somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তরুণদের ভাবনায় রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ

১৯ শে জুন, ২০১০ সকাল ৮:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



তরুণদের ভাবনায় রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ

তরুণদের নিয়ে আমাদের আশা ও স্বপ্নের শেষ নেই। সে তরুণরা যদি সঠিক ইতিহাস না জানে এবং ভুল জেনে বিভ্রান্ত হয় ও ভুল পথে হাঁটতে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই জাতির জন্যও সম্ভাবনা অনেক কমে আসে। হঠাৎ শুনলে প্রশ্ন জাগতে পারে। কথা উঠেছে আসলে সম্প্রতি প্রকাশিত বৃটিশ কাউন্সিলের একটি জরিপের প্ররিপ্রেক্ষিতে। ‘বাংলাদেশ : আগামী প্রজন্ম' শীর্ষক এই জরিপে দেখা গেছে, ৮৮ শতাংশ তরুণ জানিয়েছে তারা সুখী; ৯৮ শতাংশ জানিয়েছে, তারা সমাজসেবায় যুক্ত হতে চায়। তাদের মধ্যে ৩০ শতাংশ এখনই এলাকার সেবামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত। ৬৪ শতাংশ মনে করে, আগামী পাঁচ বছরে দেশ মৌলবাদী হওয়ার আশংকা নেই। একই সঙ্গে তারা এ আশংকাও ব্যক্ত করেছে যে, আগামী পাঁচ বছরে দেশে দুর্নীতি বেড়ে যাবে। বছরব্যাপী পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ তরুণ বিদেশে চলে যেতে চায়। প্রথম কারণ, দেশে লেখাপড়ার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই এবং তাদের জ্ঞান কাজে লাগানোর মতো উৎপাদনমুখী পরিবেশ দেশে গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় কারণ, দেশে সঠিক কর্মসংস্থানের অভাব রয়েছে এবং চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। তৃতীয় কারণ, বেশি আয় করতে হলে দেশে সম্ভব নয়।
রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে তরুণদের ভাবনা ছিল জরিপের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। কারণ ৭৪ শতাংশ তরুণ জানিয়েছে, তারা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়। ৩৬ শতাংশ বলেছে, তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির কুপ্রভাব সম্পর্কে সচেতন এবং ২৫ শতাংশ মনে করে, ছাত্র রাজনীতি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হওয়া উচিত। তরুণদের অন্য একটি কথাও যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। ৭৬ শতাংশ বলেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের তেমন ভূমিকা নেই।
জরিপের পদ্ধতি বা মেথডোলজি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, যাদের অভিমত নেয়া হয়েছে তারা সমাজের কোন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে কিংবা মাত্র দেড়-দু' হাজার তরুণের বক্তব্যকেই দেশের তরুণ সমাজের বক্তব্য হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি না- এ ধরনের সঙ্গত প্রশ্নও অনেকে করতে পারেন। তা সত্ত্বেও জরিপটিকে সাধারণভাবে গুরুত্বের সঙ্গেই নেয়া হয়েছে। আলোচনায় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ছাত্র সংগঠন এবং রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের ব্যাপারে তরুণদের অভিমত। দেখা গেছে, বর্তমান সরকারের আমলে চলমান হত্যা-সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, লেজুড়বৃত্তি প্রভৃতি কারণে তরুণদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছাত্র রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। এমন মনোভাব অবশ্যই শুভ কোনো ইঙ্গিত বা বার্তা দেয় না। কারণ, তরুণরা দেশকে পাল্টে ফেলতে পারে। অতীতের বিভিন্ন সংগ্রামে তরুণরাই অংশ নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বও তারাই দিয়েছে। আর এসব কিছুর পেছনে ছিল রাজনৈতিক দল, ছিল রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেমিক সংগ্রামী ভূমিকা। সে রাজনীতিবিদদের ব্যাপারেই তরুণরা যদি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত জাতির জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। সুতরাং বেশি দরকার তরুণদের সঠিক ইতিহাস জানানো। এটা একটি মাত্র নিবন্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এখানে এমন কিছু তথ্যের উল্লেখ করা হবে, যেগুলো অত্মত এটুকু বুঝতে সাহায্য করবে যে, কিছুই রাতারাতি ঘটেনি এবং বড়কথা, ছাত্র রাজনীতির ওপর দলীয় প্রভাবের মতো বিষয়গুলোর জন্য ছাত্র সংগঠন বা ছাত্ররা দায়ী নয়।
প্রথমে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উদাহরণ দেয়া যাক। আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ কিন্তু পাকিস্তান যুগে আজকের মতো অঙ্গ সংগঠনের অবস্থানে ছিল না। এ সম্পর্কে জানা যাবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস স্মরণ করলে। দলটির প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা উপস্থাপন করেছিলেন ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগে ভাঙন ঘটেছিল। ১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট গঠিত হয়েছিল ‘পিডিএমপন্থী' আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব তখন ছিলেন ‘ছয় দফাপন্থী' আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাকিস্তানের কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি ও এনডিএফ-এর সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এ যোগ দেয়ায় আওয়ামী লীগের শেখ মুজিব বিরোধী অংশটি ‘পিডিএমপন্থী' নামে পরিচিতি পেয়েছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ছয় দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি সত্ত্বেও ছাত্রলীগ কিন্তু খন্ডিত হয়নি। ছাত্রলীগে ভাঙন ঘটেছিল অনেক পরে- ১৯৬৯ সালে। ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত হয়েছিল বাংলা ছাত্রলীগ নামে পৃথক একটি সংগঠন। অর্থাৎ ছাত্র সংগঠন তখন পর্যত্মও স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
