somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিতৃত্ব

২১ শে জুন, ২০১০ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবার সাথে আমার ঘনিস্ঠতা কোনকালেই ছিলনা।ছোটোবেলা থেকেই তাকে জেনেছি দুরের মানুষ হিসেবে, আমি বড় হয়েছি খুলনার একটা গ্রামে আর বাবা চাকরি করতেন সিলেটে, বছরে একবার তিনি বাড়িতে আসতেন এক ঝুড়ি সিলেটি কমলা নিয়ে। বাবা বাড়িতে এলে কমলা খাবার আনন্দের চেয়েও ছোটখাটো কারনে রামধোলাই খাবার ভয়ে আস্থির থাকতাম সারাক্ষন। মনে মনে চাইতাম বাবা যেনো চার পাঁচ বছর পর পর বাড়িতে আসেন। তবু বাবা যখন থাকতেন না, মায়ের কাছথেকে কিছু আদায় করার সময় বাবা বাবা বলে কাঁদতাম মায়ের মন নরম করার জন্য। তারপর যখন বড় হলাম, বাবা চাকুরী জীবন শেষ করে বাড়িতে চলে এলেন, আর আমি ছাত্র জীবন শুরু করার জন্য বাড়ি ছাড়লাম, বাবার কাছাকাছি হওয়া আর হলনা। ছাত্র জীবন শেষ করে চলে এলাম আরো দুরে... প্রবাসে। তাই বাবাকে কখনো মিস করার মত অনুভূতি মনের ভেতর দানা বাধেনি।
অনেকগুলো দিন প্রবাসে কাটানোর পর দেশে গিয়ে বিয়ে করলাম।বাবা ছিলেন বদ মেজাজি, আমি ছিলাম জেদী। তাই যখন বাড়ি ফেরার এক মাসের মাথায় পারিবারিক ছোট একটা সমস্যা নিয়ে বাবা আমাকে হুট করে বলে ফেললেন, তুই আমার বাড়ি থেকে দুর হ, আমি ও অমনি লোটা-কম্বল ভাজ করে বাড়ি ছাড়লাম, মায়ের চোখের জল আমার পথ আগলাতে পারলোনা। আদরের ভাইঝির জামা টেনে ধরা ছোট্ট হাত ছাড়িয়ে নিলাম আনায়াসে। আমার প্রবাস জীবনের সব আয় বাড়ির পেছনে ব্যায় করেছিলাম, তাই হাত ও প্রায় শ্যুন্য। আট ভাইবোনের সবার ছোট হয়েও আমিই আমাদের পরিবারটাকে দরিদ্রাবস্হা থেকে মধ্যবিত্তের কোঠায় টেনে তুলেছিলাম, সেকারনেই হয়তো অভিমানটা ও একটু বেশি ছিল। বন্ধুদের সহায়তায় ছোটখাটো কিছু কাজ জুটিয়ে নিয়ে নতুন সংসার পেতে বসলাম। আমার বাবা কয়েকবার আমার বাসায় এসে আমাকে বাড়ি ফেরার জন্য অনুরোধ করলেও জেদের কারনে আমি আর বাড়িতে ফিরে যাইনি। বাবা, মায়ের অনুনয় আমার মন গলাতে পারেনি।
দিন গুলো সাধারন ভাবে কেটে যাচ্ছিল, এমন সময় একদিন আমার স্ত্রী আমাকে বাবা হবার সলজ্জ আগাম খবর শোনালো, সেই প্রথম আমি জানলাম একজন পিতার মন...... আমার স্বজনদের ভেতর তিনজন ডাক্টর, তাদের একজন স্ত্রী রোগ বিশারদ, সেই সুবাদে খুলনা শহরের আনেক ডাক্টর এবং ক্লিনিকে আমি কিছু বাড়তি সুবিধা পেতাম, স্ত্রী কে সারাক্ষনই চেকাপের উপর রাখলাম। দুজনের কত পরিকল্পনা আমাদের সন্তানকে নিয়ে, নাম ঠিক করা নিয়ে ঝগড়া, কাপড় তৈরি করা, বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় যত টুকিটাকি সব যোগাড় করে আমাদের ছোট্ট বাসাটাকে ভরে ফেললাম। পেটের উপর হাত দিয়ে অনুভব করতাম তার নাড়াচাড়া, কান পেতে থাকতাম একটু শব্দ শোনার আশায়, ছেলে নাকি মেয়ে হবে তা নিয়ে তুমুল তর্ক, নামাজ পড়ে প্রর্থনা করতাম, খোদা, আমাদের এমন একটা সন্তান দিও যে মানুষের সেবা করে বেহেস্তবাসী হতে পারে। আমার প্রবাস জীবনের বিদেশি বন্ধুরা এলো শুভেচ্ছা জানাতে, তারা আমার বাচ্চার জন্য জুতা, খেলনা আরো কত কি উপহার নিয়ে এলো....
