somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সনি’র মৃত্যুঃ আমার অপরাধবোধ।

০৯ ই জুন, ২০১০ বিকাল ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই ১৯৯১ সালের কথা; এস এস সি এর রেজাল্ট বের হয়েছে, মনে খুব ইচ্ছা, ভাল একটা কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু তেমন কেও নেই যে তার বাসায় থেকে শহরের কলেজে পড়তে পারি। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের ঠিকানা নিয়ে খুলনা রওনা হলাম, ঈচ্ছা বি এল কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু সেই আত্মীয়ের বাসায় এক রাতের বেশী থাকা সম্ভব হলো না। খুব মন খারাপ নিয়ে ফিরে আসছিলাম। ভাবলাম ভর্তি তো হতে পারব না দৌলতপুর নেমে কলেজটাকে একবার দেখে যাই। ক্যাম্পাসে ঠুকে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল, ইস্ এত সুন্দর একটা কলেজে ভর্তি হতে পারব না! ফিরে আসছিলাম, হঠাৎ ছোট্ট-খাট্ট, মাথা টাক্কু করা একটা ছেলে সম্ভাবত আমার করুণ মুখ দেখে জিজ্ঞেস করল, কোন সমাস্যা? আমার সব কথা শুনে সে বল্ল তার বাড়িও মাগুরা, সে এখানে একটা ম্যাসে থাকে, ইচ্ছা করলে আমি তার সাথে যেতে পারি। আমার মনে হল, আল্লাহ মনে হয় আমার জন্য ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন।
মুশফিকের সাথে আমার পরিচয় এভাবে। তারপর কলেজে ভর্তি হলাম, একই রুমে প্রায় দেড় বছর ছিলাম। আমার কাছে কলেজের স্মৃতি মানে পাবলার “বরিক ছাত্রাবাস” এর সৃতি, আর এর প্রায় প্রতিটি ঘটনার সাথে মুশফিক জড়িত। ও আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র, আপনি করে কথা বলতাম, কিন্তু সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মত। কত যে সুখ-দুখের স্মৃতি...। ক্লাশ শুরু হওয়ার পর বুঝতে পারলাম ভাল কলেজের শুভংকরের ফাকি; ক্লাশ থেকে কিছু শেখা সম্ভব নয়, প্রাইভেট পড়তে হবে, কিন্তু সে সামর্থ আমার নেই। চোখে আবার অন্ধকার দেখলাম, গ্রামের নামকরা ভালছাত্র (?) হারিয়ে যাচ্ছিলাম শহুরে ধনী পরিবারের ছাত্রদের মধ্যে। এবারও পথ দেখাল মুশফিক, বল্ল, কলেজের আশায় থেকে লাভ নেই, নিজেরই সব কিছু করতে হবে। খুব পড়ুয়া ছাত্র ছিল ও, পাল্লা দিয়ে রাত জেগে পড়তাম আমরা। মুলত ওর অনুপ্রেরনায় আর নিজের চেষ্টায় টেষ্ট পরিক্ষায় ফেল করা ছাত্র এইস এস সি পরিক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করে ফেললাম।
এরপর, আমি ভর্তি হলাম জাহাঙ্গীরনগর আর ও এক বছর লস্ দিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। আমরা বিচ্ছিন্ন হলেও বন্ধুত্বটা অটুট ছিল তখনও, আসলে ওর প্রতি আমার টানটা ছিল কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। একদিকে বাদরামীতে উস্তাদ অন্যদিকে অসীম আন্তরিকতা, বন্ধুদের মধ্যে তাই ও ছিল খুবই জনপ্রিয়। বছর খানিক পর... ও একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল। বুঝলাম ওর বন্ধু সার্কেল চেঞ্চ হচ্ছে। এস এম হলে সীট পাওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হলো। নেতার পিছন পিছন ঘুরে সারাদিন। ওর গল্পের টপিক চেঞ্চ হতে থাকল, কোন নেতার কাছে কত অস্ত্র আছে, কে ওকে দেখে সালাম দিলনা, কাকে কিভাবে টাইট দেওয়া যায়, কেন্ত্রীয় কমিটিতে ঢুকতে আর কত দিন...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বিরক্ত হতাম, মানা করতাম, কিন্তু আমার কথা গুলো ওর কাছে তখন হাস্যকর আতলামী।
ওর বাবা ছিলনা, ওর মা আমাকে খুব স্নেহ করতেন, বলতেন ও কিসব ছাইপাশ করছে তোমরা একটু বোঝাতে পারনা? আমরা গরিব মানুষ, ভার্সিটিতে গেছে পড়াশুনা করতে, এসব রাজনীতি ফাজনীতি করে গুলি খেয়ে পড়ে থাকলে কে দেখবে, ওর উপর আমাদের এত আশা! কিন্তু কে শোনে কার কথা, মার সামনে সুবোধ বালকের মত বলত, না! সব ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু ওকে তখন অন্য জগতের লোভ পেয়ে বসেছে; অস্ত্রের নেশা, টাকার নেশা, নেতা হওয়ার লোভ ওকে অন্ধ করে দিয়েছিল।
