বাংলা ভাষা সাহিত্যে ও সংগীতের এক অতি পরিচিত নাম অতুল প্রসাদ সেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও গায়ক। বাংলাভাষীদের নিকট অতুল প্রসাদ সেন প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তাঁর গানগুলি মূলত স্বদেশি সংগীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান; এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরণের গানেই কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ-রস প্রধান।
১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর তাঁর জন্ম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ বিক্রমপুরের মগর গ্রামে। বাল্য কালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগবদ্ভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। পরবর্তীকালে মাতামহের এসব গুণ তাঁর মাঝেও সঞ্চালিত হয়। অতুল প্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর কিছুদিন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর বিলেত থেকে ব্যারিষ্টারি পাশ করে তিনি কলকাতা ও রংপুরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে তিনি একজন শ্রেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং আউধ বার এ্যাসোসিয়েশন ও আউধ বার কাউন্সিলরের সভাপতি নির্বাচিত হন। লক্ষ্ণৌ নগরীর সংস্কৃতি ও জীবনধারার সঙ্গেও তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েন।
অতুল প্রসাদ প্রবাসী ( বর্তমান নিখিল-ভারত) বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলন প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি উক্ত সম্মিলনের মুখপত্র উত্তরার একজন সম্পাদক এবং সম্মিলনের কানপুর ও গোরখপুর অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন, পরে লিবারেলপন্থী হন। অতুলপ্রসাদ তাঁর সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থেরও বৃহৎ অংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় করেন। এমনকি তিনি তাঁর বাসগৃহ ও গ্রন্থস্বত্বও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্র প্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যাঁরা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুল প্রসাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সমকালীন গীতিকারদের তুলনায় তাঁর সংগীত সংখ্যা সীমিত হলেও অতুল প্রসাদের অনেক গানে সাঙ্গীতিক মৌলিকত্ব পরিলক্ষিত হয়; আর সে কারণেই তিনি বাংলা সংগীত জগতে এক স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছেন। তাঁর গানগুলি অতুল প্রসাদের গান নামে বিশেষ ভাবে প্রতিষ্ঠিত।
১৯০২ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অতুল প্রসাদ আইন ব্যবসা উপলক্ষে লক্ষ্ণৌতে অতিবাহিত করেন। সে সময় তাঁর বাংলোতে প্রায় প্রতি সন্ধায়ই গানের আসর বসতো। আর সেই আসরে গান শোনাতে আসতেন আহম্মদ খলিফ খাঁ, বরকৎ আলী খাঁ এবং আব্দুল করিমের মতো বিখ্যাত ওস্তাদগণ। ভালো সঙ্গীতের আসর পেলে তিনি আদালত ও মক্কেলদের কথাও ভুলে যেতেন। অতুল প্রসাদ অধিকাংশ গান লক্ষ্ণৌতেই রচনা করেন। তাঁর সর্বমোট গানের সংখ্যা মাত্র ২০৬টি এবং সে সবের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে প্রাধান্য পায়। অতুল প্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকালি (১৯৩০) নামে দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর অপর গানগুলিও গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্রোপাধ্যায়ের কন্ঠে।
পরবর্তীকালে যেসব শিল্পী তাঁর গান গেয়েছেন তাঁরা সুর-তালের ক্ষেত্রে বেশ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করায় তা নিয়ে সর্বমহলে বির্তকের সৃষ্টি হয়। বাংলা সাহিত্যে অতুল প্রসাদই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন। এছাড়া রাগ প্রধান ঢঙ্গে বাংলা গান রচনা তাঁর থেকেই শুরু হয়। উল্লেখ্য যে, বাংলায় ঠুংরি গীতিধারার প্রথম প্রচলন করেন লক্ষ্ণৌর বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ। অতুল প্রসাদের বিশেষত্ব এই যে, তিনি বাংলা গানের সুর-তালের বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেই হিন্দুস্তানি রীতির প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি উত্তর ভারতে কাটান। সেজন্য ওখানকার সাঙ্গীতিক পরিমন্ডলের সাথে মিশে গিয়ে তিনি হিন্দুস্তানি গীত পদ্ধতিকে রপ্ত করতে সমর্থ হন। তাই বাংলা গানে হিন্দুস্তানি ঢঙ্গের মিশ্রণ ঘটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। অতুল প্রসাদের এই প্রয়াস বাংলা গানে একদিকে যেমন নতুনত্ব এনেছে অপরদিকে তেমনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ উন্মুক্ত করে বাংলা গানের জগতে এক বন্ধনমুক্ত শৈল্পিক আবহ নিমার্ণে সক্ষম হয়েছে।
হিন্দুস্তানি লঘু খেয়াল, ঠুংরি, ও দাদরা সংগীতের সুষমামন্ডিত সুরের সংগে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল। হিন্দুস্তানি সুর সংযোজনায় বাংলা গানের কাব্যিক মর্যাদা কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে কেউ কেউ মত প্রকাশ করলেও একটি স্বতঃফুর্ত সাঙ্গীতিকভাব তাঁর প্রায় সকল গানে পরিলক্ষিত হয়। যেখানে সুর সঙ্গীতের মাধুর্য নিয়ে কথার ভাবকে ছাড়িয়ে গিয়েছে সেখানেই অতুল প্রসাদের সার্থকতা। তাঁর ঠুংরি ও দাদরা ভঙ্গিও গানগুলি শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে।
এমন কয়েকটি গানের মধ্যে রয়েছে, কি আর চাহিব বলো (ভৈরবী/টপ খেয়াল), ওগো নিঠুর দরদী (মিশ্র আশাবরী-দাদরা), যাব না যাব না ঘরে (ঠুংরি) ইত্যাদি। তিনি রাগ প্রধান ঢঙ্গে বাংলা গানে যে সুর সংযোজন শুরু করেন, তা পরবর্তীকালে একটি শক্তিশালী ধারা হিসেবে বিকশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামের গান এবং রাগপ্রধান অঙ্গের অন্যান্য আধুনিক গান এভাবে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৩৪ সালের ২৬ আগষ্ট লক্ষ্ণৌয়ে এই মহান ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
ঢাকা নিউজ 24 ডট কম.
আলোচিত ব্লগ
জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?
জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন
মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়
১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷
চলুন গল্পটা শুনে আসি৷
বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া
একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন
সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!
~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন
রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো
রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন