পানির হক আদায়ের আন্দোলন
ফরহাদ মজহার
শুধু একাত্তর সালেই বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের জনগণ আশ্রয় দেয়নি, জীবিকার সন্ধানে দেশ ছেড়ে যারা ভারতে পাড়ি দিয়েছে এখনো মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতার গরিব জনগণ ও মজলুম শ্রমিকেরা বাংলাদেশের গরিবদের ঠাঁই দিতে কুণ্ঠা করে না। ভারতের নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের শোষিত ও নিপিড়ত জনগণের অমিল খুব কম বরং মিলই বেশি।
বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে, এটা খুবই স্পষ্ট। ফারাক্কা বাঁধের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। এ দেশের জনগণ ‘কারবালা’ কথাটির অর্থ শুধু আক্ষরিক বা ঐতিহাসিক অর্থে বোঝে না। কেউ কাউকে পানিতে মারবার প্রচেষ্টার মধ্যে যে বীভৎস মানসিকতা কাজ করে তাকে বাংলাদেশের মানুষ কারবালার করুণ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে ঘৃণা করতে শিখেছে। ফারাক্কা বাংলাদেশকে কারবালায় পরিণত করেছে। এ উপমহাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের ইমাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যখন ফারাক্কার উদ্দেশে লংমার্চ করেছিলেন তখন তিনি এ বীভৎসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। তিনি ভারত কিংবা ভারতের জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাননি, তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সেই অপরিণামদর্শী নৃশংস মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যারা মানুষ শুধু নয়, গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গসহ যা কিছু প্রাণ ও প্রাণ রক্ষার শর্ত তাকেই ধ্বংস করে ফেলতে উদ্যত। এ ধরনের মানবতাবিরোধী ভারতের শাসকশ্রেণীর মধ্যে যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর মধ্যেও। উভয়েই পরস্পরের দোসর। এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে দুনিয়ার কোনো প্রাণেরই অস্তিত্ব থাকবে না। বাংলাদেশের জনগণের পক্ষেও বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
ফারাক্কার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে টিপাইমুখের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষোভ তীব্র হয়েছে। সেই ক্ষোভ আরো উত্তপ্ত হয়েছিল ওই সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তীর উন্নাসিক মন্তব্যে। তিনি শুধু কূটনৈতিক শিষ্টাচারই লঙ্ঘন করেননি, উজান ও ভাটির দেশের জনগণের মধ্যে আন্তর্জাতিক নদীপ্রবাহ সংক্রান্ত নীতির প্রতি কটাক্ষ করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জোর যার মুল্লুক তার। ভারত বড় দেশ, ভারতের ক্ষমতা আছে, অতএব ভারত নদীর উজানে যা খুশি তাই করবে। কারণ তাচ্ছিল্যের ভাষায় তখন তিনি বলেছিলেন, নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক বিধান নেই। পিনাক চক্রবর্তীর ভাষা ব্যবহার ও অঙ্গভঙ্গির মধ্যে এ দেশের জনগণ সেই প্রাচীন চেহারাটাই দেখেছিল ইতিহাসে যাকে তারা ‘এজিদ’ নামে চেনে।
গত বছর এ সময়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ‘ল্যাম্পপোস্ট’ নামে একটি সংগঠন ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছিল। আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কারণ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে যারা ফেনা তুলছে তাদের কাউকে আমরা তখন দেখিনি। দেখেছিলাম সেসব তরুণকে যাদের আমরা চিনি না। বিরোধী দলের বিস্তর হই চই শুনেছি, কিন্তু অতি গর্জনে বর্ষা নামে না। বাংলাদেশকে পানিশূন্য করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অধিকার যে কোনো নাগরিকের রয়েছে। এ অখ্যাত ক্ষুদ্র তরুণদের দল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছারই প্রকাশ করেছিল মাত্র। অথচ টেলিভিশনে আমরা দেখেছি পুলিশ পিটিয়ে একজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। রক্তাক্ত ও ভয়ানক আহত সেই তরুণকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করেছিল কয়েকজন পুলিশ। একজন তরুণকে খালি গা করে ফেলেছিল তারা, তার প্যান্ট নিয়ে কুৎসিতভাবে টানাটানি চলছিল।
মেয়েদের সঙ্গে হাতাহাতি করেছিল পুলিশ। তাদের ওপর নির্যাতনের যে ধরন দেখেছিলাম তাতে লজ্জিত না হয়ে পারা যায় না। দেখে মনে হয়েছিল, আমরা একটি অসভ্য দেশে বাস করছি। আমার প্রতিবাদ এ অসভ্যতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ অচিরেই পানিশূন্য মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। যাদের এ বছরের গরম ও উত্তরবঙ্গের খরার অভিজ্ঞতা হয়েছে তারা জানেন আমরা সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছি। এর বিরুদ্ধে আমরা বিক্ষোভ জানাতে পারব না? প্রতিবাদ করতে পারব না? এটা কী করে হয়?
এর আগে বিডিআরের ঘটনায় ভারতীয়দের ভূমিকা আছে বলে লিফলেট দেয়ায় একটি রাজনৈতিক দলের বিপুলসংখ্যক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভারত বন্ধু দেশ, তার নাকি সমালোচনা করা যাবে না। তাহলে তো একশ জনের মধ্যে ৯০ জন বাংলাদেশিকেই কারাগারে আটক রাখতে হয়। যে কোনো দল বা গোষ্ঠী রাজনীতি বা বক্তব্যের সঙ্গে আমাদের বিরোধ থাকতে পারে, আমরা একমত না থাকতে পারি। কিন্তু নিজের মত প্রকাশের ও চিন্তা জানান দেয়ার স্বাধীনতা আছে প্রত্যেকেরই। আমরা এখন ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বললে জেলে যেতে হবে, জেলে পচতে হবে কোনো জামিন ছাড়া। প্রতিবাদ জানালে পিটিয়ে আমাদের মাথা ফাটিয়ে দেয়া হবে। মেয়েদের নিয়ে পুলিশ টানাটানি করবে। বাংলাদেশের জনগণকে আজ এসব সহ্য করতে হচ্ছে।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় আমি পরিষ্কার করতে চাই। অতি সঙ্কীর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক ভারতবিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। ভারত কোনো একাট্টা, শ্রেণীহীন জাতপাত বর্ণহীন দেশ নয়। বাংলাদেশে যেমন গরিব মানুষ আছে, ভারতেও আছে। বাংলাদেশে যেমন শ্রমিক আছে ভারতেও আছে। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণীর বাংলাদেশের শাসক ও শোষক শ্রেণীর মতোই সমান মাত্রায় মুনাফাখোর, পরিবেশ ও জীবনবিরোধী এবং জনগণের শত্রু। শুধু একাত্তর সালেই বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের জনগণ আশ্রয় দেয়নি, জীবিকার সন্ধানে দেশ ছেড়ে যারা ভারতে পাড়ি দিয়েছে এখনো মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতার গরিব জনগণ ও মজলুম শ্রমিকেরা বাংলাদেশের গরিবদের ঠাঁই দিতে কুণ্ঠা করে না। ভারতের নিপীড়িত ও শোষিত জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের শোষিত ও নিপীড়ত জনগণের অমিল খুব কম বরং মিলই বেশি। পাকিস্তানি শাসকরা যেমন আমাদের জাতিগত নিপীড়ন চালিয়েছে, ভারতও কাশ্মির ও আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোতে আরো নৃশংস ও রক্তাক্ত কায়দায় ১৯৪৭ সাল থেকে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। আজ যেখানে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করার কথা উঠেছে, সেই মণিপুরের জনগণই স্বাধীনতার জন্য ভারতের সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। মণিপুর, মিজোরাম, আসামের জনগণও টিপাইমুখের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের শোষক ও শাসক শ্রেণীর ভূমিকা রুখে দিতে হবে অবশ্যই, কিন্তু ভারতবিরোধিতার আড়ালে ভারতের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মৈত্রীর সম্ভাবনাকে রুদ্ধ করে দেয়ার রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের হুশিয়ার থাকতে হবে। ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী বাংলাদেশকে তাদের অধীন রাখতে পারছে বাংলাদেশের শাসক ও শোষকদের সহযোগিতায়। ফলে লড়াই উভয় দেশের শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে। শুধু ভারতের বিরুদ্ধে নয়। বাংলাদেশে ভারতের শাসক ও শোষকদের দালালদের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে বাংলাদেশকে কী করে রক্ষা করব আমরা? ফলে যারা অতি সঙ্কীর্ণভাবে ফারাক্কা বা টিপাইমুখের বিরোধিতা করতে গিয়ে ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পাঁকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পতিত হচ্ছেন তাদের ঠিক পথ দেখানো আমাদের কাজ। মনে রাখা দরকার, ভারতের শাসক ও শোষক শ্রেণী ঠিক যে অর্থে আমাদের বন্ধু নয়, বাংলাদেশের শাসক ও শোষক শ্রেণীও ঠিক সেই অর্থেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের রক্ষক নয়।
সম্ভবত টিপাইমুখ ও পানির ওপর জনগণ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, জলজ প্রাণীর অধিকার আদায়ের লড়াই উপমহাদেশে নতুন বিপ্লবী রাজনীতির সূচনা করবে। যার খানিক ইশারা আমরা মওলানা ভাসানীর ফারাক্কার বিরুদ্ধে লংমার্চে দেখেছিলাম। মওলানার পরিবেশ আন্দোলনকে নিছকই ‘আধুনিক’ পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। তিনি জানতেন ‘আধুনিকতা’ ও ‘সাম্র্রাজ্যবাদ’ সমার্থক। তিনি তার আন্দোলনকে বরং আরো গভীর আন্তরিক তাগিদ ও সৃষ্টির প্রতি গভীর মমতা ও ভালোবাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষা আমাদের দিয়েছেন। তার ভাষায় এর নাম ‘রবুবিয়াত’ বা বিশ্ব পালনকর্তার স্বভাব আয়ত্ত করে প্রাণ, প্রাণের শর্ত ও পরিবেশ রক্ষা করা। পানির ওপর শুধু মানুষের ‘হক’ নেই, প্রতিটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রাণীটিরও ‘হক’ আছে। সেই হক আদায় করার মধ্য দিয়েই মানুষ দীন বা ধর্মের পথে কামিয়াব হয়।
ফরহাদ মজহার: কবি ও চিন্তাবিদ।
[সূত্রঃ যায় যায় দিন, ১১/০৭১০]
Click This Link