somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সমুদ্রে জীবন -৭

১৯ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জাহাজে অসুখ-বিসুখ আর disaster বা accident-এর পর্বটা তো সম্পূর্ণ শেষ হলো না - কিছু রয়েই গেল/গেছে। আমার জাহজে কখনো খুব মারাত্মক কিছু ঘটে নি - তবে আমাদের কোম্পানী ৬০+ জাহাজের অনেক কয়টিতেই দুর্ঘটনাজনক মৃত্যু যেমন ঘটেছে, তেমনি জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে যাবার মত দুর্ঘটনাও ঘটেছে।

আমাদের কোম্পানীতে নিজেদের জাহাজগুলোর মাঝে সার্কুলেশনের জন্য বেশ কিছু ম্যাগ্যাজিনের মত জিনিস ছিল - যার একটি ছিল Fleet Safety News । এর মাধ্যমে আমরা কোন জাহাজে কি ঘটলো তা জানতে পারতাম। অধিকাংশ দুর্ঘটনার সাথে human error-এর একটা সম্পর্ক থাকতো! মানুষ তো আর রোবট নয় - সে কখনো একটা জানা ব্যাপারও ভুলে যেতে পারে - আবার কোন একটা ব্যাপার তার চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আমাদের কোম্পানীর জাহাজে কখনো ৮টা বা ১০টা জাতীয়তার মানুষজন একসঙ্গে থাকতো। আমার মনে আছে, একবার আমরা যখন একটা জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটের Fort Vancouver-এ(Canada-র Vancouver BC নয়) যাই, তখন আমাদের ঐ জাহাজে ৮টা nationality-র লোক ছিল: বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, মালোয়েশিয়া, ঘানা, ফিলিপিন্স ও ভারত। ওখানকার নাবিকদের ক্লাব থেকে লোকজন এসে আমাদের ক্রুদের ছবি তুলে নিয়ে যায় - আমাদের জাহাজকে United Nations আখ্যায়িত করে। কিন্তু United Nations অবস্থাটা জাহাজের কাজের সমন্বয়ের জন্য খুব ভালো না - কারণ ভাব ও বাচণভঙ্গীর পার্থক্যের জন্য, কখনো হয়তো কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে - যদিও জাহাজ ও কোম্পানীর তরফ থেকে ট্রেনিং, drill তথা exercise-এর মাধ্যমে এই পার্থক্য বা "দুরত্বকে" ঘষে মেজে যথাসাধ্য কমানোর চেস্টা করা হয়!

আমি যখন এই কোম্পানীতে প্রথম যোগ দেই, তখন একজন ভারতীয় মারাঠী অফিসারের কাছ থেকে আমি জাহাজটা বুঝে নিয়ছিলাম (take over করেছিলাম)। সাধারণত ভারতীয় মেরিনারদের সাথে বাংলাদেশী মেরিনারদের বিশেষ একটা "যায় না"! কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে, আমার প্রতি ঐ ভদ্রলোক খুবই cooperative ছিলেন। জাহাজের ডকিং হচ্ছিল - আমরা কয়েকদিন double up করলাম। আমার চেয়ে বয়সে ১০ বছরের বড় - ঐ ভদ্রলোক আমাকে কোম্পানীর নিয়ম কানুন সহ জাহাজের defects গুলো তথা ডকিং এর করণীয়সমূহ বুঝিয়ে দিলেন। এর বেশ কিছুদিন পর Fleet Safety News-এর মাধ্যমে খবর পেলাম যে, আমাদের কোম্পানীর আরেকটা জাহাজ ভীষণ ঝড়ে পড়েছিল। জাহাজের পেছনে অবস্থিত steering gear রুমের water-tight door (সম্ভবত) ঠিক মত বন্ধ না থাকায়, সেটাতে পানি ঢুকে flooded হয়ে যায় এবং তার ফলশ্রুতিতে steering gear বা জাহাজের "হাল" অকেজো হয়ে পড়ে। ঝড়ের ভিতর, রাতের বেলায় steering fail করার ব্যাপারটা এক অকল্পনীয় দুঃস্বপ্ন। যাহোক ঐ দুঃস্বপ্নময় ক্রান্তিলগ্নে অনেকেই steering gear রুমে ছুটে যান কি হয়েছে বা কি করা যায় দেখতে - যাদের ভিতর ঐ ভদ্রলোকও একজন। তবে তিনি সম্ভবত একা এবং সবার আগেই সেখানে যান। এরপর সবাই যখন ফিরে আসেন তখন বোঝা গেল ঐ ভদ্রলোক missing। পরে আবার তার খোঁজে steering gear রুমে গিয়ে অন্যরা তার মৃতদেহ আবিষ্কার করেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয় যে, প্রচন্ড রোলিং-এর ভিতর তিনি ওখানে গেলে সম্ভবত প্রথমে তিনি কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়ে, মাথায় আঘাত পেয়ে ফ্লোরে পড়ে যান। এবং তারপর জমা পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় থেকে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

