স্মরণাতীত কালে কবি মৃদুল দাশগুপ্তের একটা বই পড়ছিলাম। বইয়ে কবি মৃদুল জানাইছিলেন, তার আব্বা-আম্মার বিয়ার সময় তারা গিফট হিসাবে একটা বই পাইছিলেন। সেই বই বাড়ির ট্রাঙ্কে রাইখা দেওয়া হইতো। বইটার নাম 'রূপসী বাংলা'। মৃদুল যখন ক্রমে বড় হয়া উঠতেছিলেন এবং পড়তে শিখতেছিলেন তখন রূপসী বাংলা পইড়া তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন। মৃদুলের আব্বার বাড়ি ফরিদপুর আম্মার বাড়ি বরিশাল। তিনি পড়তেন, এই বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। পইড়া আম্মার দিকে তাকায়া কইতেন, এই বাংলা হইলো বরিশাল। তখন তার আব্বা ঈর্ষাগ্রস্ত হইতেন। মৃদুল আবৃত্তি কইরা রূপসী বাংলার একেকটা লাইন পড়তেন আর কইতেন, এইটা বরিশাল নিয়া লেখছে, প্রতিবার তার আব্বার মধ্যে একটা ঈর্ষা খেলা করতো।
মৃদুল দাশগুপ্তের বইটার আর বিশেষ কিছু মনে নাই। কিন্তু তার এই ছেলেখেলার কথা বিশেষভাবে মনে রইছে। কেন মনে রইছে তার একটা ছোট ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসে যাওনের আগে সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা বলি। অতিসম্প্রতি কবি গৌতম চৌধুরীর লগে আলাপ হইতেছিল। একথা সেকথার পর আমি তারে কইতেছিলাম, কবি উৎপল কুমার বসুর দেশ নাই। উল্লেখ্য, আমি বিশেষ উৎপল-ভক্ত। আমার উপন্যাসে সেই ভক্তির উদাহরণ আছে বইলা উৎপলের কথা আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনায় উঠছিল। তো, গৌতম ভাই একটা চমৎকার কথা কইছিলেন আমার উত্তরে। কইছিলেন, উৎপলের যে দেশ, সেই দেশ আপনেরও। উৎপলের সেই দেশের নাম, আধুনিকতা। আমি কইতেছিলাম, যে আধুনিকতার হাত থিকা নিস্তার পাওনের জন্য কত চেষ্টায় আছি। তবে এইটা ঠিক যে, আমরা যারা ঊনিশ শতকের সন্তান তাদের দেশ শেষ পর্যন্ত সেই আধুনিকতাই। অন্য কোনো দেশ সেইখানে মূর্ত হয়া উঠে নাই।
যে কোনো কারণেই হউক, আমাদের গ্রাজুয়েট স্কুলে আমরা কতিপয় সহপাঠী ঊনিশ শতক নিয়া বিশেষ আগ্রহ পাইছিলাম। বাঙালির তথাকথিত রেনেসাঁ, কলকাতা শহরের মধ্যে তার নবজাগরণ এবং শহরের মধ্যে তার বন্দিত্ব ও নানাবিধ পাপ নিয়া কিছু জ্ঞান অর্জন হইছিল। সেই থিকা আমরা জানছিলাম, উনিশ শতকে বাংলার সাহিত্য তার প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্গে বিচ্ছেদ তৈয়ার করছে। শুধু তাই নয়, সাহিত্য অন্তকরণে দেশকে বর্জন কইরা নতুন দিকে গেছে। নবজাগরিত, রেনেসাঁ-শাসিত, আধুনিক বাংলা সাহিত্য যতটা না বাংলার ততোধিক ইউরোপীয়। এই বিষয়ে এন্তার লিটারেচার এখন ছাপা কাগজে পাওয়া যায়।
ফলে, বাংলা সাহিত্যের রথী-মহারথীদের আমরা আদর কইরা বলি, আধুনিকতার সন্তান। বাংলা সাহিত্য তার দেশের দেখা পাইছে অনেক পরে। সেই দেশও ইউরোপীয় সাহিত্যের সমান্তরালে বিকশিত হওনের এক ফাঁকে সাহিত্যে দেখা দিছে। তবু একটা দেশ আছিল, বিশ শতকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে দেশ আকার পাইছিল তার নাম ভারতবর্ষ। সঙ্গত কারণেই সেই দেশ এক বিশাল ব্যাপার। কর্নাটক হইতে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত এই দেশ রাজনৈতিক কল্পনায় ধরলেও কবির কল্পনায় ধরা দেয় নাই। কবি-সাহিত্যিকরা বাংলা দেশ বা বাংলাদেশ নামে এক দেশের কথা কইতেন, আমরা এখন গ্রাম বাংলা বইলা যে দেশের কথা কই সেই দেশ ছিল তখন বাংলা দেশ বা বাংলাদেশ। বাঙালি সাহিত্যিকদের ভাষা বাংলা হইলেও, তাদের রাজনৈতিক দেশ আছিল ভারতবর্ষ। বাংলা অঞ্চল আধুনিক সাহিত্যে তাই দেশ হয়া উঠতে পারে নাই।
তবু আমরা দেশ খুঁজি। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পূর্ব বাংলা কতটুক সেইটা নিয়া বিতর্কের শেষ নাই। রবীন্দ্রনাথে মুসলমান কী রকম সেই নিয়াও তদন্ত চলে। রবীন্দ্রনাথ নবজাগরণ ও আধুনিকতার উজ্জ্বলতম সন্তান। তার মধ্যে দেশ থাকার দাবি করা কঠিন। তখনকার রাজনীতিতে তার দেশ ভারতবর্ষ। ঐক্যের মধ্যে সংহতির মর্মবাণী তিনি প্রচার করছেন। তবু বাঙালির জাতীয়তা ও জাতি হিসাবে বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের চিন্তা তার মধ্যে সামান্য হইলেও উঁকি দিছিল। ওই পর্যন্তই, মুখটা বাইর করতে পারে নাই। রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা সত্ত্বেও তার একটা দেশের বাড়ির দেখা আমরা পাই। লোকে বলে, রবীন্দ্রনাথ বোটের জানালা দিয়া কি কুঠিবাড়ির বারান্দায় বইসা যতটুকু দেশ দেখছেন ততোটুকই রবীন্দ্র-সাহিত্যের দেশ। একথা নিশ্চিত ছোটগল্পে, গানে, কবিতায় ঠাকুর মশায়ের একটা দেশ আছে। সেই দেশ বাংলা। পশ্চিম বাংলা-পূর্ব বাংলা যাই হউক সেই দেশটা কিছুটা চিনা যায়। মজার ব্যাপার, দূর থিকা দেখলেও পূর্ব বাংলা বেশ চিনা যায়।
আধুনিক সাহিত্য যখন আরও জটিল আবর্তে, নতুন নতুন দিকে ছড়ায়ে দিশাহারা হয়া পড়ছে তখন নবজাগরেণের আরেক সন্তানের দেখা পাইলাম আমরা। তার সমকালীনরা যখন দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি সব হারায়া বইসা রইছে তখন এই বোকা লোকটা আধুনিকতার মধ্যে একটা দেশের দেখা পাইছিলেন। লোকটার নাম জীবনানন্দ দাশ। আমার মতে, জীবনানন্দের রহস্য এইখানেই। ওই জটিল চিন্তার আবর্তের মধ্যে একটা দেশের এমন স্থাপনা আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসেই বেশি নাইকা।
জীবনানন্দের কবিতা পড়ে তাই নিশ্চিত বইলা দেওয়া যায়, এই কবিতায় দেশ আছে। লোকটা দেশের মধ্য দিয়া হাঁইটা গিয়া কবিতা লেখছেন।
কিন্তু নজরুল? কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমান। হিন্দুর নবজাগরণের বাতাস যদি দুইজন বাঙালিকে জাগায়ে থাকে তবে রোকেয়ার পর নজরুলের নাম করতে হয়। নজরুলের উত্থান আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্তগ্রাম থিকা জাইগা উইঠা উনি কেমনে এনলাইটেন্ড হিন্দুর সমান্তরালে দাঁড়াইছিলেন সেইটা নিয়া বিশেষ গবেষণা হইতে পারে। ঘটনাটা আমার কাছে, রহস্যময় মনে হয়। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে নজরুল ব্যতিক্রম এবং সবচেয়ে বড় প্রতিভা। এবং অবশ্যই তিনি নবজাগরণেরই সন্তান। নজরুলে উত্থানকালে ভারতবর্ষই ছিল দেশ। কোনো উত্তরাধিকার ছাড়া নজরুলকে যতদ্রুত রেনেসাঁ ও এনলাইটমেন্ট আয়ত্ত করতে হইছে সেইটাতে উনি দেশ হারায়ে ফেলবেন এইটা স্বাভাবিক। আর বাংলার যে অঞ্চল কইলকাতার বাইরে, দূরে বিশেষভাবে দেশ তার সঙ্গে নজরুলের আত্মিক যোগাযোগ কখনো তৈয়ার হয় নাই। এই দেশটারে নজরুল অনুভব করেন নাই, এইখানে তিনি সবসময় অতিথি। তার দেশ ছিল, ভারতবর্ষ, রাষ্ট্রও ছিল ভারতবর্ষ। বাংলাদেশ, বাংলা অঞ্চল বা গ্রামবাংলার কোনো ছবি নজরুলের সাহিত্যে আমি দেখি না।
নজরুলের কবিতা গান উপন্যাস গল্পে যে দেশ সেই দেশ কখনো রুক্ষ্ম চুড়ুলিয়া, কখনো মনে হয় ইরান তুরান উত্তরভারতের কোনো অঞ্চলের কথা সেইখানে। বাংলার যেটুকু ছবি সেইটুকু রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের চাইতে বহু দূর থিকা দেখা।
কিন্তু ভাগ্যের নির্মাম পরিহাস হইলো, নজরুল শুধু মুসলমান বইলাই আমাদের জাতীয় কবি। কোন দেশের? বাংলাদেশের। এইদেশ ১৯৭১-এ তৈয়ার হইছে। কিন্তু ১৯৭১ এর আগেও এইখানে একটা দেশ আছিল। মানুষের মনের মধ্যে একটা রাষ্ট্র আছিল। একটা রাষ্ট্র চিন্তা আছিল। একটা ভূপ্রকৃতি আছিল, নদী, ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, বন্যা, ক্ষরা সবই আছিল। সেই দেশটা জাতীয় কবির মনে স্থান করতে পারে নাই।