই দেশটি নিজের মতো করে থাকবে বলেই আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এই দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল। তবে দীপুর বিশ্বাস যতদিন তারা বেঁচে ছিল-বড় সুখেই বেঁচে ছিল। বড় খালা আজ ধনে পাতা দিয়ে কই মাছ রেঁধেছিল। অপূর্ব সে স্বাদ, আর অপূর্ব এই শেষ বেলার রোদের স্পর্শ। হ্যাঁ, বাংলার সুখশান্তি জগতের অন্যকোনও দেশের মত নয়। দূরে রেললাইন। সেদিকে যেতে থাকে দীপু। আসলে তেপান্তরের মাঠ খুঁজছে দীপু । বাংলাদেশের কোথাও আছে তেপান্তরের মাঠ, গল্পগাথায় সে কথা লেখা রয়েছে। কিন্তু কোথায়? ওর মনের গহন ইচ্ছে একবার তেপান্তরের মাঠটি খুঁজে বার করে, তারপর সেই মাঠে ঠিক মাঝখানে গিয়ে একবার দাঁড়াবে। ... বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হল। নানাবাড়ির সামনে আমলকি গাছের তলায় সেজ খালার সাদা রঙের মাজদা গাড়ি থেমে; গাড়ির পাশে সালমান দাঁড়িয়ে। সেজ খালার ছেলে সালমান ওরই সমবয়েসি, স্কুল ফাইনাল দিয়েছে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে সালমান । দীপু থাকে মালিবাগে - সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুল থেকে এবার এস এস সি দিল। কাজেই সালমান খানিক গম্ভীর হয়েই থাকে। হয়তো গাম্বীর্য বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। সালমানের বাবা আদনান কোরেশী বিরাট ব্যবসায়ী।
দীপু দেখল নানা উঠানে দাঁড়িয়ে। সালমান কে জড়িয়ে ধরলেন। কি রে তুই একা এলি? তোর মা-রা এল না?
কাল আসবে। আব্বা কালকে ফিলিপাইন ফিরবে থেকে। বলে ভিতরে চলে যায় সালমান । ড্রাইভার বক্সি ব্যাগ নিয়ে পিছন পিছন যায়।
একটু আগে মাগরিবের আজান দিল। নানা মসজিদে চলে যান। নানাকে বিমর্ষ দেখাল। গত বছর এই দিনে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। দীপু জানে নানা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভক্ত। যে কারণে বিমর্ষতা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না।
দীপু পুকুর পাড়ে যায়। মায়ের দুদিন ধরে জ্বর। নানীর ঘরে ঢুকে খোঁজ খবর নেয়। টুনি মায়ের মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিচ্ছে। হারিকেনের আলোয় টুনির মুখখানা শুকনো দেখাল। বড় খালা মায়ের পায়ে সর্ষের তেল মাখছেন। মা বলে, বুবু ও বুবু। আমি মরে গেলে আমার দীপুটুনিরে দেইখ। তুই চুপ কর তো শেফালি। বড় খালা ধমক দেন। দীপু ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসে। উঠান ভরা জোছনা। নানা নামাজ সেরে এসে রোজকার মতো উঠানে বসবেন। নাতী নাতনীরা সব বড় একটা মাদুরে বসবে। সব মিলিয়ে দশ বারো জন। ছোট খালা একটা টুকরিতে তালের পিঠা কি মুড়ি ভাজা নিয়ে আসবে । ছোটখালার চলাফেরা কেমন সাবলীল। কে বলবে দু’দিন পর বিয়ে। মাদুরে বসে নানা গল্প বলেন। মজার কথা হল, নানা গল্প বলেন সাধু ভাষায়। নানা বলতে থাকেন-এক দেশের এক রাজপুত্র। রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন,-”আচ্ছা, যাক্।”তখন দেশের লোক দলে-দলে সাজিল,রাজা চর-অনুচর দিলেন,রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন। রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য চর অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না। নূতন পোশাক পরিয়া, নূতন তলোয়ার ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন। যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে দিয়া উপস্থিত হইলেন ...সালমান এল না। ও ঘরে কমিকস পড়ছে। দীপু আর গল্প শুনতে বসল না। গল্পটা ও অনেকবারই শুনেছে। দীপু পুকুর ঘাটের দিকে যায়। মায়ের জ্বর হলে ওর মন খারাপ থাকে। পুকুরপাড়ে কলাঝোপ। তালের গুঁড়ি কেটে ঘাট বসিয়েছে। বসে। কচুরিপানার গন্ধ পায়। ওপাশের ঘরে আলো জ্বলছে। সালমান কমিকস পড়ছে। ও রূপকথার গল্প শোনে না, তেপান্তরের মাঠ খোঁজে না। সালমান অ-বাংলাদেশি গল্পে সুখ খুঁজে পায়।
ছোট খালা এসে ধপ করে বসল। দীপু, বর আমার পছন্দ না। আমার বিয়ে হবে না।
বল কি? দীপু আঁতকে ওঠে।
হ।
তা হলে ?
