somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিরল ভালোবাসা

০২ রা জুন, ২০১০ রাত ১:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঢাকার যেখানে শ্যামলী সিনেমা হল ছিল, তার পূর্ব পাশে শ্যামলী ২ নম্বর রোডের কাজী অফিসের সামনে মা ও ছেলের ঝগড়া হচ্ছে। লোকজন ভিড় করে শুনছে। ঝগড়ার একপর্যায়ে হঠাৎ শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এসে পড়ে। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাই, 'বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা আবার আপনাদের কী সমস্যায় ফেলল?'
জবাবে ছেলে আবদুল কাদেরের ঝাঁজালো উত্তর, 'আমারে যে জন্ম দিছে, হেই বেডায় যে কী কাম করছে, হেই কথা আমি আর কী কমু? ওই বুড়ির কাছেই হুনেন।' বলেই ছেলে উঠে চলে গেল। মা রমিজা খাতুনের কাছে গিয়ে বসতেই জানা গেল এক বিরল ঘটনা_বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, একজন হাসমত আলী আর এক অনন্য ভালোবাসার গল্প।
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দরিদ্র রিকশা-ভ্যানচালক হাসমত আলী। আওয়ামী লীগের একজন অন্ধভক্ত। আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ের কথা শুনলেই ছুটে যেতেন। নৌকা আর বঙ্গবন্ধু নিয়েই মেতে থাকতেন সারা দিন। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের আয় দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান আর অল্প অল্প করে টাকা জমান। একদিন সেই টাকা দিয়ে নিজের স্ত্রীর নামে নয়, সন্তানের নামে নয়; দরিদ্র হাসমত একখণ্ড জমি কেনেন শেখ হাসিনার নামে। তিনি বলতেন, 'শেখ হাসিনা আমার মেয়ে। মেয়েটা এখন এতিম। তাই ওর নামে এই জমি কিনে রেখে গেলাম।'
সেই হাসমত আলীর স্ত্রী আর একমাত্র সন্তান এই রমিজা ও কাদের। আজ তাঁরা বসে ঝগড়া করেন ঢাকার রাস্তায়। জীবনের ঘূর্ণিপাকে পড়ে তাঁরা আজ নিঃস্ব, অসহায়। শেষ সম্বল দিয়ে ওই জমি কেনার পরের বছরই হাসমত আলী যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রমিজা আর কাদের পড়েন অথৈ সাগরে। দুই বেলা খাবার জোটানোর উপায় থাকে না তাঁদের। শেখ হাসিনার নামে বাবার কেনা ওই জমিটুকুর ভোগদখলও তাঁরা নিতে পারেন না। তাই নিরুপায় রমিজা এখন ভিক্ষা করে জীবন চালান।
শ্যামলীতে বসে কথা বলার সময় রমিজা দুঃখ করে জানান, স্বামীকে জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। শেখ হাসিনার নামে কেনা জমিটি বিক্রি করে চিকিৎসার কথা বললে হাসমত উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, 'আমি মইরা গেলে মইরা যামু। তুই ভুলেও ওই জায়গা বেচার কথা মুখে আনবি না। ওই জমি আমার মাইয়ার জন্য রাখছি।'
নাক-মুখ দিয়ে গড়গড় করে রক্ত বের হয়েছে, তবু তিনি জমি বিক্রি করতে দেননি। রমিজা জানান, তিনি রক্ত বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসার খরচ চালিয়েছেন। কিন্তু উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারায় দুই মাস পরে তাঁর স্বামী মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দাফন-কাফনের খরচও ছিল না। ঢাকার আগারগাঁও এলাকার মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে গফরগাঁওয়ে গ্রামের বাড়িতে স্বামীর দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রমিজা জানান, মৃত্যুশয্যায় তাঁর স্বামী একটা কথাই বারবার বলতেন, 'আল্লাহ, শেখ হাসিনারে তুমি হেফাজতে রাখিও।' শুধু তাই নয়, রমিজা জানান, হাসমত বলতেন, তাঁর মেয়ে হাসিনা ওই জমিতে বাড়ি করবে। তাই তিনি মারা গেলে যেন তাঁর কবর ওই জমিতেই দেওয়া হয়। সেটাই করা হয়েছে। জমির এক কোনায় রয়েছে হাসমত আলীর কবর।
মা-ছেলের সেদিনের ঝগড়ার সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার বারবাড়িয়া ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. হাসমত আলী পঞ্চাশের দশক থেকেই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্ধভক্ত। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে হাসমত স্ত্রী-পুত্র নিয়ে পাগলের মতো ছুটে আসেন ঢাকায়। ওঠেন আগারগাঁও বস্তিতে। দীর্ঘ ২৫ বছর সেখানেই বসবাস করেন। গ্রামের বাড়িঘরও বেচে দেন। এর পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে যেখানে মিটিং-মিছিলের ডাক দিতেন, সেখানেই ছুটে যেতেন হাসমত। একটু অবসর পেলেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে বসে থাকতেন।
রমিজা খাতুন বলেন, তাঁর স্বামী নিজের ছেলেকে যতটা না ভালোবাসতেন, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনাকে মেয়ে সম্বোধন করে প্রায়ই বলতেন, বঙ্গবন্ধুকে রাজাকাররা পরিকল্পিতভাবে সপরিবারে হত্যা করেছে। এখন তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনাকেও হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি প্রতিদিন নামাজ পড়ে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করতেন আর বলতেন, 'শেখ হাসিনা আমার মেয়ে। এই মেয়েটার জন্য কিছু একটা করা দরকার।'