“টগর” (মুশফিকের ডাক নাম) তখন ঢাকা উইনিভার্সিটির প্রথম সারির সন্ত্রাসীর নাম। আমার সাথেও দুরত্ব বাড়তে থাকে, আসলে আমি ওকে এড়িয়ে চলতাম অথবা ভয় পেতাম, ওরও ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছিল। ওর সাথে লাষ্ট যেবার দেখা হয় তখন ও পুরাদমে সন্তাসী, পার্থ হত্যা সহ ৩/৪ টি মামলা তখন ওর নামে। তখন আওয়ামীলীগের শেষের দিক, জহুরুল হক হলের কর্মচারী দের কোয়ার্টারে থাকত। নীলক্ষেতে হঠাৎ দেখা, জোর করে ধরে নিয়ে গেল বাসায়। আলু ভর্তা আর ডাল রান্না করল দুজনের জন্য। রান্নার ফাকে আলমারী খুলে একটা পিস্তল ধরিয়ে দিল আমার হাতে, আমি ওটা হাতে নিয়ে কাঁপছি। আমি বললাম গুলি নেইতো? বল্ল, হা আছে, তুই আজ রাতে থাক তোকে চালান শিখাব। আমি তখন ওর কাছ থেকে ছাড়া পেলে বাচি। আমি বললাম, এসব ছাড়েন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা হয় না? ওর মুখটা হঠাৎ বিসন্নতায় ছেয়ে গেল, “এরাস্তায় ঠোকা সহজ বেরোনো অত সহজ নয়। মাথায় খুনের মামলা ঝুলছে, আজ পলি্টিক্স ছাড়লে কালই জেলে যেতে হবে। দেখি, বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছি, সুযোগ হলেই চলে যাব”। বিকালে অনিচ্ছা সত্বেও ওর সাথে টি এস সি যেতে হলো। পলাশী দিয়ে হেটে যাচ্ছি, ওর কোমরে পিস্তল গোজা, আমি মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছি, আল্লাহ আল্লাহ করছি, এখন যদি পুলিশ ওকে ধরে আমার নামটাও চলে যাবে সন্ত্রাসীর খাতায়। আমার অবস্থা বুঝে ও হেসে বল্ল এতো ভয় পাস্ কেন? এখন পুলিশের বাপও আমাকে ধরতে পারবে না, সব ম্যনেজ করে ফেলেছি। এস এম হলের সামনে এসে ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার/নেতা কে দেখলাম আড্ডা দিচ্ছে। একজন ওকে ডাক দিলো, পাশে গিয়ে কি যেন আলাপ করল। ও ফিরে আসলে আমি বললাম এরা না ছাত্রলীগ করে, তাহলে আপনার সাথে এত খাতির! এরাই তো পার্থ হত্যাকারীর ফাঁসী চায় বলে গলা ফাটায়। ও হেসে বল্ল, সেটা প্রকাশ্যে করতে হয়, তলে তলে আমরা সব এক। এখন ওরা আমাকে সেল্টার দিচ্ছে আমি আমার দল ক্ষমতায় আসলে ওদের সেল্টার দিব। ও আড্ডা দিত ডাঃ মিলন ভাষ্কযের পাশে, তার কিছু দুরেই পুলিশ ক্যাম্প, পুলিশের সামনেই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ পুলিশের খাতায় সে পলাতক আসামী!
এবার আসি শিরোনাম প্রসঙ্গে; ২০০২ সালের ৮ই জুন টগর-মুকি গুরুপের বন্দুক যুদ্ধে মারা গেল নিরপোরাধ মেয়ে “সনি”। সনি’র মৃত্যু কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না, কারন সে ছিল শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বলি হওয়া নিরপোরাধ একজন সাধারন মেধাবী ছাত্রী। গতকাল ছিল তার মৃত্যু বার্ষিকী, সামুতে এ বিষয়ে পোষ্টও ছিল। সঙ্গত কারনেই মন্তব্য গুলো ছিল খুনিদেরকে চরম ধিক্কার দিয়ে। এই একটা জায়গা আমি খুব অসহায়, আমি অন্যদের সাথে গলা মিলিয়ে বলতে পারি না খুনির ফাঁসি চায়। টগরের ফাঁসী চায়- এটা বলতে আমার গলা আটকে যায়। এমন কি সনি খুন হওয়ার পর সারা দেশ যখন ঘৃনায় থু থু ছিটাচ্ছিল, আমি তখন মনে মনে চাচ্ছিলাম, ও যেন পালিয়ে যেতে পারে। পরে শুনেছি ও ভারতে পালিয়েও গিয়েছিল, নাসির উদ্দিন পিন্টু (ওর গডফাদার) নাকি খালেদা জিয়ার কাছে ধমক খেয়ে ওকে মিথ্যা কথা বলে দেশে এনে শেরাটন হোটে্ল থেকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল। টগর ছিল আমার দুঃসময়ের বন্ধু, আমি ওর অকল্যাণ চাইতে পারি না। জানিনা, টগর কখনও সনির আত্মার কাছে ক্ষমা চেয়েছে কিনা, কিন্তু আমি সনি'র কাছে ক্ষমা চাই তার খুনিদের প্রতি আমার এই সহানুভুতির জন্য।