কিন্তু একদিন কিযে হয়ে গেল !! ডাক্টরের হিসাবে ডেলিভারির আর মাত্র ১২ দিন বাকি, তখন একদিন রাতে হঠাৎ আমার স্ত্রী অনেক বমি করলো, তারপর থর থর করে কাপতে লাগলো। আমি ডাক্টর কে ফোন করে জানালাম, তিনি বললেন ব্যাথা বা ব্লিডিং না হলে ভয়ের কিছু নেই। স্ত্রীর কাছে জানলাম ওই দুটোর কোনোটাই নেই, তাই বিশ্রাম নিতে বললাম, ও ঘুমিয়ে পড়লো। হঠাৎ মাঝ রাতে জানালো আনেক ব্যাথা...তারপর উঠে বসতেই দেখালাম রক্তে বিছানা ভিজে যাচ্ছে...আমি উদ্ভ্রান্তের মত তাকে কোলে তুলে নিয়ে ছুটলাম, গভীর রাতে রাস্তায় কোন রিকসা ছিলনা, ওভাবে কিছুদুর দৌড়ানোর পর একটা রিকসা পেয়ে উঠে বসলাম, রিকসাওয়ালা অবস্থার গুরুত্ব বুঝে দ্রুত চালাতে লাগলো, রক্ত পড়ে রিকসার পাদানিতে জমে আমার খালি পায়ের গোড়ালি ডুবে গেছে টের পেলাম... যখন ক্লিনিকে পৌছুলাম, আমার স্ত্রীর তখন কোনো সাড়া নেই, তাকে সরাসরি ও.টি তে নেওয়া হল, ডাক্টর জানলেন আনেক রক্ত লাগবে...এক্ষুনি।। আমি সন্ধানী এবং রেডক্রীসেন্ট দুটির ই ডোনার ছিলাম, কিন্তু গভীর শীতের রাতে ফোন করে কাউকে পেলাম না.... রক্তে ভেজা সেই রিকসা নিয়ে আবার ছুটলাম রক্তের খোজে। আমার সারা শরীর ও তখন রক্তে ভেজা। এ বাসা- ও বাসা করে ভোর পর্যন্ত শুধু রক্তের যোগাড়ে হন্যে হয়ে ঘুরলাম। যাকেই পেলাম সোজা ক্লিনিকে পাঠিয়ে আবার ওন্যজনের খোজে.... সকালে যখন ফিরলাম, সেখানে অনেক লোক, জানলাম, আমার বাচ্চাটাকে বাচানো যায়নি, স্ত্রী ও মৃত্যু শয্যায়। আমার সারাটা পৃথিবী যেন চুরমার হয়ে গেল। হেটে গেলাম স্ত্রীর কেবিনের দিকে, ও.টির পাশে থমকে দাড়ালাম, দেখলাম অবহেলায় পড়ে থাকা একটা কাগজের ছোটো বাক্স থেকে ধবধবে শাদা ছোট্ট একটা পা বের হয়ে আছে, নার্স এসে জানালো ওটা আমারই আদরের শিশু, আমরা যাকে নীরা বলে ডাকবো ঠিক করেছিলাম। নার্স আমাকে আমার শিশুটির মুখ দেখাতে চাইলো, আমি কঠিন স্বরে বললাম, না। আল্লাহ তাকে তার পিতার মুখ দেখার সুযোগ দেননি, তার পিতা ও তার মুখ দেখবে না, আমি তাকে সেই দিন দেখবো, যেদিন সে ও আমাকে দেখতে পাবে।
সকালে সবাইকে দেখলাম, শুধু আমার বাবাকে দেখলাম না, বাবা কোথায় জানতে চাইলে কারো কাছে কোনো জবাব পেলাম না, আনেক চেস্টার পর জানলাম ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনে আমার বৃদ্ধ বাবা মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন, তাকে ওন্য একটা ক্লিনিকে রাখা হয়েছে। আমি ছুটে গেলাম বাবার কাছে, দেখলাম তার ডান পাশ অচল হয়ে গেছে, কথা ও বন্ধ, আমি বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বহু বহু দিন পর এই প্রথম ডুকরে কেদে উঠলাম... আমার চোখের জল আর বাবার চোখের জল মিলেমিশে একাকার হেয়ে গেল।
তাপর অনেক দিন হয়ে গ্যাছে, আমি আবার ও প্রবাসি, মাঝেমাঝে মনেহয়, আমার নীরা বেচে থাকলে কি এখন গান গাইতে শিখতো? হয়তো জানালার গ্রীল ধরে গুন-গুন করে উঠতো... কাটেনা সময় যখন আর কিছুতে....... অথবা এখন হয়তো দুরে কোনো তারার দেশে বসে গাইছে.. কে জানে!!

১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×