আমার ভেতরে বিশ্বকাপের উন্মাদনা এখন ক্লিনিক্যালি ডেড। দর্শক হিসেবে এখন আমি, শুধুই আসন পূর্ণ করার জন্য খেলা দেখি । যদিও আমার বিশ্বকাপ দর্শনের শুরুটা ছিল ব্যাপক উন্মাদনাময়। উন্মাদনায় কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিলেন না আমার বাবাও। কারেন্টের্ এই অবস্থার কথা চিন্তা করে যিনি মূল টিভির প্রতি ভরসা করতে পারলেননা। আর্জেন্টিনার নয়নজুড়ানো একটি পাসও মিস যাতে না হয়, আর্জেন্টিনার জয়যাত্রার কোনো মূহুর্ত যাতে দেখা থেকে বাদ না পড়ে তিনি বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বললেন।
কিনে আনলাম, ব্যাটারীতে চলে এমন একটা টিভি ১০" টিভি। এক মাসের জন্য ভাড়া করে আনলাম ব্যাটরীও। সমগ্র জাতির মতই মহা উৎসাহে চলতে তাকে আমাদের বিশ্বকাপ দর্শন। আমি আর আমার এক ভাই গড়পরতা সব খেলাই দেখি। বাবা বিকাল আর সন্ধ্যারাতেরটা। ব্যস্ততায় নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ না পাওয়া বাবার রাত্রীকালিন খেলা দেখা হয়না। শুধু আর্জেন্টিনার বেলায় ব্যাতিক্রম। সে খেলার সময় বাবার কোনও নিঃশ্বাস ড্রয়িংরুমের বাইরে পড়েনা।
এভাবেই চলতে থাকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। আমরা এগিয়ে যাই মেসি, তেভেজ, হিগুয়ানের পায়ে পায়ে। আর ফুটবল ইশ্বরের ম্যারাডোনার হাতে হাত ধরে।
এলাকার কারেন্ট এবার স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সেবাআত্তি করল। যখনই কারেন্ট যাক, খেলা শুরুর মিনিটখানেক আগে হাজির। তাই খুব বেশি ব্যাবহার হচ্ছিলনা আমাদের ব্যাটারী চালিত দশ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি। আমরা মূল টিভিতেই আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনার জয় রথ দেখছিলাম।
ম্যারাডোনার উচ্ছাসে বাবা হাসেন। ম্যারাডোনার আক্ষেপে বাবাও চিন্তিত হন। শেষ হিসেবে জয়ের ভুভুজেলা বাজিয়ে যখন ম্যারাডোনা ফিরেন সাজ ঘরে, বাবাও ফিরে যান তার ঘরে। বোঝা যায়, সাউথ আফ্রিকার ভুভুজেলার সুর তার ভেতরেও।
একটা সময় ভুভুজেলা শব্দ কমে এল। প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে দাঁড়াল জার্মান। বাবা যতটুকু খোঁজ খবর রাখেন তাতে নিশ্চিত জানেন জার্মান এবার কঠিন টিম। তাও স্বীকার করেননা। বলেন, আরে দেখ।
আমরাও দেখি। তিনিও দেখেন। দেখতে দেখেতে আমাদের চোখ আর ধরেনা। আমাদের চোখ বিশ্বাস করতে পারে না। বিশ্বাস করতে চায়না। ইউরোপিয়ান পাওয়ার ফুটবলে গুড়ো হয়ে যায় লাতিন শৈল্পিকতা। আর গুড়ো হয় আমাদের স্বপ্ন।
তবে শেষ অবধি স্বপ্ন বাঁচানোর সেকি চেষ্টা ছিল আমাদের। জার্মান তিন গোল করেছে সময় আছে বিশ পচিশ মিনিট বা তারও কম। বাবা তখনও মানতে রাজী না, আর্জেন্টিনা হারবে। পরাজিত হবে ম্যারাডোনা। তখনও তিনি এক বিশেষ ঘটনার অপেক্ষায়। একটা কিছু ঘটবে।
কিন্তু শেষ অবধি তেমন কিছুই না ঘটলেও, ঘটল একটা দূর্ঘটনা। চলে গেলো আমাদের কারেন্ট। আমরা ততক্ষণে হারিয়ে ফেলেছি খেলা দেখার আগ্রহ। তাও বাবার জন্য ছাড়ালাম আমাদের সেই টিভি। যে টিভিতে আজেন্টিনার জয় দেখার কথা ছিল। দেখার কথা ছিল তাদের প্রতিটি পাস। অতঃপর সেই টিভিতে আমরা দেখলাম, জার্মানীর নয়নজুড়ানো পাস আর আর্জেন্টিনার পরাজয়ের করুণ দৃশ্য।
সাদাকালো টিভির সেই প্রভাব আমার ভেতরও ছুয়ে গেল। আমাদের বিশ্বকাপ দেখার রঙিন চোখ সাদাকালো হয়ে গেল। বুকের বামপাশে, যেখানে আর্জেন্টিনা আর ম্যারাডোনার জন্য জায়গা ছিল, সেখানে কেন জানি অনুভূত হতে লাগল কিঞ্চিত ব্যাথাও।
১৯৯০ থেকে ২০১০ এই বিশ বছরে যে মানুষটার জন্যই আসলে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা, বিশ্বকাপের সাথে বেড়ে ওঠা, সেই ম্যারাডোনা আর তার দলের বিদায়ে প্রাণবন্ত বিশ্বকাপ পরিনত হল নিতান্তই জড় বস্তুতে।
একজন আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ম্যারাডোনা আর আর্জেন্টিনাকে নিয়ে লেখা দেখে এসএমএস পাঠিয়েছে, ভাই, একজন কোকেনসেবী, ঋণ খেলাপি, মাদক পাচারকারীকে নিয়ে এত মাখামাখি আপনাকে মানায় না।
তাকে কী করে বুঝাই, ভাই রে ম্যারাডোনা তো নিজেই আরেক কোকেনের নাম। যে নেশায় ডুবে আছি আমরা।
আমার বাবা, তার ম্যারাডোনা আর দশ ইঞ্চি টিভির গল্প
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি
মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !
বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।
আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন
হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব
সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন
=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=
©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন