somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাজেট: জনগণের টাকা, খরচ হবে কোথায়? আনু মুহাম্মদ

১৬ ই জুন, ২০১০ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেটের আয়তন ১,৩২,১৭০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এটি প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। সরকারের কর ও কর-বহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা, আগের বছর সরকারের এই আয় ছিল ৭৯,৪৬১ কোটি টাকা। তার মানে এই বছরে সরকারের বর্ধিত আয় ধরা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা।

ছোট গাড়ি, সিগারেট, জুস ইত্যাদির শুল্কবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে–এগুলো যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু অন্যদিকে, বাসের উপরও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অথচ বড় গাড়ি, এসি যন্ত্রাংশের উপর শুল্ক হার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের ভাল সম্ভাবনা থাকলেও সরকার বড় গাড়ি ও এসির জায়গায় উল্টো ভূমিকা নিয়েছে।

সম্প্রতি যন্ত্রাংশের নামে এসির আমদানি অনেক বেড়েছে দেশে। একটি ছোটখাট এসি যে পরিমাণ বিদ্যুৎ টানে তাতে ৫০টি ফ্যান চলতে পারে। যদি এসি বড় হয় তা ২০০টি পরিবারকে বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত করে। এরকম অবস্থায় এসির জন্য কেন একই দামে বিদ্যুৎ দেওয়া হবে, কেন তাদেরকে বাড়তি ভোগের জন্য বাড়তি করের আওতায় আনা হবে না? আনবে না সরকার। একই কথা সিএনজিচালিত গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বলাই বাহুল্য, কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও ভ্যাটের আওতা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করায়, নতুন করে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুল্কবৃদ্ধি না করলেও, দামবৃদ্ধির চাপ জনগণের ব্যাপক অংশের উপর পড়বে। সবমিলিয়ে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উপর মূল্যবৃদ্ধির চাপ পড়বে।কিন্তু সম্পদশালীদের বড় অংশ, সরকার নির্বিশেষে, ক্রমান্বয়ে দক্ষ হতে থাকা করজালের বাইরেই থাকে। আর এই সম্পদশালীদের মধ্যে যারা উপরের সারিতে তাদের আয়ের বেশির ভাগই চোরাই টাকা (‘কালো টাকা’ বলে সাধারণভাবে যা পরিচিত)।

এই চোরাই টাকা কীভাবে গঠিত হয়? এই চোরাই টাকা গঠিত হয় লেনদেন-নিয়োগ-টেন্ডার-বদলি-আইন শৃঙ্খলা রক্ষা -গাড়ি ব্যবসা-লাইসেন্স প্রদান ইত্যাদিতে ঘুষ, বিদেশী কোম্পানির সাথে দেশের জন্য ক্ষতিকর চুক্তি বা সমঝোতা বাবদ কমিশন, ব্লাকমেইল ও চাঁদাবাজি, নদী নালা খালবিল খাসজমির মতো সাধারণ সম্পত্তি দখল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন ইত্যাদির মাধ্যমে। এছাড়া মাদকদ্রব্য ব্যবসা, চোরাচালানি, মজুতদারি, নারীপাচার, যৌনবাণিজ্য, অস্ত্রব্যবসা ইত্যাদি তো আছেই। এই অর্থ আয়ের ধরনগুলো দেখলেই বোঝা যায় প্রশাসন বা ক্ষমতার সাথে যুক্ততা ছাড়া এটা সম্ভব হয় না। বস্তুত এই ক্ষমতাশালী সম্পদশালীরাই যেহেতু সরকার নামের নানা প্রতিষ্ঠান নীতি পরিচালনা ও প্রভাবিত করে সেহেতু তাদের কাছ থেকে সম্পদ সংগ্রহের কোনো উদ্যোগ বাজেটে থাকার কথা নয়। এমনকি তাদের জন্য চাপ, আশংকা বা ভীতিরও কোনো কথা বাজেটে উচ্চারিত হয় না।


বাজেট অধিবেশনের পরে বাড়ানো হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এই দামবৃদ্ধি জনগণের জীবনে কয়েক দফা শুল্কবৃদ্ধির শামিল হবে। সকল পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, পরিবহণ ব্যয় বাড়বে এবং তার চক্রাকার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমবে।



সুতরাং বাজেটে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, একদিকে ব্যাপক জনসংখ্যার উপর চাপ বাড়বে, অন্যদিকে বিপুল সম্পদশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে। এখন প্রশ্ন হল জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে? প্রধান ব্যয়ের খাত হল সরকার নিজেই; তার প্রশাসন। সরকারের বিলাস বৈভব, মন্ত্রী এমপি আমলাদের নতুন গাড়ি–সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আর হল ঋণের সুদ। তারপর অন্য সব।

অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা নামের যে কর্মসূচি বছরের পর বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো এবারও অব্যাহত আছে। অর্থমন্ত্রীর তো নয়ই, সমাজের মধ্যেও এই প্রশ্ন কম যে, এই যে বছরের পর বছর সামাজিক নিরাপত্তা আর দারিদ্র বিমোচনের নামে বরাদ্দ যাচ্ছে, তার ফলাফল কী? বছর বছর সামাজিক নিরাপত্তা নামে এসব বরাদ্দের বৃদ্ধি সত্ত্বেও কেন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে? দারিদ্র বিমোচনের নামে এত বরাদ্দ সত্ত্বেও কেন দারিদ্র পরিস্থিতির উন্নতি হয় না? কেন বৈষম্য বাড়ে? কেন ঢাকা শহরে খোলা আকাশের নিচে ঘুমানো মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকে? এর উত্তর পাওয়া যাবে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের মধ্যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদে ধনিকশ্রেণী গঠনের মধ্যে।

বাজেট নিয়ে আলোচনায় অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, সরকারের দক্ষতার অভাবেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি প্রায়বছরই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাঁদের সিদ্ধান্ত, এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আর কোন সমস্যা থাকে না। এসব বিশেষজ্ঞ খুব চিন্তাভাবনা করে বা দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেন বলে মনে হয় না। কারণ বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের মাত্রা, বিভিন্ন খাতে সরকারী বরাদ্দ আর তার ব্যয় পর্যবেক্ষণ করলে এটা স্পষ্ট হবে যে, সব প্রকল্প বা বরাদ্দের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটে না। কোন কোন প্রকল্প দ্রুত অগ্রসর হয়, কোন কোনটি পড়ে থাকে মাসের পর মাস অথবা বছরের পর বছর। কোন কোন বরাদ্দ দ্রুত ব্যয় হয়, কোন কোনটি ধরাই হয় না।

অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বরং সমস্যা বেশি। এমন অনেক ভুল বা ক্ষতিকর প্রকল্প নেয়া হয় যেগুলো অর্থের অপচয় বা দুর্নীতি যেমন সৃষ্টি করে তেমনি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতীয় ক্ষতির কারণ হয়। উন্নয়ন প্রকল্পের এই ধরন লক্ষ্য করলেই পষ্ট হবে যে, সমস্যাটা নিছক দক্ষতাজনিত নয়। সমস্যা প্রকল্প বাছাইয়ের এবং এর পেছনে সক্রিয় দেশী বিদেশী বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর ভূমিকা। এসব গোষ্ঠীর তৎপরতা ও আগ্রহ দিয়েই প্রকল্প বাছাই হয়, বাস্তবায়ন হওয়া বা অর্ধসমাপ্ত ফেলে রাখা বা বছরের পর বছর টেনে নেওয়া– সবই নির্ভর করে এর পেছনে কারা সক্রিয় তার উপর।

জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রী দাবী করেছেন, অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ সেটা সত্য ধরে নিয়েই উচ্ছ্বসিত কথা বলছেন। এসব দাবী ও কথার ভিত্তি হল জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে বর্ধিত বরাদ্দ। কিন্তু জ্বালানী খাতে এই বছর যে বর্ধিত বরাদ্দ দেখা যাচ্ছে তা জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নয়, বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের জন্য নয়, এই খাতে শিক্ষা ও গবেষণা বিকাশের জন্যও নয়। তাহলে এর আসল কথা কী?

২০০৯-১০ অর্থবছরে জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাতে অর্থবরাদ্দ ছিল ৪৩১০ কোটি টাকা। বছরশেষে অর্থাৎ ২০১০ সালের জুন পর্যন্ত হিসাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই বছরে এই খাতে ব্যয় কমেছে ৫২৪ কোটি টাকা। অথচ এই সময়কালে সারাদেশ যে অভূতপূর্ব গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে পড়েছিল তাকে মোকাবিলার জন্য এই পরিমাণ অর্থই স্বল্পমেয়াদে যথেষ্ট ছিল। তাতে গ্যাসের ঘাটতি দূর হতো এবং রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টগুলো অনেক কম দামে কোন ভর্তুকি ছাড়া আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হতো।

কিন্তু এই টাকা খরচ করা হযনি। না করে অনেক বেশি দামে অনির্ভরযোগ্য রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের জন্য কোন দরপত্র ছাড়াই প্রধানত কয়েকটি বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এর ফলে সামনের বছর থেকে বাংলাদেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচ হতে থাকবে। সেই খরচ যোগানের জন্যই এই বছরের বাড়তি বরাদ্দ। এই বরাদ্দ দিয়ে কুলাবে না বলে বাজেট অধিবেশনের পরে বাড়ানো হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম। এই দামবৃদ্ধি জনগণের জীবনে কয়েক দফা শুল্কবৃদ্ধির শামিল হবে। সকল পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, পরিবহণ ব্যয় বাড়বে এবং তার চক্রাকার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১০ দুপুর ১২:১৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০, কিংবা ২/১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, বুঝবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



আপনার পোষ্ট যদি ক্রমাগতভাবে ০ কিংবা ১'টি মন্তব্য পেতে থাকে, তখন খোঁজ নিলে দেখবেন যে, সোনাগাজী সেমি-ব্যানে আছে!

কোন বিষয়ের উপর অনেক মানসম্পন্ন পোষ্ট লিখলেও সামুতে আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×