somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুষার যাত্রাঃ দক্ষিন মেরু.....

০৩ রা জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






দক্ষিণ মেরু (South Pole) বা ভৌগলিক দক্ষিণ মেরু হল অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে দক্ষিণ বিন্দু; যা উত্তর মেরুর ঠিক বিপরীতে অবস্থিত এবং যা প্রকৃত দক্ষিণ (True South) কে নির্দেশ করে। ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ মেরু হল দক্ষিণ গোলার্ধের সেই বিন্দু যেখানে ভূ-পৃষ্ঠকে পৃথিবীর উত্তর এবং দক্ষিন মেরুর কাল্পনিক সরলরেখা (পৃথিবীর অক্ষ) ছেদ করেছে। তবে লক্ষণীয় যে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু বা ভোগলিক দক্ষিণ মেরু আর ভূ-চুম্বকীয় মেরু দুইটি পৃথক জিনিস।

ভূ-প্রকৃতি ও অবস্থান
দক্ষিণ মেরু হল অ্যান্টার্কটিকার বৈশিষ্টহীন, ঝড়ো বাতাসময়, বরফে আচ্ছাদিত এক জায়গা, যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২,৮৩৫ মিটার (৯,৩০৬ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত এবং নিকটবর্তী সমুদ্র ম্যাকমুর্ডো সাউন্ড (McMurdo Sound) থেকে প্রায় ৮০০ মাইল (১,৩০০ কিমি) দূরে অবস্থিত। দক্ষিণ মেরুতে বরফের আচ্ছাদন প্রায় ২,৭০০ মিটার (৯,০০০ ফুট) পুরু অর্থ্যাৎ দক্ষিণ মেরুর প্রকৃত ভূ-পৃষ্ঠ প্রায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতার সমান।



উত্তর মেরুর মত কঠিন না হলেও দক্ষিন মেরুকে সুক্ষভাবে সনাক্ত করা মুশকিল। সময়ের সাথে সাথে দক্ষিণমেরুর অবস্থানও সামান্য পরিবর্তন হয়। এর কারন হল নিজ অক্ষের উপর পৃথিবীর ঘূর্ণণ সুষম নয়। তাছাড়া দক্ষিণ মেরুর বরফের আস্তরন প্রতি বছর গড়ে ১০ মিটার করে ৩৭-৪০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশের দিকে সরে যাচ্ছে। এভাবে পৃথিবীর সবচে দক্ষিণ বিন্দু (যার অবস্থান বরফের আস্তরনের উপর নির্ভরশীল) সময়ের প্রবাহের সাথে সাথে সামান্য পরিবর্তিত হয়।


আবিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রথম মানব হিসেবে দক্ষিণ মেরু জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন নরওয়ের অভিযাত্রী রোয়াল্ড এমুন্ডসেন (Roald Amundsen)। তিনি তাঁর দল নিয়ে ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দক্ষিণ মেরুতে সর্বপ্রথম পা রাখেন। রোয়াল্ড এমুন্ডসেনের পৌঁছার প্রায় একমাস পর তাঁর প্রতিযোগী রবার্ট ফ্যালকন স্কট (Robert Falcon Scott) দলবল নিয়ে দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান। তবে ফেরার পথে রবার্ট ফ্যালকন স্কট ও তাঁর সহযাত্রীরা প্রচন্ড ঠান্ডা এবং খাবার ফুরিয়ে যাবার কারনে মারা যান।


ছবিঃ রোয়াল্ড এমুন্ডসেন এবং তাঁর দল

১৯১৪ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী আর্নেস্ট স্যাকেলটন (Ernest Shackleton) জাহাজ নিয়ে দক্ষিণ মেরু পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন কিন্তু তাঁর জাহাজ বরফে আটকা পড়ে যায় এবং এর ১১ মাস পর তিনি মারা যান।

রোয়াল্ড এমুন্ডসেন এবং রবার্ট ফ্যালকন স্কট এর পর দীর্ঘদিন কেউ দক্ষিণ মেরুতে যাত্রা করেননি। এরপর ১৯৫৮ সালের ৪ জানুয়ারী দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছান এডমুন্ড হিলারি (নামটা চেনা চেনা লাগছে??...হ্যাঁ ইনিই সেই হিলারি যিনি প্রথম এভারেস্ট জয় করেন)

এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দক্ষিন মেরুতে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য অভিযাত্রীর পদধূলি পড়েছে।




আবহাওয়া ও জলবায়ু
উত্তর মেরুর মত দক্ষিন মেরুতেও দুইটি মৌসুম--গ্রীষ্মকাল আর শীতকাল। গ্রীষ্মকাল পুরোটাই দিন আর শীতকাল পুরোটাই রাত। এ কারনে দক্ষিন মেরুতে সুনির্দিষ্ট কোন ঘড়ির সময় নেই এবং পৃথিবীর ন্যায় কোন টাইম জোন নেই। উত্তর মেরুর চেয়ে দক্ষিন মেরুতে ঠান্ডা অনেক বেশি। কারন দক্ষিন মেরু সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে (৯,৩০৬ ফুট) আর উত্তর মেরু প্রায় সমুদ্র পৃষ্ঠের সমতলে অবস্থিত।

শীতকালে দক্ষিন মেরুতে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৬৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। দক্ষিন মেরুতে এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা মাইনাস ১৩.৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৮২.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।

দক্ষিন মেরুর জলবায়ু মরুময়। ঝড়ো হাওয়া আর তুষার-ঝড় এখানকার আবহাওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট। বাতাসের আর্দ্রতা প্রায় শুন্য। বৃষ্টিপাত হয় কালে ভদ্রে (২/৩ বছরে একবার)।





প্রবল বৈরী আবহাওয়ার কারনে দক্ষিন মেরুতে কোন প্রানি বা উদ্ভিদ জন্মায় না। তবে স্কুয়া (skua) নামক এক ধরনের পাখি সেখানে বছরে দু-একবার উড়তে দেখা যায়। এছাড়া সেখানে কিছু অনুজীব বসবাস করে বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন। তবে দক্ষিন মেরু ছাড়া অ্যান্টার্কটিকার বাকী অঞ্চল জুড়ে “কোট পড়া ভদ্রলোক”-- পেঙ্গুইনের বসবাস।


ছবিঃ স্কুয়া (skua)


ছবিঃ “কোট পড়া ভদ্রলোক”-- পেঙ্গুইন


দক্ষিনমেরু ও অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের সীমানা
দক্ষিন মেরুতে অফিসিয়ালি কোন সরকার নেই, কোন জনবসতি নেই। বিভিন্ন সময় পৃথিবীর সাতটি দেশ (আর্জেন্টিনা, চিলি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স) দক্ষিন মেরু সহ অ্যান্টার্কটিকার কিছু অংশ তাদের নিজেদের বলে দাবী করেছে। এ কারনে পরবর্তীতে অন্যান্য দেশগুলো মিলে Antarctic Treaty System গঠন করে এবং আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীর কোন দেশ দক্ষিন মেরু বা অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের মালিকানা দাবী করতে পারবে না।

অ্যান্টার্কটিকা এবং দক্ষিন মেরুর কয়েকটি মজার তথ্যঃ

১। ১৮২০ সালে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন রাশিয়ান এক অভিযাত্রী। খ্রীষ্ট্রের জন্মের পর প্রায় ১৮০০ বছর ধরে অ্যান্টার্কটিকা অনাবিষ্কৃত ছিল!
২। অ্যান্টার্কটিকা বিশ্বের সবচে শীতল, ঝড়ো আবহাওয়া পূর্ণ এবং শুষ্ক জায়গা।
৩। তাপমাত্রা অত্যাধিক কম থাকার কারনে অ্যান্টার্কটিকায় তুষার গলার আগেই তা সরাসরি বরফে পরিণত হয়।
৪। পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে অ্যান্টার্কটিকার Vostok Station এ---মাইনাস ৮৮.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড।
৫। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের ৯৮% অংশ বরফে আচ্ছাদিত।
৬। দক্ষিণ মেরুর অক্ষংশ আছে; দ্রাঘিমাংশ নাই (অক্ষাংশ ৯০ ডিগ্রি দক্ষিণ)
৭। দক্ষিন মেরুতে দাড়ালে সবকিছুই হবে আপনার উত্তরে। কারন দক্ষিণ মেরুতে দিক একটাই, তা হল উত্তর। বাকী তিনটি দিকের সেখানে বাস্তব অস্তিত্ব নাই (উত্তর মেরুর উল্টো)।
৮। পৃথিবীর নিজস্ব ঘুর্ণণের কারনে পৃথিবীর বুকের প্রত্যেক বস্তুরও গতি আছে; তবে আপনি যদি ঠিক দক্ষিণ মেরুতে দাড়ান তাহলে আপনার গতি হবে শুন্য (উত্তর মেরুতেও একই)।
৯। দক্ষিণ মেরুতে দাড়ালে আপনার কি মনে হবে বলুনতো? মনে হবে পৃথিবীর একেবারে নিচে পা উপরে আর মাথা নিচের দিকে দিয়ে উল্টোভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, তাইনা??....আপনাদের কি মনে হয়??


আগের দুটি পোস্টঃ

অজানা আমাজন অরন্য........

রহস্যময় উত্তর মেরু......
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:১০
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×