অবশেষে ২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গফরগাঁওয়ের রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া বড়াইল গ্রামের মো. ইউছুফ আলীর কাছ থেকে পৌনে সাত শতাংশ জমি কেনেন হাসমত। ২৪ হাজার টাকা দিয়ে জমিটুকু কিনে হাসমত আলী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নামে দলিল করেন। ময়মনসিংহ রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গফরগাঁওয়ের রাওনা ইউনিয়নের খারুয়া বড়াইল মৌজার ১৭৫ নম্বর দাগের পৌনে সাত শতক জমি কেনা হয়েছে শেখ হাসিনা, স্বামী ড. ওয়াজেদ আলী, ধানমণ্ডি, ঢাকার ঠিকানায়। দলিল নম্বর ১৫৪৫, জেএল নম্বর ১১৩। এ জমির নকশা প্রস্তুত করেন মো. হাফেজ আলী (লাইসেন্স নম্বর ৩৪৭৬)। জমির চৌহদ্দি: উত্তরে রাজিয়া খাতুন, দক্ষিণে সুফিয়া খাতুন, পূর্বে হাসমত আলী, পশ্চিমে হাকেমন নেছা।
এই জমি কেনার এক বছর পর ২০০৪ সালে মারা যান হাসমত আলী।
বাবার মৃত্যুর পর থেকে বৃদ্ধা মায়ের কোনো খোঁজ নেন না ছেলে আবদুল কাদের। বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছেন তিনি। পেশায় তিনি গাড়িচালক। মা ভরণ-পোষণ চাইতে গেলেই ওই জমি উদ্ধারের কথা বলেন কাদের। ছেলের শর্ত শুনে জমিটি ফিরে পেতে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করেছেন একাধিকবার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তাই ভিক্ষাবৃত্তি করেই এখন দিন কাটছে রমিজার। তিনি নিজেও খুব অসুস্থ। ঢাকায় শ্যামলীর ২ নম্বর রোডের কাজী অফিসের পাশের বস্তির একটি ঘরে থাকেন তিনি। করুণ কণ্ঠে বললেন, 'বাবারে, এই বয়সে রোইদের মধ্যে ভিক্ষা করতে আর ভালা লাগে না।'
রমিজা আরো জানান, তাঁর স্বামী জমিটা যার কাছ থেকে কিনেছিলেন, সেই ইউছুফ আলীও এখন জমির দখল বুঝিয়ে দিচ্ছেন না। দখল নিতে গেলে ইউছুফ আলী ও তাঁর পরিবার বলে, এই জমির মালিক শেখ হাসিনা। তোরা এই জমির মালিক না। এই জমিতে আসলে তোদের পুলিশে দেওয়া হবে।'
ঢাকার মোহাম্মদপুর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি হাসমত আলীকে চিনতেন। হাসমত আলী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। শেখ হাসিনাকে তাঁর মেয়ে মনে করতেন। তাই আবেগের বশে গ্রামে শেখ হাসিনার নামে জমি কিনেছেন। নূর মোহাম্মদ বলেন, 'হাসমত মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী জমিটি ফিরে পাওয়ার আশায় আমার কাছে অনেকবার এসেছিলেন। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। জমিটি ফিরে পেলে তাঁদের অনেক উপকার হতো।'
গফরগাঁও উপজেলার বারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য চারিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'হাসমত আলী সম্পর্কে আমার মামা। তিনি সারা জীবনের উপার্জনের টাকায় শেখ হাসিনার নামে জমি কেনেন। মামার অসুখের সময় মামি জমিটা বিক্রির চেষ্টা করেও পারেননি।'
রাওনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, চারিপাড়া গ্রামের হাসমত আলীকে এক নামে সবাই চেনে। তিনি নিজের স্ত্রী-সন্তানের নামে জমি না কিনে শেখ হাসিনার নামে জমি কিনেছেন, এ কথাও গ্রামের সবাই জানে।

৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। হরিন কিনবেন ??

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৯



শখ করে বন্য প্রাণী পুষতে পছন্দ করেন অনেকেই। সেসকল পশু-পাখি প্রেমী সৌখিন মানুষদের শখ পূরণে বিশেষ আরো এক নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এবার মাত্র ৫০ হাজার টাকাতেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠিক কোন বিষয়টা মৌলবাদী পুরুষরা শান্তি মত মানতে পারে???"

লিখেছেন লেখার খাতা, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:২৭


ছবি - গুগল।


ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রাম এখন আর শুধু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম নয়, রোজগার এর একটি চমৎকার প্ল্যাটফর্মও। একটু স্মার্ট এবং ব্রেন থাকলে ফেসবুক/ইনস্টাগ্রাম থেকে রোজগার করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধখানা ভ্রমন গল্প!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১০ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৩৯


২০০২ সাল বান্দারবানের রিগ্রিখ্যাং-এর এই রিসোর্ট আজ সকালেই আমরা আবিস্কার করলাম! পাহাড়ের এত উপরে এই মোড়টাতে একেবারে প্রকৃতির মাঝে এমন একটা রিসোর্ট থাকতে পারে তা আমরা সপ্নেও কল্পনা করিনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×