তা হইলে আর কি। বিয়ে হয়ে যাবে।
বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ছোট খালু তৈহিদুর রহমান সুজন; উত্তর পাড়ার স্কুল মাস্টার। আদর্শবাদী পড়ালেখা জানা সজ্জন এক মানুষ। দীপুর মনের বদ্ধ জানালা খুলে দিয়েছিলেন। দীপু কে বলেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের দারিদ্রের কারণ খুঁজে বার করতে। দীপু বলেছিল, খালু, আমি তেপান্তরের মাঠ খুঁজি। ছোট খালু বললেন,ভালো কথা। তবে এ দেশের দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষের কথাও ভেব।
সালমানটা যেন কেমন? ছোট খালা বলে।
কেমন?
তালের পিঠা দিলাম খাইল না।
ওহ্।
বড় দেমাগ। বড়লোকের ছেলে তো।
কী আর করা। দীপু কাঁধ ঝাকাল।
হঠাৎই আঁচল থেকে কী বার করে ছোট খালা দীপুর শার্টের পকেটে গুঁজে দিল।
কী! দীপু অবাক।
যা, তুই অখনই সাইকেল নিয়া উত্তর পাড়ায় যা। কাজীবাড়ির মৌলভী মজিবর রহমান এর বেটা সুজনরে এই চিঠি দে গা,যা। আমার কেন মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে হবে না সেই কথা চিঠিতে সবিস্তারে লেখা আছে।
দীপু মুচকি হাসে।
ছোট খালার বিয়ে ধুমধাম করেই হয়েছিল। ছোট খালাদের মত সুখি দম্পতি কমই দেখেছে দীপু। ... বিয়ের চার বছর পর নানাজান মারা যান। দীপু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে। সন্ধ্যার আগে ফুলতলি পৌঁছে নানার কবরের সামনে হুহু করে কাঁদল। সালমান তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে গেছে । যোগাযোগ তেমন নেই। সালমানের মা সেজ খালার ক্যান্সার হয়েছিল। পরীক্ষার অজুহাতে সালমান মাকে দেখতে আসেনি । মেজ মেয়ের অসুখই নানার মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ বলে মনে করে দীপু। সেজ খালা কে নানা অসম্ভব ভালোবাসতেন। সেজ খালার মৃত্যুর পর সেজ খালু আবার বিয়ে করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাস-লাইব্রেরি ছাড়াও মধুর ক্যান্টিনেও সময় কাটে। একদিন ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুল এসে বলল, দীপু, কমরেড রতন সেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। ঝিকাতলায় মনেশ্বর রোডের এক মেসে আছেন।
আজ আর ক্লাস ছিল না। সাইফুলের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে দীপু উঠে পড়ে। লাইব্রেরির সামনে এসে দেখল শবনম দাঁড়িয়ে আছে। ও আজ শাড়ি পড়েছে-ঘিয়ে রঙের দামী সিল্ক। হঠাৎই মনে পড়ল দীপুর- আজ ১ মার্চ, শবনমের আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন শবনম। দীপু বলল। শবনম হাসল। অর্থনীতির দুর্দান্ত ছাত্রী মীর্জা আদিলা শবনম ঢাকার এক বনেদি পরিবারের মেয়ে। মায়ের দিক থেকে পাকিস্তানি রক্ত আছে শরীরে। পাকিস্তান আমলে বাওয়ানি জট মিলস ওদেরই কোন্ আত্মীয়র ছিল। ওকে নিতে কালো মার্সিডিজ আসে। শবনম জিগ্যেস করল। কোথাও যাচ্ছ কি?