জাহাজে এসব অবস্থা মোকাবেলার জন্য সুনির্দিস্ট documented procedures থাকে এবং সেগুলোর উপর একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর drill বা exercise হয়ে থাকে। কিন্তু, real life crisis-এ অনেক সময়ই, পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে গিয়ে ঐ সব documented procedures ঠিক মত মেনে চলা হয় না - যে যেমন পারেন ছুটে গিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রও অনেকটা তাই হয়েছিল! আর সকল ইন্ডাস্ট্রীর মতই জাহাজ কোম্পানীগুলোও, এই ধরনের disaster বা accident-এর সকল দায়-দায়িত্ব জাহাজের ক্রুদের উপর বা human error-এর উপর চাপিয়ে দিতে চায়। আগে যেমন বলেছি, এসব দুর্ঘটনার জন্য human error-ই প্রধানত দায়ী - কথাটা সত্য হলেও, কর্পোরেট জগতের এই "blame game" কালচারটা আমার কখনো পছন্দ হয় নি। এসব করে তাদের লাভ হচ্ছে: একদিকে তারা ব্যবস্থাপত্রে কোন ত্রুটি রাখে নি এটা যেমন প্রমাণিত হয় এবং তারা "বদনাম" থেকে বেঁচে যায়, অপরদিকে ইনস্যুরেন্স ছাড়া নিজেদের তরফ থেকে কোন বাড়তি compensation দিতে হয় না। আমাদের এই অঞ্চলে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মত compensation শিকারী "trial lawyers"-দের দৌরাত্ম্য তেমন একটা নেই, তবু কোম্পানীগুলো এসব নিয়ে বেশ ত্রস্ত থাকে বলেই আমার মনে হয়েছে! যাহোক, ঐ মারাঠী ভদ্রলোক মারা যাবার পর, কোম্পানী মোটামুটি ঘটনা/দুর্ঘটনার সকল দায়-দায়িত্ব জাহজের ক্রুদের উপর চাপিয়ে দিল - যদিও তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি জানাতে ভুল করে নি তারা। মারাঠী ঐ অফিসারের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসাবে, তার স্ত্রী ইনস্যুরেন্স এবং সিঙ্গাপুরের জাহাজী অফিসারদের ইউনিয়ন থেকে মোট ২ লাখ ডলার পান। ঐ পয়সা নাকি ভদ্রলোকের পরিবার (মা-ভাই গং) নিয়ে নিতে চাচ্ছিল - কিন্তু আমাদের কোম্পানীর মধ্যস্থতায় ও ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যন্ত স্ত্রী-সন্তানই তা পান।

তার মৃত্যুর খবর শুনে, তার সাথে আমার সহ অবস্থানের শেষের দিকের কিছু সংলাপ মনে পড়ছিল। ঐ কোম্পানীতে একদম নবীন আমি, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তিনি আর কত দিন sail করবেন? তিন আমায় বলেছিলেন যে, তখন থেকে আর ৫ বছর মত! কাকতালীয় ভাবে তার কাছ থেকে আলাদা হবার ৫ বছরের মাথায় আমি তার মৃত্যু সংবাদ শুনেছিলাম!



গত দিন আমার প্রাক্তন একটা জাহাজের যে ছবিটা দিয়েছিলাম, আমার নিজের সেটা পছন্দ হয় নি। অথচ জাহাজটা আমার প্রিয় জাহজগুলোর একট - বেশ কিছু নিভৃত ও একান্ত স্মৃতি বিজড়িত - সে কথা না হয় আরেকদিন বলা যাবে! Container, tanker বা bulk carrier যে কোন জাহাজই খালি অবস্থায় দেখতে বিশ্রী লাগে - ঐ ছবিটাও হয়তো আপনাদের কারো কাছে বিশ্রী লেগে থাকতে পারে! আজ ঐ জাহজেরই সুন্দর ২টি ছবি দেয়া হচ্ছে। উপরে জাহাজখানাকে দেখছেন আমেরিকার মিসিসিপি নদীতে চলমান অকস্থায়। আর নীচের ছবিতে বার্থের কাছাকাছি থাকা অবস্থায়। জাহাজের বাণিজ্যিক নামটা ইচ্ছা করেই মুছে দেয়া হয়েছে!

২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×