somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আক্কেল সেলামি

১৮ ই মে, ২০১০ দুপুর ১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



হেডক্লার্ক, হিসাব-রক্ষক বা করণিক যাই বলা হোক, মোদ্দা কথা কেরানি জাতীয় পদে আমি কর্মরত। অফিস, বাসা, বাজার, খাওয়া, খবরের কাগজ আর ঘুমানোর ছকেই আমার জীবন বাঁধা। এই বন্ধনের বাইরে যাবার চেষ্টা, ইচ্ছা, বয়স এককথায় সাধ ও সাধ্য কিছুই আমার নেই। বসে বসে রোজকার বাজার খরচাই আমার একমাত্র ভাবনা। এই মধ্যবিত্তের বৃত্তের বাইরে যাবার শখ বা স্পর্ধা কোনোমতেই করি না।
তবুও আজকের এই দিনটি কি অন্য দিন থেকে ভিন্ন? আজ বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। কেমন যেন মন হারানো, মন ছোঁয়া, মন কাঁদানো আবহাওয়া। হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম। ঘড়িটা আমার ছেলের দেওয়া উপহার। ঘড়ি! আজ হঠাৎ সেই কথা, কেন মনে পড়ছে?
আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের ছাত্র তখন এক মেয়ের প্রেমে পড়ি (আমি তো পুরানোদিনের মানুষ তা-ই সরাসরি স্বীকার বললাম, এখনকার প্রেমিকরাতো বেশি স্মার্ট, তারা ঘুরিয়ে বলে, “আমি তো প্রেমে পড়িনি, প্রেম আমার উপরে পড়েছে”)। আজ যত সহজে এ কথা বলছি সেদিন অবস্থা তত সহজ ছিল না। আমার বুদ্ধির স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ লোপ পেয়েছিল। লাইলির প্রেমে বঞ্চিত হবার পর মজনু নিজ রাজ্যে ফিরে এলে তার পিতা যেমন দেখেন প্রেমিক পুত্রের আর সব ব্যাপারে মাথা ঠিক, কেবল লাইলির কথা উঠলেই সে উন্মাদ হয়ে যায়, আমারও সেই অবস্থা। তবে আমার পিতার চোখে তা ধরা পড়েনি। ভাগ্যিস, পিতৃ শ্রেণীর ব্যক্তিগণের নিকট টিনএজ লাভতো কবীরা গুনাহ্ (তাঁরা কি বয়সকালে এ গুনাহ্ করেন নি?) যদিও নাটক, নভেল আর সিনেমার বাল্যপ্রেমিকদের প্রতি তাঁদের সমর্থনের কমতি নেই। ধরা পড়েছিল আমার বন্ধুদের চোখে। এ নিয়ে আমাকে বেশ লোকসানও দিতে হয়েছে। সে সময় অপার্থিব কিছুর জন্য (সহজ কথায় প্রেমের জন্য) দুনিয়ার লোকসানকে আমল দেইনি। এই সুযোগে আমার পরামর্শদাতা, সংবাদদাতা বন্ধুরা আমাকে পুতুল নাচের পুতুলের মতো ব্যবহার করে নির্মল আনন্দ ভোগ করে তা আমি অনেক পরে বুঝেছি। কেননা, আজ আমি যথেষ্ট প্র্যাকটিকাল। এখন ওই বয়সের প্রেমকে আমি অন্যান্য অভিভাবকের মতন রোগ বা বয়সের দোষ হিসেবেই বিবেচনা করি।
কিন্তু তখন আমার প্রিয়তমাকে (খানিক পরেই বুঝবেন নাম কেন অনুদ্ধৃত) এক পলক দেখার জন্য রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। সে যখন ঝর্ণার মতো চুল উড়িয়ে চলে যেত, তখন কবিতাটির গভীর অর্থ না বুঝে যেন আমারই কথা বলার জন্যে লেখা মনে করে বলেছি “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা / মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য/ অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা।” আমি তখন দিশাহারা পথিক।

তার চলার ছন্দ দেখে মনে হয়েছে
“She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies.”