হু।
আমি কি যাব?
চল। দীপু বলল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ভাষা ইন্সিটিউটের সামনে চলে আসে। ওখানে রিকশার জটলা। ওঠ। দীপু বলে। শবনম উঠে বসল। দীপু রিকশায় উঠে বসতেই বেলি ফুলে সুগন্ধ পায়, আর শবনমের শরীরের কোমলতা ... সেখানকার মৃদু তাপ । সিগারেট ধরায় দীপু। শবনম বলল, ভাবছি এবার আমি আর অর্নাস ফাইনাল দেব না দীপু ।
কেন? দীপু অবাক হয়। ধোঁওয়া ছাড়ে।
আমি অর্নাস ফাইনাল দিলে তুমি তো আর ফাস্ট ক্লাস পাবে না। বলে শবনম হাসে।
হাঃ হাঃ হাঃ। দীপুও হাসে। এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ে। রাস্তায় ঝকঝকে রোদ। একটা আর্মির জিপ চলে যায় নীল ক্ষেতের মোড়ের দিকে। জহুরুল হক হলের সামনে ফুটপাতে আকাশি রঙের কাবুলী পোশাক পরা এক এক তরুণ দাঁড়িয়ে প্রশ্রাব করছে। ’৭৫ এর পর এসব পাকিস্তানি পোশাক বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস করার জন্য সচেতন ভাবে প্রচলন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা। নানার কথা মনে পড়ে যায় দীপুর। নানা আহমদ হোসেন মৃধা মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে জ্যোস্নালোকিত উঠানে বসে নাতীনাতনীদের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের গল্প শোনাতেন । বাংলাদেশের বৃদ্ধরা এখন নাতীনাতনীদের কি গল্প শোনায়? । তখনই রিকশাওয়ালার পিঠে চোখ গেল। পিঠে কালশিটে পড়েছে। আর কতকাল এরা সহ্য করবে? এ দেশে কেবলি ক্ষমতার পালাবদল। গত বছর ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছেন । আজ ১৯৮২ সালের ১ মার্চ; দীপু জানে না ... আর মাত্র ২৩ দিন পর, অর্থাৎ, ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক রক্তপাতহীন অভ্যূত্থানের পর নিজেকে বাংলাদেশের চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ঘোষনা করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ অবধি বাংলাদেশের বুকে জগদ্দল স্বৈরাচারী পাথর চাপাবেন।
রিকশা থামল মনেশ্বর রোডের এক ঘিঞ্জি গলির সামনে ।
এখানে মানুষ থাকে। হাঁটতে হাঁটতে শবনম নাকমুখ চেপে বলে। শাড়ি পরে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে।
এর চেয়েও অমানবিক পরিবেশে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ বাস করে। দীপু বলল।
ওহ্ ।
আমার সঙ্গে তুমি একদিন আদমজী জুটমিলের শ্রমিক বস্তিতে যাবে শবনম?
প্লিজ, না।
গলির ভিতরে একটা জরাজীর্ণ টিনসেডের বাড়ি। তারই একটি ঘরে কমরেড রতন সেন পরে বসে ছিলেন। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি । পেপার পড়ছিলেন বর্ষীয়ান কমরেড। ঘরে একটি চৌকি। একটাই চেয়ার। শবনম চেয়ারে বসল। দীপু বসল চৌকির এক কোনে, কমরেড রতন সেনের পাশে ।শবনমকে দেখে যেন কিঞ্চিৎ অবাক হলেন চিরকুমার রাজনীতিবিদ। পরবর্তীকালে এঁকে খুলনায় অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল স্বার্থান্বেষী মহলের ইঙ্গিতে।
দরজার কাছে ১৯৮২ সালের ১ মার্চের রোদ ঝলমল করছিল।
সাইফুল আপনার ঠিকানা দিল।
ওহ্ । আপনার নামই কি আরিফুল ইসলাম দীপু?
জ্বী।
আপনিই কি এই নিবন্ধটি লিখেছেন? বলে ‘উত্তরাধিকার’ নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা এগিয়ে দিলেন প্রবীণ কমরেড। পত্রিকাটি দীপুর লেখা ‘তেপান্তরের মাঠের সন্ধানে’ নামক নিবন্ধটি ছেপেছিল। পত্রিকাটির সহম্পাদক কবি হুমায়ুন রেজা দীপুর কলেজ জীবনের বন্ধু।
হ্যাঁ।
আপনি তা হলে তেপান্তরের মাঠ খুঁজছেন?
হ্যাঁ।
পেলেন? কররেড মিটমিট করে হাসছেন।
না এখনও পাইনি, তবে পাবো বলে আশা আছে। তবে আমি বিশ্বাস করি তেপান্তরের মাঠের নীচে রয়েছে মূল্যবান সম্পদ।
প্রবীণ কমরেড হাসলেন। জিগ্যেস করলেন, বাংলাদেশ তাহলে অতীব সম্পদশালী?
অবশ্যই। তবে বাংলাদেশের আসল সম্পদ হল এর ভাবসম্পদ। দীপু বলল।
কমরেড মাথা নাড়লেন। বললেন, তাহলে এর সম্পদ বাঁচাতে জান দেবেন তো?
অবশ্যই। আমি আপনার কাছে শপথ করলাম।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর ওরা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। কমরেড অনিল মুখার্জীর লেখা বই উপহার দিলেন কমরেড রতন সেন।
শবনমের মুখ গম্ভীর। বলল, এসব রাজনীতি কি ছাড়া যায় না?
ধুরও কি যে বল। দীপু হাসে। বলে, আজ আমার সত্যিকারের রাজনীতির হাতেখড়ি হল। কতদিনের ইচ্ছে দিল কমরেড রতন সেনকে দেখব।
শবনম শাঁশায়। বলে, কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল এরশাদ বাংলাদেশের ক্ষমতা নিতে যাচ্ছেন। জান?
কে বলল? দীপু চমকে ওঠে।
আজ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আব্বা বলল । শবনমের বাবা জাস্টিস মীর্জা রেজা আদিল উচ্চ আদালতের একজন জাঁদরেল বিচারপতি। এদের না-জানিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার পালা বদল হয় না।
তুমি রাজনীতি ছাড়বে কি ছাড়বে না বল? শবনমের কন্ঠস্বর সিরিয়াস শোনায়।
না। আমার পক্ষে রাজনীতি থেকে দূরে থাকা সম্ভব না। বলে সিগারেট ধরায় দীপু। হাত কাঁপছে।
তা হলে আমি অনার্স পরীক্ষা দেব বলছি।
আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ! দীপুর কন্ঠস্বর চড়ে যায়।
শবনম চুপ করে থাকে।
তুমি অনার্স পরীক্ষা দেবে না দেবে তা তোমার ইচ্ছে। বলে গনগনে মুখে ধোঁওয়া ছাড়ল দীপু।
শবনমের মুখও গনগনে হয়ে উঠেছে। গলির মুখে এসে পড়েছে ওরা। একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ে। একাই।
দীপু শূন্য বোধ করলেও সামলে নেয়। বাংলাদেশ শবনমেরও চেয়ে অনেকই বড়। বাসায় ফিরতে হবে। ও বাসস্টপের দিকে হাঁটতে থাকে। ...গতকাল ছোট খালারা এসেছেন। ছোট খালুর কিডনিতে সমস্যা। তার চিকিৎসা করাতে। সমস্ত দৌড়ঝাঁপ দীপুকেই করতে হবে। ছোট খালু অনেক বদলে গেছেন। আজকাল তাবলীগ করেন; দাড়ি রেখেছেন, পাগড়ীও পরেন। ছোট খালা আগের মতোই আছেন। তবে সন্তানের মা হতে পারেননি। তবে মুখের হাসি মুছে যায়নি। ...বিকেলের আগেই মালিবাগের বাড়িতে ফিরল। মায়ের জ্বর। টুনির বিয়ে কথাবার্তা চলছে। দীপুর বাবা সাদাসিদে মানুষ, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করেন। দীপুকেই সব দেখতে হয়। কয়েকটা টিউশনীও করে। শবনম আর অনার্স শেষ করল না। ও বিদেশ চলে গেল। দীপু অনার্স আর মাস্টাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হল। যোগ দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মা মারা গেল । বিয়ে করল দীপু। স্ত্রী নীলুফার -দু-বছরের জুনিয়র কলিগ।
সময় কেমন করে কেটে যায় ...
এখন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে সেসব কথা মনে পড়ে যায় অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম দীপুর । প্রখর রোদে জ্বলে যাচ্ছে ঢাকা শহর। কপালের ঘাম মুছে অধ্যাপিকা নাজমূন নাহার জিগ্যেস করলেন, পেট্রোবাংলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ড. সালমান রশীদ আপনার আত্মীয়?
অধ্যাপক আরিফ মাথা নাড়েন। হাসেন। সালমান পড়াশোনা করেছে আমেরিকার মিনোসোটায়। সালমান সম্ভবত
ভাদ্র মাসের ঝকঝকে দিন, মেঘশূন্য নীলাভ আকাশে চিলপাখিদের ওড়াওড়ি, শীর্ণ সোহাগী নদীর পাড়ের মাঠে চিলপাখিদের চলন্ত ছায়া, এই সব নিঝ্ঝুম ভাদ্রের দিনে ফুলতলীর পথ-ঘাট, গাছপালা সব কেমন টানটান হয়ে থাকা, তালপুকুর, আমবন ...এইসব শ্যামল নির্জন সুন্দর পাড়াগাঁ আর বড় খালার ধনে পাতা দিয়ে রাঁধা কই মাছ তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে।
নাজমূন নাহার জিগ্যেস করলেন, অধ্যাপক আরিফ?
জ্বী। বলুন। দূরে হাইকোর্টের দিকে হেলমেট পরা পুলিশের একটা ব্যাটেলিয়ন ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। সেদিকে চোখ রেখে অধ্যাপক আরিফ বললেন।
আপনি তেপান্তরের মাঠ খুঁজছেন অধ্যাপক আরিফ?
হ্যাঁ।
পেলেন?
অধ্যাপক আরিফ হাসলেন। কমরেড রতন সেনের মুখটি মনে পড়ে গেল তাঁর। পকেট থেকে রূমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, না, এখনও পাইনি। তবে জানি যে তেপান্তরের মাঠ নিচে রয়েছে অমূল্য সব সম্পদ । নাজমূন নাহার হেসে বললেন, যে সম্পদ রক্ষার জন্য একটু পর আমরা স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির ইঙ্গিতে পুলিশের বেধড়ক লাঠির বাড়ি খেতে যাচ্ছি-কী বলেন?
হ্যাঁ, তাই তো। অধ্যাপক আরিফও হাসলেন।

সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:২৬
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আব্বাসীয় কুরাইশ বেশি যোগ্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৫




সূরাঃ ২ বাকারা, ১২৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
১২৪। আর যখন তোমার প্রতিপালক ইব্রাহীমকে কয়েকটি বাক্য (কালিমাত) দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন, পরে সে তা পূর্ণ করেছিল; তিনি বললেন নিশ্চয়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুমার নামাজে এক অভূতপূর্ব ঘটনা

লিখেছেন সাব্বির আহমেদ সাকিল, ১০ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০



মসজিদের ভেতর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বাহিরে বিছিয়ে দেয়া চটে বসে আছি । রোদের প্রখরতা বেশ কড়া । গা ঘেমে ভিজে ওঠার অবস্থা । মুয়াজ্জিন ইকামাত দিলেন, নামাজ শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×