somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাতার চশমা

২৬ শে মে, ২০১০ সকাল ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তাদের একটি গ্রাম আছে নদীর পাশে পাশে। গ্রামের নাম আছে ঘুমকুসুম। তাদের একটি নদী আছে গ্রামের পাশে পাশে। নদীর নাম আছে মেঘভাসান। আমি তাদের চিনি আঁতুড়ঘরে। তারাও আমাকে চেনে ভোরের বেলা। তাদের মানে তার। তারও একটি নাম আছে রিমিঝিম রিমিঝিম...

তাদের পাখি, তাদের বকুলবনে পাতাছায়া আর পুষ্পগন্ধ হাওয়া আছে। আছে রোদ, ঘাস আর ঘাসফড়িং। তারা ঘাসফড়িংকে বলতো শয়তানের ঘোড়া। নারিকেল পাতার ঘড়ি আর চশমা এখন এক একটা ঘাসফড়িং হয়ে উড়ে বেড়ায়। কাগজের নৌকো আছে উঠানে বাঁধা—বৃষ্টির প্রতীক্ষায়। সবি আছে ডালপালা, পুঁইয়ের বিচি, শিমের পাতায় সবুজ রঙধনু, বটফলের জীবনী আছে বটপাতার ফাঁকে... কেবল একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে শাদা শাদা মেঘের কোজাগর পাপিয়া। সে গাঁয়ের ধারে বনে বনে সারাদিন। সে পাতার ফাঁকে আকাশ দেখতো উল্টো করে দুরবিন। সে মনে করতো পাতার ফাঁকে সকল আকাশ ভাঙাকাচের টুকরো নয় কেবল, এরা এক একটা পেইন্টিং। সে ছবির ভিতর খুঁজে বেড়াতো উড়ার ডানা ও পেখম।

সে একদিন এলো নিমফুল অরণ্য। মাঝখানে সিঁথি তার লিথিময় বিস্মৃতি। বললাম তাকে, পাতার ফাঁকে যে আকাশ তুমি দেখো ছবি—ওটা আমার আঁকা। সে আশ্চর্য সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তার কাছে সবকিছুই বিস্ময়। তার কাছে সব কিছুই দীপ্র কৌতূহল। সে একটু পর পর বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করতো, আত্তা! এতা কী, ওতা কী ইত্যাদি। যেনো যা কিছু সুন্দর এবং ইন্দ্রিয়ের গ্রহণযোগ্য—সব তাকে জানতে হবে। সে যে ইশ্কুলে পড়তো—সেই ইশ্কুলের পাশে একটা পাগল থাকতো। আমরা কেউ তার নাম জানতাম না। তাকে সবাই ডাকতো ‘ওগ্গাটিঁয়া’ নামে। কারণ কারও সঙ্গে দেখা হলেই সে বলতো, ‘ওগ্গাটিঁয়া’—মানে একটা টাকা চাই। মেয়েটি দূরের একটি গাঁয়ে অন্য এক ইশ্কুলে চলে যাওয়ার পর একদিন আমার কাছে একটা চিঠি পাঠালো বিজলির ডাকঘরে। চিঠিতে লেখা, ‘ওগ্গাটিঁয়া’ কেমন আছে? জানালাম, ভালো নেই। এখন খুব অসুখ। মেয়ে ঝুমঝুম! কেউ জানে না কিছুই, তুমিও জানো তা, তোমার ‘ওগ্গাটিঁয়া’ কচুপাতার বনে অবিশ্রাম বৃষ্টি হতে গিয়ে একটা কানাকুয়া পাখি হয়ে হারিয়ে গেছে সুদূরের বনে।

