somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কৃত্রিম জিনোম

১০ ই জুন, ২০১০ রাত ৩:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কৃত্রিম জিনোম – কৃত্রিম জীবনের পূর্বাভাস ?
সাইফুল ইসলাম

মাত্র কয়েকদিন আগেই আমেরিকার কিছু বিজ্ঞানী অভূতপূর্ব সাফল্যের ঘোষণা দিয়ে বসল। বিবিসি সংবাদের শিরোনামটি ছিলো এরকম Artificial life break trough announced by scientist। কিছু বিজ্ঞানী কৃত্রিম জিনোম (genome) সৃষ্টির মাধ্যমে কৃত্রিম জীবন সৃষ্টির কাছাকাছি পৌঁছাব আভাস দিলো। এই সংবাদ পরিবেশন হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ব ব্যাপি বিজ্ঞান জগতে এক তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী “সায়েন্স এক্সপ্রেস (Science express)”– এর ২০শে মে সংখ্যায় একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ক্রেইগ ভেন্টার (Craig Venter), একুশ শতকের একজন অন্যতম জিনোম বিজ্ঞানী, এই কৃত্রিম জিনোম আবিস্কারের জনক।

বর্তমান বিজ্ঞান এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। কৃত্রিম জিনোম আবিস্কারের ঘটনাটি একটু ভূমিকা দিয়েই শুরু করি। একবার আমাদের একটি “বিজ্ঞান উপস্থাপনা অনুষ্ঠানে” উপস্থিত সবাইকে বলা হলো নিজের গবেষণাকে ৫ মিনিটে সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ছিল বিজ্ঞান নিয়ে গবেষক। সবাই নিজের গবেষণাকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করল। এরপর যখন বলা হলো, আপনার এই একই গবেষণা সবার সামনে উপস্থাপন করুন কিন্তু শর্ত হলো, আপনাকে ধরে নিতে হবে যে সামনে উপস্থিত সবাই সাধারণ জনগণ। স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ জনগণের বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা কম। তখন সবার উপস্থাপনা দেখার মতো ছিল। লেজে-গোবরে অবস্থা আর কি। চেষ্টা করব বিষয়টি সহজভাবে উপস্থাপন করতে।
এবার ফিরে আসি আসল ঘটনায়। ২০ জন বিজ্ঞানী প্রায় ১০ বছরের বেশী প্রচেষ্টার পর আনুমানিক ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে সৃষ্টি করেছে এই কৃত্রিম জিনোম। এটিই বিশ্বের প্রথম আবিস্কৃত সম্পূর্ণ কৃত্রিম জিনোম। জিনোম সম্পর্কে খুব সজহভাবে কিছু ধারণা না দিলে অনেকের কাছে বিষয়টি পরিস্কার নাও হতে পারে। জিনোম হচ্ছে ডিএনএর (DNA) অপর নাম। মানুষ থেকে শুরু করে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া সহ সকল প্রাণীজগতের সকল তথ্য এই জিনোমের মধ্যেই সংরক্ষিত থাকে। শুধু তথ্য বহনই নয়, প্রাণী জগতের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় এই জিনোমের দ্বারা। কিন্তু কি দিয়ে তৈরি এই জিনোম? এই জিনোমের ধারাবাহিকতা তৈরি হয় চারটি মাত্র লেটার দিয়ে (A,T,C,G) যেগুলোকে বলা হয় বেস (Base).

এগুলোই পরস্পর বিভিন্ন মিশ্রণে পাশাপাশি সংযুক্ত হয়ে তৈরী করে দীর্ঘ জিনোম। মানুষের দেহের একটি কোষে (দেহের মোট কোষ সংখ্যা আনুমানিক 10e14) জিনোম আছে তা প্রায় ৩ বিলিয়ন (A,T, C,G ) লেটার দিয়ে তৈরী।কৃত্রিম জিনোম

