somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"এই ঘর এই লোকালয়"/ শফিকুল ইসলাম

২০ শে জুলাই, ২০১০ সকাল ৯:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"এই ঘর এই লোকালয়"
গ্রন্থ পর্যালোচনায়--মিলি চৌধুরী


কবিতা জীবনেরই প্রতিচছবি । জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা যা মানুষকে করে রাখে স্মৃতি কাতর । সেই কাতরতার শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে সাহিত্যের এই প্রিয় ভূবন কবিতার মাঝে । কবি বা লেখক তার আপন মনের মাধূরী মিশিয়ে চয়ন করে তোলে কবিতার শরীর । বলা যায় - যা পাওয়া হয়নি ,যা পাবার কথা ছিলো যা পাওয়া যেতো -তা না পাবার প্রয়াসও ঘটে কবিতার ছত্রে । মানুষের জীবনটাই চাওয়ার সাথে পাওয়ার অমিলে পরিপূর্ণ । একথা জেনেও বিবাগী মন বার বার অবাধ্য হয় , অবুঝ বিশ্বাসে প্রতারিত হয়ে ফিরে আসে নিজের মাঝেই । আর তখন এক বৈপরিত্যের নিঃশব্দ যন্ত্রনায় ত বিত হয় ভেতরের জগত । তাইতো অবলীলায় সেই যন্ত্রণাকে কবিতার মাঝে তুলে ধরে কবি ।

কবি শফিকুল ইসলাম এক জীবন বিদগ্ধ চেতনার কবি । হৃদয়ের টানাপোড়নের কথামালা তিনি অসাধারন মমতা ও মেধায় তুলে এনেছেন তার কাব্যগ্রন্থ "এই ঘর এই লোকালয় " এ । ২০০০সালের ২১ শে বই মেলায় এর প্রথম প্রকাশ । ছোট বড় তেষট্টি কবিতার সমাহার ঘটেছে এই কাব্য গ্রন্থে । কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম করনেই কবিতার বইয়ের নাম করন । প্রতিটির কবিতার নাম করনে বিশেষত্ব দেখা যায় দীর্ঘতা । সাধারনত সংক্ষিপ্ত নামেই কবিতার নাম হয় । এখানে তার ব্যতিক্রম দেখা যায় । আর তাই প্রতিটি কবিতায় নাম করনের মাঝে নতুনত্ব পাওয়া যায় ।

এ গ্রন্থের প্রায় অধিকাংশ কবিতাই বিরহ বেদনায় ভারী । কবির ভালোবাসার জগতের পুরো অংশই না পাবার অথবা পেয়ে হারাবার কষ্টকে গভীর অভিমানে লালন করেছেন ,যা কবিতায় তুলে ধরতে কবি একটু ও দ্বিধাবোধ করেন নি । কবির এই সাহসী উচ্চারনে প্রতিটি কবিতায় হয়ে উঠেছে অসাধারন মনোগ্রাহী ও সুখপাঠ্য । বেদনার রূপ কি একই রকম হয় ? হয়তোবা । নতুবা কবির বিরহ ,স্মৃতি কাতর কিছু কিছু কবিতা মনে হয় যেন এ বেদনা নিজের জীবনেরই প্রতিরূপ । নিশ্চয় এটা ভাবা অন্যায় হবেনা । আর এখানেই তো কবির স্বার্থকতা ।

আমাদের আলোচনায় এই গ্রন্থের শেষ থেকেই শুরু করতে চাই । সর্বশেষ কবিতার নাম - "তোমার বাগানে ফুল ফুটিয়ে" ।

"তোমার জন্যে রেখে যাব সুর ,
তোমার জন্যে গান ,
আমার জন্যে রয়ে যাবে অশ্রু,
আমার জন্যে কান্না।
----------------------
তোমার জন্যে রেখে যাব কবিতা
ভালবাসার লাজ রক্তিম পংক্তিমালা
আমার জন্য নিয়ে যাব
অন্তমিলহীন অন্ত্যজ শব্দমালা"।

এই কবিতার অন্তর্নিহিত কষ্টকে কবি প্রকাশ করেছেন সুন্দর করে । কবি প্রিয়াকে উজাড় করে সব দিয়ে নিঃস্ব হতে চান । "তোমার চলে যাওয়া মানে" কবিতায় কবি প্রিয়াকে আগলে রাখতে চান । হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসার মাধুরী দিয়ে । তিনি যেন ধরেই নিয়েছেন তার আকুতিতে প্রিয়তমা ফিরে আসবেই । কবির আরেকটি কবিতা "আজ মনে হয় তোমাকে ভালবেসে " এ কবিতার প্রথম দুটি চরণেই কবি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন ,ভালোবাসা কিনেছেন দুঃখের দামে । তাই চারপাশ ম্লান হয়ে গেছে প্রিয়ার চলে যাবার কারণে ।

কবির কবিতা "একদিন এসেছিলে ,ভালবেসেছিলে " কবির মনে স্রোতের মতো ভালবাসার প্লাবন এসেছিল । যদিও ছল করেই প্রিয়ার আসা যাওয়া ,তবুও কবির বিশ্বাস সে এসেছিল এবং তাকে ভাল ও বেসেছিল । কিন্তু কিভাবে অজানা কারনে প্রিয়াকে কবি ধরে রাখতে পারেননি । মানুষের মনে বিচিত্র রূপের অবয়ব কবির কাছে দুর্বোধ্য লেগেছে । আর তাই কবিতার শেষ পংক্তিতে জানিয়েছেনঃ