কিন্তু আমার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তখন একটু আলো, একটু আঁধার। তাকে ভুলতে পারি না। তখনকার ভাষায় শয়নে-স্বপনে ‘তুমি কেবল তুমি’। বুঝি, একেই প্রেম বা রোমান্স বলে (এই রোগকে চিকিৎসাশাস্ত্রে কী বলে?)। হায়! সে কি একবারও আমার কথা ভাবে?
একদিন আমার এক বন্ধু (সে এক নম্বর ফটকা, ৪২০ হবার পরও যার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল) আমাকে চুপি চুপি কয়টি কথা বলল, কথাও না শব্দ। এতেই আমার অবস্থা খারাপ। আরও শুনতে চাই। নইলে আমি পাগল হয়ে যাব। এমন খাপছাড়াভাবে কথা বলার মানে কী? আকুল, কাতর হয়ে বলি দোস্ত, প্লিজ আরেকটু বল। সে বলল, “বলব, তবে কাল। এখানে নয়, বিগ বাইটে।”
বিগ বাইটে খাওয়াতে হবে। আমার মানিব্যগ তখন শূন্য, টাকা জোগাড় করতে আমার হাত ঘড়িটা বিক্রি করতে হলো।

পরদিন।
আমি।। বল।
বন্ধু।। শোন, গত পরশু যখন ওর (নাম বলেছিল, উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না) সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন আমরা কোক খাচ্ছিলাম। সাথে একটা বার্গার। (বলেই সে চুপ)...
(কোক আর বার্গার অর্ডার দিলাম।)
(খেতে খেতে) আমাকে সে বলে কী জানিস? তোর কথা।
।। আমার কথা! কী বলিস?
।। পরশুও খুব গরম ছিল। আমাদের ঘরের এসি ঠিক ছিলনাতো। একটা কোকে সেদিনও কাজ হলো না। তাই আরেকটা।
(...আবার ফাউন্টেন অর্ডার।)
মজার কথা হচ্ছে কী, ওর ড্রেসটা ছিল অদ্ভুত। শার্টের রং তোর শার্টের মতোই সাদা। আর জিন্সটাও তোরটার মতো।
।। বলিস কী? সত্যি...
।। সত্যি মানে! আমি কেন মিথ্যা বলব? বল্। Don’t you trust me? Then I must quit.
।। No,no. I have my full confidence on you. Please proceed.
।। মেজাজটাতো বিগড়ায় দিলি। তোর জন্য এত খাটলাম। তারপরও তুই বলিস মিথ্যা। আচ্ছা বার্গারটা শেষ। ভাল কথা সকাল থেকে কিছুই খাই নি। এরা ক্লাব স্যান্ডউইচটা ভাল বানায়। ...
(ক্লাব স্যান্ডউইচ এল।)
তারপর যা বলছিলাম। বোটানিকাল গার্ডেনেই গত সোমবার যখন গেলাম তখনই কথা ছিল গত পরশু মিট করার।
।। বোটানিকাল গার্ডেনে। তোর সাথে, ও (নামই বলেছিলাম কাতরভাবে), একা?
।। Don’t be jealous. তোর কাজেই গেছি। তোর প্রিয়ার কাছে নইলে আমি কেন যাব, আমার কী ঠ্যাকা?...কীরে লজ্জা পাস কেন? তোর ব্যবস্থাই করলাম। দু’দিন পর তোর ওর বিয়ে।...বিয়েতে কী খাওয়াটাই না হবে। (অদ্ভুত একটা শব্দ করল)! ভাল কথা খাওয়া। একটা লাচ্ছির অর্ডার দে তো।...
(দিলাম।)
।। কাজের কথা বল। ফালতু প্যাঁচাল রাখ।
।। ফালতু প্যাঁচাল এ বান্দা ছাড়ে না। কাজ, কাজ, কাজ, W,O,R,K - WORK বুঝলি। চিড়িয়াখানায় বুঝছিস্, মজার ঘটনা শোন্ । ও নিজের হাতে স্যান্ডউইচ বানাইছে। চিকেন স্যান্ডউইচ। আমি আর ও খাচ্ছি। মজার ঘটনা শোন্ না। একটা বান্দর কোত্থেকে ভাগছে। আমার দিকে হাত বাড়ায় স্যান্ডউইচ চায়। শখ কত!...এখানে চিকেন স্যান্ডউইচ আছে না? হেই! বয়! একটা চিকেন স্যান্ডউইচ...
