somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবসঃ পদ্মার বুকে এখন মরুর হাহাকার

১৬ ই মে, ২০১০ সকাল ১১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ১৬ মে। ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দান থেকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে হাজার হাজার জনতার লংমার্চ হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকন্ঠ দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। যার প্রকম্পন উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে যায়। আজো এই দিনটি শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও দাবী আদায়ের পক্ষে বঞ্চিতজনের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত তার একতরফা নীতির আশ্রয়ে গঙ্গা তথা পদ্মায় যে অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করে সেই বাঁধ বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজ মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে এই বাঁধ চালুর অনুমতি দেয়। এরপর থেকে পদ্মা নদীর বাংলাদেশ অংশে শুরু হয়েছে মরুর হাহাকার।
মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে আয়োজিত ফারাক্কা লং মার্চ দিবস সেই আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে আজো বাঙালীকে সোচ্চার হতে আহবান জানাচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যার দাবীতে এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালন করার মাধ্যমে মওলানা ভাসানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা জরুরী ছিল। তা না হলেও স্বল্প পরিসরে দেশপ্রেমিক জনতা এই দিনটিকে স্মরণ করে ভারতের পানিসহ বিভিন্ন আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে প্রতি বছর। এবারেও ঢাকা ও রাজশাহীতে সেমিনার, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা প্রভৃতির আয়োজন করা হয়েছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩৪ বছর আগে এই দিনে জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী গঙ্গার ন্যায্য পানির দাবীতে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চের আয়োজন করেন। ