somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নদীর নাম সুরমা

২৯ শে মে, ২০১০ সকাল ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নদীই জীবন, জীবনই নদী। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। শতসহস্র নদ-নদী খাল-বিল শিরা-উপশিরার মতো প্রবাহিত এই ভূখণ্ডের উপর দিয়ে। জলপ্রবাহ ঘিরে বিকশিত হয়েছে দেশের অর্থনীতি আর সংস্কৃতি। ভৌগোলিক কারণেই যুগেযুগে নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে নগর, বন্দর ও জনপদ।
মানুষের জীবন-সংগ্রাম, কৃষ্টি, ঐতিহ্য আর শত শত বছরের মুক্তি সংগ্রামের সাক্ষী এদেশের নদনদী। নদীর প্রশস্তবক্ষের মতো এদেশের জনগণও ঔদার্যের আপন মহিমায় উজ্জ্বল।
আজও এদেশের উৎপাদন আর বিপণনব্যবস্থা বড়মাপে জলাধার ও জলপ্রবাহকেন্দ্রিক। অন্যদিকে এই নদীর জন্যেই মানুষ শিকার হয়েছে নানা রকম দুর্গতি আর ভাগ্যবিড়ম্বনার। প্লাবনজর্জর বাংলাদেশ তাই আজ বাঁচার তাগিদে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নদীর অস্থির আচরণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু কেন...? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হয়তো আমরা অনেক কারণই জানতে পারব। হয়তো নদীকোলাশ্রিত আদম সন্তানের লেলিহান লোভ আর সীমাহীন ভোগলিপ্সার প্রসঙ্গ উঠবে। আর এই জটিল সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে, দেশবাসীর সচেতন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, আর নদী জীবনভর আমাদের জীবনে-মরণে যা-কিছু দিয়েছে--অকাতরে দিয়েছে--এরই কিছুটা অন্তত ভালোবেসে নদীকে ফিরিয়ে দেওয়ায়।
আর এই প্রতিরোধ বেগবান করতে ও প্রতিরোধে জনঅংশগ্রহণ বাড়াতে প্রয়োজন দেশের নদ-নদীকে বিশদভাবে জানা আর ভালোবাসা। নদীর সঙ্গে সভ্যতার অগ্রযাত্রার প্রয়োজেনীয়তা উপলব্ধি করার মধ্যেই নিহিত নদ-নদীর টিকে থাকার সম্ভাবনা। তাই হাজারো নদীর এক প্রতিনিধি সুরমার সম্পন্ন অতীত আর বিপন্ন বর্তমান উপস্থাপনের জন্য এই রচনার অবতারণা ।

সুরমা নদী
সুরমা বাংলাদেশের দীর্ঘ নদীগুলোর একটি। সুরমা নদী ভারতের নাগমণিপুর পাহাড়ের দক্ষিণাংশে উৎপন্ন হয়ে বরাক নাম ধারণ করে প্রবাহিত হতে থাকে । পরে বাংলাদেশের সিলেট জেলার অমলসিদ সীমান্তের কাছে বরাক নদী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হতে থাকে। বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা এই তিন নদীর সংযোগস্থল ত্রিবেনী নামে পরিচিত। অমলসিদ গ্রামের এই ত্রিবেনী থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত ধরে ক্রমান্বয়ে উত্তর হতে পশ্চিমে কিছুদূর যাওয়ার পর পুনরায় উত্তর-পূর্ব দিকে বেঁকে যায়। এরপর নদীটি বাঁক নিয়ে পশ্চিমে কিছুদূর গিয়ে আবার উত্তরে প্রবাহিত হয়ে আকাশমল্লিক নামক স্থান পর্যন্ত প্রায় ২৬.৫ কি.মি. নদীপথ অর্ধশতাব্দির অধিককাল ধরে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত রেখা হয়ে বয়ে চলেছে (নদী কি রাজনীতি-কূটনীতি বুঝে?)।
আকাশমল্লিক হতে সুরমা নদী সম্পূর্ণ বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে, যা পশ্চিম-উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে চারিপাড়ার মধ্য দিয়ে আবার পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে হেতিমগঞ্জ পর্যন্ত বেঁকে যায়। ভারতের খাসিয়া-জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে আগত লুভা নদী চারিপাড়ায় সুরমা নদীতে পতিত হয়। এই স্থানটি লুভামুখ নামে পরিচিত। সুরমা হেতিমগঞ্জ থেকে আবার উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে কানাইঘাট, রামধাবাজার, গোলাপগঞ্জের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর গোলাপগঞ্জ থেকে উত্তর-দক্ষিণ দিকে এঁকেবেঁকে সিলেট শহরে প্রবেশ করে। সিলেট শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুরমায় প্রায় ৬০ ভাগ পানির যোগান আসে লুভা নদী থেকে। বরাক ও অনান্য কিছু শাখা নদী থেকে আসে ৩০ ভাগ এবং বাকি ১০ ভাগ পানি ভারতের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের বিভিন্ন ছড়া-খাল এবং স্থানীয় বৃষ্টির পানি এসে সুরমা নদীর প্রবাহে যুক্ত হয়।
সিলেট শহর থেকে পশ্চিম-উত্তর দিকে বেঁকে গিয়ে লামাকাজি হয়ে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জে সুরমা নদী সিলেট জেলা অতিক্রম করে সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করে। অমলসিদের ত্রিবেনী থেকে ছাতক পর্যন্ত সুরমার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬৪ কি.মি. এবং ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত সুরমা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কি.মি.। সুনামগঞ্জ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে পাইন্দা নামক স্থানে সুরমা দুইটি শাখায় বিভক্ত হয়। সুনামগঞ্জ থেকে পাইন্দার দুরত্ব প্রায় ১১ কি.মি.। পাইন্দায় বিভক্ত সুরমার দক্ষিণমুখী শাখাটি চাঁদপুর-দিরাই হয়ে মারকুলিতে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এই শাখাটি এক সময় সুরমার মূল প্রবাহখাত ছিল। পুরাতন সুরমা নামে খ্যাত এই ধারাটি এখান মৃতপ্রায়। এরও আগে সুরমার এই শাখাটি দিরাই-চাঁদপুরের ৪ কি.মি. উজানে সুজানগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে আজমিরীগঞ্জে কালনী নদীতে পড়ে। এই ধারাটি বর্তমানে মরা সুরমা নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় শাখাটি পাইন্দা থেকে ৮ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে উত্তর-পশ্চিমে মোড় নিয়ে প্রায় ৯ কি.মি. গিয়ে আবার দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁক নিয়ে লালপুরে বাইলাই নদীতে পতিত হয়। পরে এই শাখাটি বিভিন্ন নাম ধারণ করে দিলালপুরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। অমলসিদের ত্রিবেনী থেকে দিলালপুরে মেঘনায় পতিত হওয়া পর্যন্ত সুরমা প্রায় ৩৫৫ কি.মি. পথ অতিক্রম করেছে।

সুরমা নদীর নামকরণ
ঠিক কবে যে এর নাম সুরমা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য ইতিহাসের নানা বিতর্কের বেড়াজালে আজও বন্দী। তবে সুরমা নামের উৎপত্তি নিয়ে বিচিত্র কিংবদন্তি চালু রয়েছে। কথিত আছে যে, রাজা ক্ষেত্রপাল বারো শতকে একটি খাল খনন করে বরাক নদীর সাথে যোগ করেন। এ থেকে একটি নতুন নদীর সৃষ্টি হয়। রাজা ক্ষেত্রপালের স্ত্রীর নাম ছিল সুরম্যা। রাণী সুরম্যার নামানুসারে রাজা নদীটির নাম রাখেন সুরমা। তবে এইসব কিংবদন্তির কোনোটিই বিতর্কের উর্ধ্বে নয়; মতের বৈচিত্র্যও রয়েছে বেসুমার এবং এসব নিয়ে নানা জিজ্ঞাসাও রয়েছে।
ভিন্নমতগুলো, প্রথমত, সুরমা নদী তো শুধু রাজা ক্ষেত্রপালের রাজ্যে সীমাবদ্ধ নয়; অন্য রাজ্যের ভূমির ওপর দিয়েও প্রবাহিত হয়েছে। এটিকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করলে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, অন্য রাজ্যের মধ্যে তিনি খাল খনন করলেন কীভাবে? আবার একাধিক রাজ্য যৌথভাবে খাল খনন করলেও একটি রাজ্যের রাণীর নামে নামকরণের কারণ কী? তাছাড়া, দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা হচ্ছে, মানুষের দ্বারা এত দীর্ঘ নদী খনন কি আদৌ সম্ভব? তৃতীয়টি হচ্ছে, নদীটি খনন করা হলে এতগুলো বক্রখাত রাখা কেন? মানুষের দ্বারা খননকৃত নদী আঁকাবাঁকা না হয়ে বরং অপেক্ষাকৃত সোজা হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?
সুরমা নামকরণের পক্ষের মতামত হলো--রাজা ক্ষেত্রপাল হয়তো পুরো সুরমা নদীটি খনন করেননি। কিন্তু সুরমা নদীতে অনেকগুলো বক্রখাতের মধ্যে হয়তো তিনি বরাক ও সুরমা নদীর সাথে সংযোগস্থলের বক্রখাতটি সোজা করে খনন করেছিলেন। ফলে বরাক নদীর মূলধারাকে সংযোগ ঘটিয়েছিলেন এবং তিনি তারই রাণীর নামে নদীটির সুরমা নাম দিয়েছিলেন। তবে সুরমা নাম নিয়ে যত মতভেদই থাকুক না কেন, সুরমার উৎস-নদী বরাকের প্রাচীন নাম ছিল ‘বরবক্র’; প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ও শাস্ত্রে বরবক্র নামের যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। আবার কারো কারো মতে প্রাচীন পুরাণে পুণ্যতোয়া নামে খ্যাত শরাবতী নদীই বর্তমানের সুরমা।

সুরমা ও ধর্মীয় বিশ্বাস
সুরমা ও এর উৎস-নদী বরাক নিয়ে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে হযরত শাহজালাল (রঃ) পর্যন্ত সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই ঘটেছে।
সুরমা নদী সম্পর্কে প্রাচীন পুরাণাদিতে তেমন উল্লেখ না-থাকলেও বরাক নদী অর্থাৎ প্রাচীন বরবক্র পুণ্যতোয়া নামে খ্যাত। হিন্দুদের বিশ্বাস বরবক্র নদীতে øান করলে সকল পাপ দূর হয়। তীর্থ চিন্তামণিতে রয়েছে--
‘‘ রূপেশ্বরস্য দিগভাগে দক্ষিণে মুনি সত্তমঃ
বরবক্র ইতিখ্যাত সর্বপাপ প্রনাশনঃ
যত্র তেপে তপঃ পূর্ব সুমহৎ কপিলমুনি।”
অর্থাৎ রূপেশ্বর থেকে দক্ষিণ দিকে বরবক্র নামে খ্যাত সর্বপাপনাশী একটি তীর্থ আছে, সেইস্থানে পুরাকালে মুনিশ্রেষ্ঠ কপিল মুনি তপস্যা করতেন।
ফজলুর রহমান সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, অমর কোষ অভিধানে শরাবতী নদীর ব্যাখ্যা আছে। “অনেকের মতে শরাবতী নদীই সুরমা নদী। এতে লেখা আছে, ‘‘এই ভারতবর্ষে শরাবতী নামে এক নদী আছে, যাহা ভারতের ঈশাণ কোণ হতে উৎপন্ন হয়ে নৈঋত কোণাভিমুখে গমন করে পশ্চিম দিকে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। সেই নদীর পূর্ব-দক্ষিণ দিকের দেশ প্রাচ্যদেশ। ভারতবর্ষের সাহচর্য্য হেতু প্রতিগত অন্ত, অর্থাৎ শিষ্টাচার রহিত কামরূপবঙ্গাদিদেশ ম্লেচ্ছদেশ। কারণ যেদেশে চতুর্বর্ণ নাই সেদেশ ম্লেচ্ছদেশ। তদ্ব্যতীত স্থান আর্যাবর্ত।”(পৃ. ২০)
ঘটনাচক্রে ত্রিবেনীর কাছে হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর সঙ্গে সিকন্দর গাজীর মুলাকাত হয়। রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচারের কথা জানতে পেরে হযরত শাহজালাল (রঃ) সিকন্দর গাজীর সাথে সিলেট যেতে ওয়াদা করেন। কিছুদিন পর তাঁরা সিলেট উপকণ্ঠে পৌঁছুলে রাজা গৌড়গোবিন্দ শাহজালালের বাহিনীকে বাধা দেন। ঐ সময়ে রাজা গৌড়গোবিন্দ সুরমা নদীতে চলাচলকারী সকল নৌকা বন্ধ করে দেন। বহুবিদিত আছে, এসময়ে হযরত শাহজালাল তাঁর জায়নামাজে করে সুরমা নদী পার হন। তাঁর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা গৌড়গোবিন্দ পলায়ন করেন।
“সংস্কৃত ভাষায় রচিত পুরাণ-উপপুরাণে বরবক্র নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বরাহ পুরাণে ঋষিরা বর্ণনা করেছেন, রূপেশ্বরের দক্ষিণ দিকে বরবক্র নামে খ্যাত সর্বপাপনাশন একটি তীর্থ আছে। যেখানে পুরাকালে মুনিশ্রেষ্ঠ কপিল মহাতপস্যা করেছিলেন। সেখানে শুভপদ কপিল তীর্থ এবং সিদ্ধেশ্বর বিরাজ করেন। সে-তীর্থে øান করলে লোকে উৎকৃষ্ট বিষ্ণুলোক প্রাপ্ত হয়, যেখানে মহাত্মা সিদ্ধপুরুষ উপাসনা করেছিলেন।” (সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য, পৃঃ ৬৩)
বায়ু পুরাণে উল্লেখ আছে, “ওঁ বিন্দপাদ সমুদ্ভূত বরবক্র মাহনদ নমস্তে পুণ্যফলদ সর্বপাপ প্রমোচন ইতিস্তুতা প্রণমেত।”(প্রাগুক্ত)
সতের শতকের শেষভাগে রচিত ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস সম্বলিত রাজমালা কাব্য থেকে জানা যায়, “রাজা অমর মাণিক্য (১৫৯৭Ñ১৬১১) অনন্ত স্বর্গে গমন করার আশায় বরবক্র ও মনু নদীর মহাপবিত্র সঙ্গমস্থলে গিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। রাজা মনু নদীতে নৌকায় করে ছয় দণ্ডের পথ উজিয়ে বরবক্র নদীর মিলনস্থলে উপনীত হয়েছিলেন। এছাড়াও উল্লেখ রয়েছে, বরবক্র-মনুসঙ্গমে মৃত্যু যার হয়/ চন্দ্রলোকে যায় সে-ই প্রমাণ নিশ্চয়।”

সুরমাপাড়ের শিল্প-বাণিজ্যের অতীত ও বর্তমান
ভৌগোলিক কারণে প্রাচীনকালে সিলেটের সঙ্গে দেশের অনান্য স্থানের যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল নদী ও হাওড়ের নৌপথ। তাই সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে নদীর দু-পাড়ে গড়ে উঠেছিল নগর-বন্দর ও জনপদ। সড়ক পথে যোগাযোগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সঙ্গে বাংলা এবং এর নিকটবর্তী ভূথণ্ডসমূহের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের আদান-প্রদান নিয়মিত ভাবে চলত সুরমা নদী ধরেই। কৃষিই ছিল তখনকার সুরমাপাড়ের জনগণের অন্যতম ভিত্তি। এছাড়া দু-পাড়ের জনগণের একটি বড় অংশ বিভিন্ন ধরনের হস্ত-কারুশিল্পের সাথে যুক্ত ছিল।
হান্টারের বর্ণনা মতে ১৮৫৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সাথে যোগাযোগের একটি মাত্র রাস্তা ছিল, কিন্তু তার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল নদীপথে পরিবহন করা হতো। সারাবছর দূরবর্তী স্থানে যাতায়াতের সুবিধার জন্য জাহাজের তুলনায় ছোট ছোট নৌকারই প্রচলন ছিল বেশি। বিশেষ করে অধিকাংশ স্থান জলের নিচে ডুবে থাকায় এই নৌকাসমূহ দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকত । ( সুরমা উপত্যকার শিল্প ও বাণিজ্য, সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রিয়াম গোস্বামী, পৃ. ৩৩৬)