(আমাকে কষ্ট করে অর্ডার দিতে হলো না।)
মজার ঘটনা হলো ( কখন থেকে এক প্যাঁচাল) বান্দর ঘাড়ে উঠছে। ওর সে কী ভয়! কান্না। দিল দৌড়। ভাগ্যিস আমি ওর হাত ধরলাম নইলে...
।। তুই ওর হাত ধরলি...
।। খবঃ সব ভরহরংয. নইলে ও কোথায় আছাড় খেয়ে পড়ত! হিল পরে কি দৌড়াতে পারে কেউ বল? আচ্ছা মেনুতে হিল জাতীয় কী খাবার দেখছি। একটু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয়। হেই বয়! আঠার নম্বর একটা। ও আচ্ছা, তুইও খাবি নাকি?
(হতচ্ছাড়া, আমায় বলে খাবি নাকি?)
ওর নাচ যদি দেখতি। আচ্ছা ভাল কথা। গত মঙ্গলবার টিভিতে ওর নাচের রেকর্ডিং ছিল জানিসতো?
।। তাই... কই জানাস নাইতো!
।। সে কী! তোকে বলিনি? ওকে আবার রামপুরা থেকে নিয়ে আসতে হবে। একে আমার কাজের শেষ নাই, তার উপর এই দায়িত্ব, ঝামেলার পর ঝামেলা। অবশ্য তখন তোর কথাও হলো।
।। আমার কথা! কী বলল?
।। রামপুরার পাশে জেনিস ফাস্টফুড চিনিসতো? ওখানে বসে এজন্য চিকেন প্যাটিস খাওয়াতে হলো। কত টাকার ব্যাপার ভাব্! তবুও তোর কথা ভেবে আর গা করলাম না।
...(হারামজাদা আমি ধন্য!?)
আচ্ছা একটা বরং চিকেন প্যাটিস খাই...
।। আমার কথা কী বলল, বল না?
।। দাঁড়া বলছি। ধৈর্য হারাসনে। সবুরে মেওয়া ফলে। ওতো ক্লান্ত। নাচতো বুঝিসই খুব কঠিন। তোকে বলব প্রোগ্রাম কবে? এখনও ফাইনাল জানি না। (কথাগুলো বলতে বলতে একবার চিকেন প্যাটিস তো একবার স্যান্ডউইচের অবশিষ্ট অংশ, আবার স্ট্র দিয়ে লাচ্ছি টানছে) আমি তো আবার সেমি ফাইনাল কথা বলি না। ঠিক কি না বল?
।। (কিছু না ভেবেই বললাম) ঠিক। এখন প্লিজ দোহাই বল্ আমার কথা ও (নাম উচ্চারণ করেছিলাম, আহ্ নামটি মনকে কেমন দোলা দিয়ে যেত) কী বলল?
।। খাওয়াটা ভালই হলো। থ্যাংকস দোস্ত। আবে বেুকব সেকি তোকে চিনে, না আমারে চিনে যে তার আশিকের কথা আমাকে বলবে। তুই একটা এক্কেরে বেক্কেল... (প্রস্থান)

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথাতো হবেই। এখন আমি একজন গর্বিত পিতা। আমার পুত্রের পরীক্ষার ফলাফল খবরের কাগজে ছবিসহ উঠে। প্রিয় ব্যক্তিত্ব কে? এর জবাবে সে বলে, “আমার বাবা।” সে ভাল আবৃত্তিকার, বিতার্কিক। টিভি ভুবনেও তার নামডাক।
কিছুদিন আগে আমার ছেলের বিয়ে হয়ে গেল। বউমা যেন রূপের আধার, আমাদের ঘরকে আলো করে দিয়েছে। আরেকটি কথা, আমার বউমার মা Ñ আমার বহুদিন আগের সে-ইজন।
আমি পারিনি। আমার পুত্রতো বলতে পেরেছে, “আমি পাইলাম। আমি ইহাকে পাইলাম। কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ। এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।”
সেই অনন্ত রহস্যের সন্ধান আমার পুত্র পেয়েছে। তার পিতা হিসেবে এই বেক্কেলের এই আক্কেলটুকুই কি কম?


১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×