এখন আর কেউ অপেক্ষা করেনা
গভীর রাতে বাসায় ফিরে দেখি সোনসান নিরবতা। স্ত্রী দরজা খুলে দেন। কাপড় ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখি মা আমার বাথরুমে যাচ্ছে। আমি টিভির সুইস অন করে হয়তো রিমোর্ট টিপছি। এই চ্যানেল ওই চ্যানেল দেখছি। মা বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় যেতেন। একদিন, দু’দিন এক সপ্তাহ, দু’সপ্তাহ নয়। মাসের পর মাস। বছরের পর বছর এমনটা দেখছি। একদিন বুঝতে পারি যত রাতই হোক মা ঘুমান না। আমার জন্য অপেক্ষা করেন। আমার মুখ দেখার পরই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে যান।
মা’র গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে। নিয়মিত ওষুধ কিনে দেই। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করি- মা ওষুধ আছে? উত্তর দেন পুত আছে। আর দু’দিন যাবে। বললাম, ওষুধেতো এতোদিন যাওয়ার কথা না। তাহলে কি ওষুধ নিয়মিত খান না। মা বললেন, পুত খাই। তবে ডাক্তার বলেছে, সকালে একটা রাতে একটা ট্যাবলেট খাওয়ার আগে খেতে। আমি প্রতিদিন একটি করে খাই। বললাম, মা এটা কেন করেন? ডাক্তারে ২টা খেতে বলেছে, আপনি কেন একটা খাবেন? মা বললেন, ২টা করে খেলে যে তোমার বেশি টাকা লাগবে? মাকে জোর গলায় বললাম, এখন থেকে আর কোন দিন যেন এমন না হয়। ডাক্তার ২টি বলেছে, আপনাকে ২টিই খেতে হবে।
মা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। তাই কোথাও ঘুরতে গেলে, কিংবা অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ভাল ভাল মিষ্টি নিয়ে যেতাম। মা খুব খুশি হতেন। আমার মুখে আগে মিষ্টি তুলে দিয়ে তিনি মিষ্টি মুখে নিতেন। আমার ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর অনেকদিন মিষ্টি নিয়েছি। মার সামনে মিষ্টি দিলে বলতেন পুত এখন খাবনা। পরে খাব। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি। একদিন যশোরের স্পন্স মিষ্টি নিয়ে বাসায় ফিরি। রাত তখন সোয়া ২টা। সোফায় বসতেই দেখি মা বাথরুমে যা”্ছ।ে বুঝতে বাকি রইলোনা, মা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। স্ত্রীকে বললাম, সকালে পাউরুটি দিয়ে মাকে মিষ্টি দিও। স্ত্রী বললেন, মা এখন আর মিষ্টি খায়না। কেন? বলল, তোমার যেদিন থেকে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে সেদিন থেকে মাও মিষ্টি খায়না। অনেক দিন মিষ্টি দিয়েছি। মা বলেছে, আমার পুত মিষ্টি খেতে পারে না। এ মিষ্টি আমিও খাব না।
আমার অফিস মূলত বিকাল থেকে। তাই দুপুরে খাওয়ার পর বাসা থেকে বের হতাম। আমার খাওয়া শেষ হলেই মা পান হাতে আমার কাছে আসতেন। বলতেন. পুত আইসটা মুখে বের হতে নেই। নাও পানটা মুখে দিয়ে বাসা থেকে বের হও। কতদিন ‘পুত’ বলে আমাকে কেউ ডাকে না। এখনও গভীর রাতে বাসায় ফিরি। কিন্তু মায়ের পায়ের আওয়াজ শুনি না। এখন আর মা আমার জন্য অপেক্ষা করেন না। মা’ আমি তোমার ডাকের অপেক্ষায় প্রহর গুণি। কিন্তু না। তা কোন দিন আর সম্ভব নয়। আল্লাহ আমার মাকে বেহেস্ত নসিব করো।