একই বিষয় দেখা গেছে মওলানা ভাসানীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পন্থা এবং গণচীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থন দেয়া-না দেয়াসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। সে বছরের ৩০ নভেম্বর মস্কোপন্থীদের বহিষ্কার করা হয়। তারা ডিসেম্বরে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিক খান আবদুল ওয়ালী খানের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ন্যাপ গঠন করেছিলেন। অথচ ন্যাপ সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন কিন্তু বিভক্ত হয়েছিল অনেক আগে- ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে। পৃথক দুটি সংগঠন তৎপরতা চালিয়েছে একই নেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে। এ থেকেও প্রমাণিত হয়, পাকিস্তান আমলের প্রায় শেষদিনগুলো পর্যন্তও এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো স্বাধীন সত্ত্বা নিয়েই তৎপর ছিল। তাদের ওপর রাজনীতিকরা সরাসরি খবরদারি করতেন না। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্নে সমর্থন করলেও ছাত্র সংগঠনগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের অন্ধ অনুসরণ করতো না। লেজুড়বৃত্তি করার তো প্রশ্নই ছিল না।
পরিস্থিতিতে পরিবর্তন ঘটেছিল স্বাধীনতার পর। ছাত্রলীগের সম্মেলন উদ্বোধন করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব এই পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। এরপর অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোও তাকে অনুসরণ করেছে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও বাঙলা ছাত্র ইউনিয়ন মওলানা ভাসানীর ন্যাপকে অনুসরণ করেছে। আরেক ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির অধীনস্থ হয়ে পড়েছে, ছাত্রলীগের দ্বিখন্ডিত অংশ চলে গেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের অধীনে। পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ছাত্রলীগ যেমন আওয়ামী লীগের, ছাত্রদলও তেমনি বিএনপির অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এই ধারায় ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল এরশাদ জাতীয় ছাত্র সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এভাবেই বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব খুইয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের অবস্থানে এসে পড়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের কোনো ত্রুটি ছিল না। সুতরাং রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য ছাত্র সংগঠনকে দায়ী করা যায় না।
তরুণদের মধ্যে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণ বুঝতেও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রধান কারণ নিশ্চয়ই রাজনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক। অথচ পাকিস্তানযুগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরও কিছুদিন পর্যন্ত রাজনীতিকদের মধ্যকার সম্পর্ক চমৎকারই ছিল। উদাহরণ হিসেবে এখানে শেখ মুজিবুর রহমান ও আবদুস সালাম খানের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবের প্রতিদ্বদ্বী সালাম খান ছিলেন ‘পিডিএমপন্থী' আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী করার পর এই সালাম খানই শেখ মুজিবের প্রধান আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করেছিলেন। এজন্য কেউ তাকে অনুরোধ করেনি, তিনি নিজে থেকেই ঝুঁকিটি নিয়েছিলেন। স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার, ওই দিনগুলোতে শেখ মুজিবের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো তেমন বিশিষ্ট কোনো আইনজীবী ছিলেন না। সবার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার এবং আইয়ুব সরকারের কোপানলে পড়ার মারাত্মক ভীতি কাজ করছিল। কিন্তু সালাম খান দুর্দান্ত সাহসিকতা শুধু নয়, শেখ মুজিবের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবেরও প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন- যদিও আওয়ামী লীগ কখনো এই সাহসী আইনজীবী ও রাজনীতিকের প্রতি সম্মান দেখায় না।
পাঠকরা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বেগম খালেদা জিয়াকে কোনো মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কোনো আইনজীবী তার পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় প্রধান আইনজীবী হিসেবে মামলা পরিচালনা করতে এগিয়ে এলেন শেখ হাসিনা। বাস্তবে এমন অবস্থা কল্পনাও করা যায় না। কার দায়িত্ব বেশি সে প্রশ্নে না গিয়ে বলা দরকার, দুই নেত্রীর মধ্যে বহুদিন ধরে এমনকি টেলিফোনে কথা বলার সম্পর্কও নেই। পাকিত্মানযুগে কিন্তু রাজনীতিকদের সম্পর্ক এতটা শত্রুতাপূর্ণ বা অসুন্দর ছিল না। নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রশ্নে মতপার্থক্য ও প্রতিদ্বনিদ্বতা থাকলেও অনেকেই অনেকের ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন। যেমন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী, খান আবদুস সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পর্ক নিয়ে প্রচুর গল্প-কাহিনী রয়েছে। শেখ মুজিব যখন কারাগারে থাকতেন তখন তার সংসার চালানোর জন্য অনেকের মধ্যে সাহায্য করেছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী (শেখ মুজিবের জ্ঞাত কোনো আয়ের উৎস ছিল না- না তিনি ব্যবসা করতেন, না তার কোনো চাকরি ছিল)। বিশেষ করে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে নিজে গিয়ে বেগম মুজিবের হাতে চেক বা টাকা দিয়ে আসতেন বলে বেশ কিছু উপলক্ষে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি শেখ হাসিনাকেও সাক্ষী মেনেছেন। কিন্তু কোনো উপলক্ষেই শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের অন্য কোনো নেতা প্রতিবাদ জানাননি। এখন শুনতে খারাপ লাগলেও সে সময় এটাই স্বাভাবিক ছিল। যেমন শোনা যায়, ফজলুল কাদের চৌধুরীকে হত্যা করার সংবাদ শুনে শেখ মুজিব নাকি হায় হায় করে উঠেছিলেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার এক বন্ধুকে বাঁচাতে পারেননি।
স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন বিরোধী দলের প্রধান নেতা। কিন্তু জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রশ্নে আলোচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বহুবার দেখা করেছেন। তিনি এমনকি রাতের বেলায়ও একা একা সন্তোষে চলে যেতেন। খন্দকার মোশতাক আহমাদসহ কোনো কোনো মন্ত্রী ঈদের সময় মওলানা ভাসানীর জন্য লুঙ্গি ও পাঞ্জাবীর কাপড় পাঠাতেন। সঙ্গে স্যান্ডেল বা চপ্পলও। এখন লজ্জাকর মনে হলেও সে আমলে এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ, তাদের প্রত্যেকেই এক সময় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মওলানা ভাসানী তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। শেখ মুজিবকে মওলানা ভাসানী নিজের ছেলে বলে সম্বোধন করতেন। দু'জনের সম্পর্ক ছিল পিতা ও পুত্রের মতো। মুজিবোত্তর বাংলাদেশেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। যেমন সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। দেখা করতেন। শেখ হাসিনার প্রতিও জিয়া উদার মনোভাবই দেখিয়েছিলেন। মূলত প্রেসিডেন্ট জিয়ার সদিচ্ছা ও উদারতার কারণেই শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছিলেন। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত পৈত্রিক বাসভবনটিও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। তখনও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ক্ষত সেরে ওঠেনি, জনগণের মধ্যে বাকশালী শাসন-বিরোধী ক্ষোভও ছিল প্রচন্ড। তা সত্ত্বেও দেশকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে সে সময় ব্র্যাকেটবন্দী খান তিনেক দলের আবির্ভাব ঘটেছিল। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন উপদলটি প্রধান আওয়ামী লীগের অবস্থান অর্জন করেছিল। কিন্তু সেখানে সভাপতির পদ নিয়ে সংঘাত মারত্মক হয়ে ওঠে। আপস ফর্মুলা হিসেবে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী বানানো হয়। শেখ হাসিনা তখন ভারতের আশ্রিতা হিসেবে নয়াদিল্লিতে বসবাস করছিলেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন ওঠে। একটি মহল বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঘোষণা করেন, শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা অবাধে দেশে ফিরে আসতে এবং বসবাস করতে পারেন। এই ঘোষণার পরই নয়াদিল্লি থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল (১৭ মে, ১৯৮১)। প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু শেখ হাসিনাকেই ফিরিয়ে আনেননি, নিজে উদ্যোগী হয়ে তাকে তার পৈত্রিক বাসভবনটিও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জিয়ার নির্দেশে বাসভবনের প্রতিটি জিনিসের বিস্তারিত তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে তালিকায় শেখ মুজিবের পাইপ ও চশমা, সোনার মুকুট, অলংকার, নগদ টাকা, মার্কিন ডলার, ভারতীয় রূপী, বৃটিশ পাউন্ড এবং কাপড়-চোপড় ও আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাইসেন্সবিহীন কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র, সেগুলোর গুলি এবং গ্রেনেডও ছিল। শেখ হাসিনা প্রতিটি জিনিস তালিকার সঙ্গে একটি একটি করে মিলিয়ে ও যাচাই করে তারপর লিখিতভাবে বুঝে নিয়েছিলেন। নেননি শুধু আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। এর ক'দিন পরই চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানে মৃত্যু ঘটেছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার (৩০ মে, ১৯৮১)। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সদিচ্ছা ও উদারতায় যিনি দেশে আসার সুযোগ ও পৈত্রিক বাসভবন ফিরে পেয়েছিলেন সে নেত্রী শেখ হাসিনাই এখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার স্ত্রী ও সন্তানদের ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উৎখাত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এর মধ্য দিয়েও রাজনীতিকদের মনোভাবে পরিবর্তন ঘটার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে পিলখানা হত্যাকান্ডের উল্লেখ করা যায়। গোয়েন্দা ব্যর্থতা থেকে বিদ্রোহীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা পর্যত্ম বিভিন্ন কারণে সে সময় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। সেনাবাহিনীকে অপারেশন চালাতে না দেয়া এবং সম্পূর্ণ সামরিক সমস্যায় রাজনৈতিক সমাধানের নামে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার মতো বিষয়গুলো নিন্দিত হয়েছিল। সাবেক ও বর্তমান সেনা অফিসার এবং সামরিক বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আলোচনার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সেনাবাহিনীকে অভিযান চালাতে দেয়া। এতগুলো হত্যাকান্ড ঘটানোর কথা জেনেও কেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা হলো অথচ বিরোধী দলকে ডাকা হলো না- সে প্রশ্ন তুলেছিলেন খালেদা জিয়া। জবাবে রীতিমতো তেড়ে উঠেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিডিআরের ঘটনায় বিরোধী দলের ‘রাজনৈতিক ইন্ধন' ছিল বলে অভিযোগ তুলে বসেছেন তিনি। বলেছেন, মিউটিনি ঘটাতে যাদের উদ্যোগ ছিল তারা সফল হতে পারেনি বলেই তাদের ‘অন্তর্জ্বালা'! এই ঘটনার সূত্র ধরে ‘অন্য কিছু' হয়নি বলে তারা মনের দুঃখে অন্যের দোষ খোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে। কারো নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, দেশের সেনাবাহিনীকে নিয়ে যারা বারবার খেলছে সেই ‘খেলনেওয়ালারা' এবারো ‘খেলে' গেছে। বিরোধী দলকে কেন ডাকা হয়নি- এই অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা আমার ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল যে, কাউকে ‘দাওয়াত' দিতে হবে!
‘ওনারা' এবং ‘খেলনেওয়ালা' বলতে শেখ হাসিনা ঠিক কাদের বুঝিয়েছিলেন, সে কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরনের আক্রমণাত্মক ভাষণ মোটেও সময়োপযোগী হয়নি। ছেলে-মেয়ের বিয়েতে ‘দাওয়াত' দেয়া সম্পর্কে স্বাভাবিক অবস্থায় বললে কথাটা দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠতো। অন্যদিকে ওই পরিস্থিতিতে মানুষের মনে পড়ে গেছে ভারত-পাকিত্মানের কারগিল যুদ্ধের কথা। ১৯৯৯ সালে সংঘটিত যুদ্ধের দিনগুলোতে ভারতের সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা এক সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। উপলক্ষ অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ছেলে বা মেয়ের বিয়ে ছিল না (বাজপেয়ী বিয়ে-শাদীই করেননি!)। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী দেশের দুঃসময়ে সরকারের সমর্থনে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছিলেন। নেতারাও এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। গত বছরের নভেম্বরে মুম্বাইয়ের তাজ ও ওবেরয় হোটেলে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। সেখানেও প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং বিরোধী দলের নেতা লালকৃষ্ণ আদভানী গিয়েছিলেন এক সঙ্গে। অর্থাৎ জাতীয় সংকটে ভারতের সরকার ও বিরোধী দল দাঁড়িয়েছিল একই মঞ্চে। পিলখানা হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একটি নজীর তৈরি করতে পারতেন। এটা তার দায়িত্বও ছিল। অন্যদিকে তিনি হেঁটেছেন বাঁকা পথ ধরে। বিরোধী দলকে তিনি ‘খেলনেওয়ালা' বানিয়ে ছেড়েছেন!
এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা ও উদাহরণই উল্লেখ করা যায়, যেগুলোর মধ্য দিয়ে পরিস্কার হয়ে যাবে, ঠিক কোন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক নেতাদের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যকার চমৎকার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে এবং কেন তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়েছে। তরুণরা কেন ছাত্র রাজনীতি দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেও নিশ্চয়ই কষ্ট করতে হবে না। অবস্থায় অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো দরকার। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সেই অংশকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে- যারা নিজেরা এবং যাদের পূর্বসুরিরা একদিকে রাজনীতিবিদদের মধ্যকার সুসম্পর্ক নষ্ট করেছেন এবং অন্যদিকে এককালের স্বাধীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন বানিয়ে ফেলেছেন।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×