ক্রেইগ ভেন্টারের ল্যাব যে কৃত্রিম জিনোম আবিস্কার করেছে সেটি মানুষের জিনোমের মত এত দীর্ঘ নয়। এটি মাইকোপ্লাজমা মাইকোয়েড ব্যাকটেরিয়ার জিনোম যেটি ১.০৮ মিলিয়ন লেটার দীর্ঘ। কিন্তু চিন্তা করলে এই আকারের জিনোম তৈরী করাও খুব একটা সহজ বিষয় নয়। যদি ১.০৮ মিলিয়ন লেটারের একটি মাত্র প্রয়োজনীয় লেটার পরিবর্তন হয়ে যায়, সমগ্র জিনোমটা এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। এই জন্য ১.০৮ মিলিয়ন লেটারকে খুবই সঠিকভাবে সংযুক্তি করা হয়েছে যেটি প্রকৃত ব্যাকটেরিয়ার জিনোম লেটারের হুবহু কপি। এরপর ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রকৃত জিনোমটি একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সরিয়ে ফেলে সেখানে সম্পূর্ণ কৃত্রিম ভাবে তৈরী জিনোমটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ব্যাকটেরিয়া থেকে প্রকৃত জিনোমটি এমনভাবে সরানো হয়েছে যেন কোনভাবেই এর কোনো অংশ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে না থাকে এবং খুবই আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম জিনোমটি সম্পূর্ণভাবে ব্যাকটেরিয়াকে পরিচালিত করছে এবং আসল ব্যাকটেরিয়ার মত কশবৃদ্ধি (Self replication) করতে সক্ষম। এর বৃদ্ধিও হচ্ছে একই হারে (capable of logarithmic growth)। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছে জিনোমটি কৃত্রিম হলে কি হবে, যে কোষটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটিতো প্রাকৃতিক (natural)। এটি ঠিক। কিন্তু কয়েক বছর পূর্বেই কৃত্রিম জিনোম তৈরীর বিষয়টিকে হাস্যকর মনে হয়েছিল যেটি আবার নিয়ন্ত্রণ করবে একটি জীবিত কোষকে। কিন্তু কে বলতে পারে এই আবিস্কার বিজ্ঞানকে আরো কতদুর নিয়ে যায়। বিগত কয়েক বছরে জিনোম ধারবাহিকতা (sequence) বের করা অনেক সহজ হয়ে আসছে। মানুষের জিনোম ধারবাহিকতা (genome sequence) আবিস্কার করার জন্য আজকে থেকে প্রায় ১ যুগ আগে ১০ বিলিয়ন ডলারের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। প্রযুক্তির অস্বাভাবিকতা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সেটি এখন ৫০ হাজার ডলারে নেমে এসেছে। অনেক কোম্পানীর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এই খরচ কে ১০০০ ডলারে নামিয়ে আনতে। হয়তো সেই দিন আর বেশী দুরে নয় যেদিন আপনি আশে পাশের কোনো ডায়গনিষ্টিক সেন্টারে যাবেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাতে আপনার সম্পূর্ণ জিনোমের ধারাবাহিকতা নিয়ে ফিরবেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃত্রিম জিনোম সৃষ্টি করেছে বিতর্ক নৈতিকতা নিয়ে। যখন জিনোমের ধারাবাহিকতা জানা খুব সহজলভ্য হয়ে যাবে তখন এটি কৃত্রিমভাবে তৈরী করাও খুব একটা কঠিন হবে না। সারা বিশ্ব ব্যাপী যে প্রশ্নটা এখন সবার সামনে, এই একইভাবে কৃত্রিম জিনোম সৃষ্টি করা সম্ভব উদ্ভিদ অথবা মানুষের?

তাত্ত্বিকভাবে বললে উত্তর হবে হ্যাঁ। কিন্তু বাস্তবিক হয়তো এতটা সহজ হবে না। ব্যাকটেরিয়া খুবই সহজ এবং মাত্র একটি জিনোম বহন করে। সেক্ষেত্রে মানুষ বহন করে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম, যা খুবই দীর্ঘ এবং জটিল। মানুষের জিনোমে এত বেশী তথ্য আছে যা কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের কাছে একসময় হয়তো হার মানতে হবে।
ক্রেইগ ভেন্টার দল অবশ্য দাবী করেছে, এই প্রযুক্তি বায়োফুয়েল, বিভিন্ন রোগের টিকা, ফার্মাসিউটিক্যাল সামগ্রী, পরিস্কার পানি তৈরী এবং খাদ্য সামগ্রী তৈরীর ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন করে দিবে। কিন্তু এর পাশাপাশি অনেক অনৈতিক আবিস্কারের পথ খুলে যাবে। অনেক সমালোচক বলেছেন ক্রেইগ ভেন্টার এবং তার সহযোগীরা স্রষ্টার সাথে খেলছে (Playing God) এবং মানুষের উচিত হবে না নতুন জীবন সৃষ্টি করার কোনো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকলাম এর শেষ কোথায় সেটি দেখার জন্য।

লেখকঃ পিএইচডি গবেষক (জিনোম গবেষণা), ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটি, স্টকহোম, সুইডেন, ই-মেইলঃ- [email protected]
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১০ রাত ৩:৫১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পথ হারিয়ে-খুঁজে ফিরি

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৩৩


মনটা ভালো নেই। কার সাথে কথা বলবো বুঝে পাচ্ছি না। বন্ধু সার্কেল কেও বিদেশে আবার কেও বা চাকুরির সুবাদে অনেক দুরে। ছাত্র থাকা কালে মন খারাপ বা সমস্যায় পড়লে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রজাতির শেষ জীবিত প্রাণ !

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫১



বিবিসির একটা খবর চোখে এল সেদিন । উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার প্রজাতির শেষ পুরুষ গন্ডারটি মারা গেছে । তার নাম ছিল সুদান । মৃত্যুর সময় তার বয়স ৪৫। বিবিসির সংবাদটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×