একদিন আমি তাকে বললাম, আমি চোখের ছুরিতে দৃশ্যগুলি চিরে চিরে দেখি... সে তখন শাদারাত্রির রূপকথা—অবাক সুন্দর চোখে আমাকে চিরে দেখে। তারপর চলে যায়, কাউকে কিছু না বলে। অনেক দূর গাঁয়ে ইশ্কুল বাসে বসে জানলার কাচের ভিতর দিয়ে সে ইদানীং বাইরের দৃশ্যগুলি চিরে চিরে দেখে হয়তো। অথবা দৃশ্যরাই তাকে চিরে চলে আসমুদ্র সুন্দর। সে একদিন ঝুমঝুম বৃষ্টির ভিতর ছাতা মাথায় আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি তখন আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে এক দীর্ঘ জলাশয়, আমার রং গাঢ় শ্যাওলা। সে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, আমি তাকে বললাম, ছাতা কালো, বিচ্ছিরি দেখতে... আর তখনই একটা ঝড় এলো হু হু করে। সে ঝড়ের হাতে ছাতাটা দিয়ে আমাকে বললো, আচ্ছা, তুমি কি শিরোনামহীনের বর্ষা গানটা শুনেছো? হ্যাঁ তো! ওটা আমার প্রিয়, অনেক প্রিয়... কেনো জানো? বলো শুনি। ওটাতে যে সরোদ বাজে—মনে হয় সত্যিই বর্ষা... হুম! তুমি কি জানো? কী! আমিই সেই সরোদের অবিশ্রান্ত স্বরলিপি।

একদিন সে সমস্ত শাদা আর শাদা হয়ে গেলো। যেনো শরতের মেঘ আর কাশবন। যেনো জানলার শাদা পর্দার শাদা শাদা ছায়ানৃত্য। তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বিজলির ডাকঘরে ডাকবাকশো শূন্যতার যমজবোন হয়ে পড়ে রয়। খামের ভিতর জমা হয় ঝড়ের নিঃশ্বাস। আমার একটা দোয়েলপাখি ছিলো। আমার নিজের মা তাকে একদিন পেট থেকে বের করেছিলো। উনিশবছর খাঁচার ভিতর স্বপ্নান্ধ জ্বরের ভিতর থেকে থেকে একদিন যখন খাঁচা ছিঁড়ে উড়ে চলে গেলো। সেদিন আমার গভীর কষ্টের ভিতর আনন্দ এসে হচ্ছিলো স্বপ্নময় মাছ। সেদিনও সে এসেছিলো। এসে বললো, জানো, পাখিটার সঙ্গে আমার মিল আছে দুটি—একটা বয়সে, অন্যটা... অন্যটা কী? না, অন্যটা কী তোমাকে বলবো না একদিনও...

তাকে আমি অনেকদিন খুঁজেছি। শাক আর আলুর কাছে খুঁজেছি। তারা বলেছে, তুমি জলের কাছে যাও। জলের কাছে গেলাম। জল বললো, আমার রঙের কাছে শুধাও। সে বুঝি জলরঙ ছবি হয়ে গেছে!

আমি ঠিক করেছি তার জন্যে তেরোটা পদ্য লিখবো। সে জানবে না কিছুই; তারপরও। তেরোটা পদ্যের রঙ হবে তেরোরকম—নিমফুল, বকুল, বেলি, বেলপাতা, জোছনা, ধূলিকণা, রৌদ্র, কাজল, কান্না, রাত্রি, সন্ধ্যা, জোনাক এবং শালবন। তেরোটা পদ্যের সুর বইবেন তেরোজন ধ্রুপদ—ইমন, আশাবরী, বিলাবল, দেবগিরি, চন্দ্রকান্ত, পটমঞ্জরী, ঝিঁঝিঁট, মেঘমল্লার, বেহাগ, সাজগিরি, ছায়ানট, ভূপালী এবং বারিষ। কেউ জানবে না।

আমার নাম আছে ঘুমকুসুম—এই আমিই আছি তাহাদের গ্রাম। পূর্বে আমি কখনো ছিলাম নীলাভ সিলিকন। এখন কেবলই আমি নীল। আকাশের কপালে ঝাপসা টিপ হয়ে আছি বাদলরাতের দুর্বিষহ পূর্ণিমায়।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:১৫
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জলদস্যুরা কি ফেরেশতা যে ফিরে এসে তাদের এত গুণগান গাওয়া হচ্ছে?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭


জলদস্যুরা নামাজি, তাই তারা মুক্তিপণের টাকা ফেরত দিয়েছে? শিরোনাম দেখে এমনটা মনে হতেই পারে। কিন্তু আসল খবর যে সেটা না, তা ভেতরেই লেখা আছে; যার লিংক নিচে দেওয়া হলো।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×