"...সেদিনকার প্রতিটি দৃশ্যপট ছিল অনুপম মোহনীয়
আর তোমার রূপের বিভায় উদ্ভাসিত।
একদিন এসেছিলে ,
আর ভালবেসেছিলে ,
মনে আছে, আজ ও মনে আছে" ।

কবি ভূলতে পারেন না বলেই বারংবার কন্ঠরোধ হয়ে যায় নিরবিচিছন্ন বেদনায় । "আকাশের চাঁদ ছিল "কবিতায় কবি প্রিয়াকে চাঁদের চেয়েও অনুপম সৌন্দর্যে দেখেছেন । ফুল,পাখি,নদী সব আছে শুধু চাঁদের রূপকে হারিয়ে দেয়া সেই মানুষটি হারিয়ে গেছে...।

"জানিনা তুমি আমার কথা ভাবো কিনা "এই কবিতায় কবি মিথ্যে সান্ত্বনায় নিজেকে তবিত করেছেন । প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন অসংখ্যবার । মেলেনি উত্তর । পেয়ে হারাবার বেদনা ও কষ্ট কবিকে তাড়িত করেছে । অবশেষে কবি প্রশ্নহীন থেকে মনকে প্রবোধ দিয়েছেন "যতদিন এ মন থাকবে ততদিন এ মন-বেদনার শেষ হবেনা জানি"।

"যেখানেই যাই ,যেদিকে তাকাই" কবিতায় কবি দারুনভাবে স্মৃতিকাতর । তার জীবনের সকল আয়োজনে প্রিয়ার স্মৃতি তাকে সতত তাড়িত করে ফিরছে । স্মৃতি কখনো সুখের হয় ,কিন্তু এ কবিতায় স্মৃতি কষ্টের জোছনায় প্লাবিত । তবুও প্রিয়ার অতীত স্মৃতি কবিকে বেদনা বিধূর করে তুলেছে । "কতকাল এই বিষন্ন শূন্যতায়" এ কবিতায় কবি হারাবার বেদনাকে একদিকে যেমন বুকের ভেতর লালন করেছেন পরম মমতায় , অন্যদিকে না পাবার অদেখা কষ্টানুভুতিকে চারিদিকে ছড়িয়ে যেন বা হালকা হতে চেয়েছেন ।

এই কাব্য গ্রন্থের সকল কবিতার মাঝেই না দেখা হারানোর যন্ত্রণা যা কবিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাড়িত করেছে । মনের গভীরে সযতনে ভালোবাসার মানুষটিকে স্থান দিয়েছেন যদিও তার বিচেছদ সান্ত্বনায় মেনে নিয়েছেন। এ এক ধরণের অভিমান বৈতো আর কিছু নয় । কবি প্রিয়াকে জোর করে ধরে রাখার পপাতী নন । তাই ভূল করে যে চলে গেছে তার চলে যাওয়াকে কবি নীরবেই মেনে নিয়েছেন । ‌"ওফেলিয়ার" মতো যদিও প্রিয়াকে তার ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু তাকে আর ফিরে আসার আহ্বান জানাননি । একবুক নীরব অভিমানে কবি যোজন দূরত্বে অবস্থান করছেন । মানব মনের এ এক নিগূঢ় রহস্য ।

আলোচনার শেষে বলা যায় - এ কাব্য গ্রন্থের সকল কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কবিতাই কাব্যমানে সমৃদ্ধ । পরিশীলিত,হৃদয়গ্রাহী । কবিতাগুলো এক নিঃশ্বাসে পড়ে মুগ্ধ হবার মতো । অতিরিক্ত শব্দ চয়নের প্রয়াস নেই , বরং প্রতিটি কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শব্দ চয়নে, গাঁথনে, সজ্জায় যথেষ্ট মেধা ও মননশীলতার পরিচয় রেখেছেন যা কবিকে কাব্য সাহিত্যে দৃঢ় আসন রাখতে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস করি ।

মানুষের সারাটি জীবনই বিচিত্রতায় ভরা । আর রহস্যময় মানব মনের যে না দেখা জগত ভালোবাসার এবং যাকে ঘিরে কবির সুখ দুঃখের বিচরণ আর সব চাওয়া -প্রাপ্তি পূর্ণতাকে অবহেলা করে প্রিয়ার চলে যাওয়া এ নীরব আকুতি আর শুন্যতার ছবি পরম দতায় কবি এঁকেছেন তার কাব্যে । আমরা আশা করবো কবি তার লেখনী চালিয়ে যাবেন আরো অনেকদিন । পাঠক পাবে মননশীল সাহিত্য । কবিকে সানন্দ অভিনন্দন জানালাম,এমন সুন্দর শিল্প সুষমামন্ডিত কাব্য আমাদের উপহার দেয়ার জন্য । প্রবর্তন প্রকাশন ঢাকা থেকে প্রকাশিত "এই ঘর এই লোকালয" কাব্য গ্রন্থটি। জয়তু কবি ।


ইমেইলঃ [email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১০ দুপুর ১:১০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×