somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: জলের আয়না

১৪ ই জুলাই, ২০১০ সকাল ১০:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পন্ডিত চন্দ্রকান্তর কথায় বিষ্ণুপুর রাজ্যের মহারাজা সামন্ত সেন-এর ভুঁরু কুঁচকে উঠল।
বল কি পন্ডিত!
হ্যাঁ রাজামশায়। পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বললেন।
আজ মহারাজা সামন্ত সেন হালকা মেজাজে ছিলেন। সকাল বেলায় সভাসদ্ নিয়ে বসে খোশগল্প করছিলেন। কথায় কথায় মহারাজা জিগ্যেস করেছিলেন: ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কেন। তখন পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বললেন, মহারাজ, আমরা যাকে ঈশ্বর বলি ...
হ্যাঁ।
তিনি হলেন নারী ...
নারী! মহারাজা সামন্ত সেন আঁতকে উঠলেন।
হ্যাঁ, রাজামশায়, নারী। পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বললেন। স্ত্রীলোক যেমন আয়নায় মুখ না দেখে পারে না, তেমনি নারীরূপী ঈশ্বর নিজেকে দেখবেন বলেই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন।
কথাটা শুনে মহারাজা সামন্ত সেন অনেক ক্ষন গুম হয়ে বসে রইলেন। পন্ডিত চন্দ্রকান্ত যা বললেন তা কি সত্য ? মেয়েরা আয়নায় মুখ দেখে বটে ...কিন্তু তাই বলে ... পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বৃদ্ধ হয়েছেন। চন্দ্রকান্ত সমতট রাজ্যের বিশিষ্ট তান্ত্রিক পন্ডিত; বঙ্গজুড়ে মেঘনা পাড়ের সমতট রাজ্যের নারীবাদী পন্ডিতগনের সুনাম আছে। পন্ডিত চন্দ্রকান্তর কথায় অবিশ্বাস করা যায় কি? মহারাজা সামন্ত সেন পন্ডিত চন্দ্রকান্ত কে বললেন, নারীরূপী ঈশ্বর নিজেকে দেখবে বলেই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন আর এ জন্যই স্ত্রীলোক আয়নায় মুখ না দেখে পারে না?
হ্যাঁ রাজামশায়। পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বললেন।
সভাসদ্ নিঃস্তব্দ।
রাজার থলথলে গোলাকার মুখে ঘাম ফুটতে শুরু করেছে। উদ্বেগ বোধ করছেন তিনি। রানী মহামায়ার মুখটি মনে পড়ে গেল তার। রানী মহামায়া মহারাজা সামন্ত সেন-এর স্ত্রী, অতি বিচক্ষনা ও মেধাবী নারী; রাজা ঠিকই জানেন- রানীর সুপরামর্শ ব্যতীত রাজ্যপরিচালনা সম্ভব নয়। তবে কি অনাদি অনন্ত মহাচেতনা নারীরূপে জগতে অবস্থান করছেন?
মহারাজা সামন্ত সেন শিউরে উঠলেন।
পন্ডিত চন্দ্রকান্ত বললেন, আপনি না হয় আজই ঢেঁড়া পিটিয়ে দিতে বলুন-এ রাজ্যের মেয়েদের আয়নায় মুখ দেখা নিষেধ। তারপর চর লাগিয়ে দেবেন।
কেন?
তাহলেই চরের মুখে শুনবেন মেয়েদের আয়নায় মুখ দেখা নিষেধ করায় রাজ্যজুড়ে নারীমহলে কেমন কান্নাকাটি পড়ে গেছে। তখনই টের পাবেন আমার কথা সত্য কি মিথ্যা।
মহারাজা সামন্ত সেন যেন কথাটা বুঝতে পারলেন। তিনি রীতিমতো হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, তবে তাই হোক।
তবে তাই হোক। সভাসদ্গন প্রতিধ্বনি তুলল।
পন্ডিত চন্দ্রকান্ত মুচকি হাসলেন।
অন্তঃপুরে প্রবেশ করে মহারাজা সামন্ত সেন রানী মহামায়া কে তার নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানালেন।
রানী মহামায়া মুচকি হাসলেন।



পরদিনই রাজার পাইক-পেয়াদারা বিষ্ণুপুর রাজ্যজুড়ে এই বলে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিল:

অদ্য হইতে এ রাজ্যের নারীগনের আয়নায় মুখ দেখা নিষেধ :
অদ্য হইতে এ রাজ্যের নারীগনের আয়নায় মুখ দেখা নিষেধ :
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করিলে কঠিন রাজদন্ড ভোগ করিতে হইবে।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করিলে কঠিন রাজদন্ড ভোগ করিতে হইবে।