সেকালে স্থলপথে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। তবে কলকাতা থেকে একটি রাস্তা ঢাকা হয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে জানা যায়। জলপথই ছিল চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। কলকাতা থেকে জলপথে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে পড়ত বুড়িগঙ্গা, ছোট মেঘনা ও সুরমা নদী। ছোট মেঘনা দিয়ে সুরমা হয়ে সবচেয়ে সোজা ও সংক্ষিপ্ত পথে দাউদকান্দি থেকে সিলেট যাওয়া যেত।
প্রাচীনকালে সুরমাপাড়ের জনপদগুলোতে ছোট ছোট গৃহজাত শিল্পের সাথে লৌহশিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিলেটের তৈরি ঢালেরও খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। ইটা পরগনার জনার্দন কর্মকার মুর্শিদাবাদের নবাবের জন্য জাহানকোষ নামে একটি কামান তৈরি করেছিলেন। কামানটি এখনো মুর্শিদাবাদের হাজার-দুয়ারীতে রক্ষিত আছে।
এছাড়া গৃহজাত শিল্পের মধ্যে লস্করপুরের উর্ণিচাদর, মাছুলিয়া গ্রামের এন্ডি, গায়ে দেয়ার গেলাপ, মাছ ধরার ঝাকিজাল, উড়াজাল, উথালজাল , হৈফাজাল, হাটজাল, পেলুইনজাল ইত্যাদি নানা জাতের জাল, সুনামগঞ্জের রঙিন কাঠের খেলনা ও খড়ম, তরপের বেহালা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সিলেটের পাটিয়ারা দাস নামক এক শ্রেণীর লোক উৎকৃষ্ট শীতলপাটি তৈরি করত। কাঁথা সেলাই কাজে মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। এছাড়া সিলেটে হাতির দাঁতের কাজ, শাঁখাশিলা, বাঁশবেতের নানান বস্তু তৈরি ও পাতার ছাতি তৈরির জন্যেও সুনাম অর্জন করে ।( দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, ২য় খণ্ড-পৃ.১৭১-৭২, ২১, ২৯৩)
মণিপুরী স¤প্রদায় হস্তশিল্প তৈরিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। এরা তাদের নিজস্ব তাঁতে চাদর ও শাড়ি সহ বিভিন্ন রকমের বস্ত্র তৈরি করে থাকে।
প্রাচীনকালে সুরমা উপত্যকায় প্রচুর হাতি পাওয়া যেত। তাই হাতির দাঁতের পাটির সুনাম এক সময় দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়েছিল। হাতির দাঁত থেকে চুলের মতো চিকন বেত তৈরি করে পাটি বোনা হতো এবং সেই পাটি প্রচুর দামে বিক্রি করা হতো। এছাড়া হাতির দাঁত থেকে পাখা, চুড়ি, চিরুনি, খড়মের গুটি, লাঠি, দাবা ও পাশা খেলার গুটি তৈরি হতো।
শীতলপাটিও সুরমাপাড়ের হস্তশিল্পের উল্লেখযোগ্য নির্দশন। র্মুতা নামক এক প্রকার বনজ গাছ থেকে বেত সংগ্রহ করে শীতলপাটি তৈরি করা হয়। র্মুতা থেকে বেত তুলে তা বিশেষ পদ্ধতিতে সিদ্ধ করার পর পাটি বোনা হয়। পাটিতে নিপুণভাবে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।
এছাড়া বেতের তৈরি আসবাবপত্রও সুরমাপাড়ের একটি অন্যতম শিল্প হিসেবে পরিচিত। সুরমাপাড়ের জঙ্গলগুলোতে প্রচুর জালিবেত পাওয়া যায়। আর বেত দিয়ে খাট, চেয়ার, টেবিল, শেলফ, বাকশো-পেটরা, সোফা প্রভৃতি আসবাবপত্র তৈরি হয়। শহরবাসীর কাছে এসব শিল্পের কদর কম নয়।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×