২০০৮ এর শেষের দিকে আমি জাপান চলে আসার আগের মাস, খুব ব্যস্ত সময় যাচ্ছে। হঠাৎ অপরিচিত নম্বর থেকে একটা ফোন এল, বল্ল আমি "টগর"। গলা একদম ভেঙ্গে গেছে, ক্লান্ত-শ্রান্ত একটা কন্ঠস্বর। কোন টগর? আবার বল্ল, আমি টগর, কাশিমপুর কারাগার থেকে। জেলখানা থেকে কেও ফোন দিতে পারে তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত। এক ভিজিটরের মোবাইল থেকে ফোন দিয়েছে। ৫/৭ মিনিট ফোন ধরে ছিলাম, কেও কোন কথা বলতে পারিনি। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। ও শুধু বলল, আমার জন্য দোয়া করিস্ আর পারলে একবার আমাকে দেখে যাস।

আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য টগরের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের প্রচেষ্টা নয়; এখন তাতে তার কোন লাভও নেই। সনি’র জীবন শেষ হয়েছিল এক মুহুর্তের বুলেটের আঘাতে আর টগরের জীবন শেষ হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে খাঁচায় বন্ধি থেকে। "টগর" শুধু একজন খুনি, সন্ত্রাসী, পিশাচের নাম নয়, টগর একজন মেধাবী, একজন পরোপকারী, একজন বন্ধুসুলভ ছাত্রের নামও; গ্রামের একটা সাধারন মধ্যবিত্ব পরিবারের স্বপ্নের নামও। নিজের কিছু ভুল আর পারিপার্শিক অবস্থার কারনে আজ সে পিশাচ, খুনি, সন্ত্রাসী। এখনও আমাদের ক্যাম্পাসেগুলোতে এমন হাজারও টগর জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন। যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্ররাজনীতির অতীত ঐতিয্যের ধুয়া তুলে ক্যাম্পাসেএই সন্ত্রাসকে জিয়িয়ে রেখেছে, তাদের আমার কিছু বলার নেই, কারন তারা সব কিছু বুঝেশুনে ইচ্ছাকৃত ভাবেই তা করছে। আমার এই পোষ্ট হয়ত কোন উঠতি "টগর"কে একটু হলেও তার পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করবে- এই আশা!
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১০ সকাল ৮:১১
১২টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি ভালো আছি

লিখেছেন জানা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯



প্রিয় ব্লগার,

আপনাদের সবাইকে জানাই অশেষ কৃতঞ্গতা, শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক ভালোবাসা। আপনাদের সবার দোয়া, সহমর্মিতা এবং ভালোবাসা সবসময়ই আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শক্তি এবং সাহস যুগিয়েছে। আমি সবসময়ই অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমার ড্রোন ছবি।

লিখেছেন হাশেম, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩

বৃহত্তর প্যারিস তুষারপাত।

ফ্রান্সের তুলুজ শহরে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার।

হ্যাসল্ট, বেলজিয়াম।

ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ফ্রান্সের ফ্রিওল আইল্যান্ড।


রোডেসিয়াম এম রেইন, জার্মানি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতার সুফল কতটুকু পাচ্ছে সাধারণ মানুষ

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৯ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৮

(১) আমলা /সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীর সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব হতাশাজনক। মুক্তিযুদ্ধের ১৯৭১ সালের রক্ত দেওয়া দেশের এমন কিছু কখনো আশা কি করছে? বঙ্গবন্ধু এমন কিছু কি আশা... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলজিবিটি নিয়ে আমার অবস্থান কী!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১০ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৫

অনেকেই আমাকে ট্রান্স জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কথা বলতে অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের ভূমিকা কী হওয়া উচিত- সে বিষয়ে মতামত চেয়েছেন। কারণ আমি মধ্যপন্থার মতামত দিয়ে থাকি। এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলমানদের বিভিন্ন রকম ফতোয়া দিতেছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১০ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


আপন খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুফাতো বোনের বা ছেলের, মেয়েকে বিবাহ করা যায়, এ সম্পর্কে আমি জানতে ইউটিউবে সার্চ দিলাম, দেখলাম শায়খ আব্দুল্লাহ, তারপর এই মামুনুল হক ( জেল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×