শুধু তাই নয় রাজার সৈন্যসামন্তরা বিষ্ণুপুর রাজ্যের কৃষকের বাড়ি বাড়ি ঢুকে জোর করে আয়না ছিনিয়ে নিল, তারপর ভেঙে ফেলতে লাগল।
মেয়েদের চিৎকার তাদের পাষান হৃদয় গলাল না।



উপমা ।
বিষ্ণুপুর রাজ্যের এক কিশোরী কৃষককন্যা।
আজ রাতে উপমার চোখে ঘুম আসছিল না। বিছনায় শুয়ে ছটফট করছিল ও। তার কারণ আছে। উপমা আজ সারাদিন আয়নায় ওর শ্যামল সুন্দর মুখটি দেখতে পায়নি। আয়নায় মুখ দেখ নিষেধ- বাবা কাল দুপুরে হাট থেকে ফিরে কথাটা জানাতেই উপমা এক দৌড়ে ঘর থেকে ওর আয়নাখানি বাড়ির পিছনের খড়ের গাদায় লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর সামন্ত রাজার পাইক-পেয়াদারা যখন আয়নার খোঁজে এ বাড়ি এল তখন ওদের একজনের কেমন সন্দেহ হল। চলে যাওয়ার সময় হাসতে হাসতে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেল ওরা । ভাগ্যিস বাড়িতে আগুন ধরে যায় নি...এসব কারণেই এক ধরনের অস্থিরতা উপমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর অস্থিরতার কারণেই চোখ থেকে ঘুম পালিয়েছে।
বাইরে আজ রাতটায় কিন্তু জোছনার বান ডেকেছে। সঙ্গে উথাল-পাথাল বাতাস। জানালার ফাঁক গলে জোছনার কিছু সাদা আলো মাটির ঘরটিতে ঢুকে পড়েছিল।
হঠাৎই কি মনে হতে উপমা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। তারপর দরজা খুলে প্রথমে অন্ধকার দাওয়ায় ও পরে আলোকিত উঠানে নেমে এল। উঠান ঘেরা সার সার নাড়কেল গাছ। তার পাতায় পাতায় বাতাসের খুব জোর শব্দ হচ্ছিল। প্রবল বাতাস যেন উপমাকে ঠেলে ফেলে দেবে।
উপমা হাঁটতে থাকে।
বাঁশঝাড়েরর পাশ দিয়ে জ্যোøালোকিত পথ। সে পথ অর্ধাবৃত্তাকারে চলে গেছে তেপান্তরের মাঠের দিকে। তেপান্তরের মাঠের পুব দিকে তালতমালের বিস্তীর্ণ ঘন বন। সে তালতমালের বনের দক্ষিণে বিশাল এক চতুস্কোন পদ্মদিঘী। সে দিঘীর জল এখন ধবল জোছনার কারণেই তরল রূপার মতন দেখায়। পদ্মদিঘীর পাড়ে পাড়ে কত না গাছগাছালি। এখন নিঃস্তব্দ রাতের জোছনার ভিতরে পদ্মদিঘীর জলে দিকে ঝুঁকে রয়েছে যেন।
আকাশপথে টি টি করে ডেকে উড়ে গেল একঝাঁক রাতচরা পাখি।
উপমা চমকে উঠল কি?
না, ও বরং মুচকি হাসল।
পদ্মদিঘীর পূর্ব পাড়ে এসে দাঁড়াল উপমা ।দিঘীর ঠিক মাঝখানে পূর্ণ বয়স্কা চাঁদখানি ভাসছে। পদ্মদিঘীর পূর্ব পাড়ের ঘাটটি শ্বেতপাথরের বাঁধানো । উপমা ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ঘাটে নেমে এল।
তারপর উবু হয়ে বসল জলের কিনারে। তারপর পদ্মদিঘীর রূপাগলা জলে নিজের সুন্দর মুখটি দেখে নিয়ে মুচকি হাসল।
যদিও মাঝে-মাঝেই ঝিরিঝিরি বাতাসেরা এসে ভেঙে দিচ্ছিল জলের আয়নাটি ...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ১:১৫
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের সংগ্রামী জনতার স্লুইস গেট আক্রমণ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২১


(ছবির লাল দাগ দেয়া জায়গাটিতে গর্ত করা হয়েছিল)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

২৩শে এপ্রিল পাক সেনারা ফুলছড়ি থানা দখল করে। পাক সেনা এলাকায় প্রবেশ করায় মানুষের মধ্যে ভীতিভাব চলে আসে। কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাড়ির কাছে আরশিনগর

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ০৯ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫০


বাড়ির কাছে আরশিনগর
শিল্পকলা একাডেমির আশেপাশেই হবে চ্যানেলটার অফিস। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল মৃণাল। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এক-দু'জনকে জিগ্যেসও করল বটে, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছে না।

কিছুদূর এগোনোর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×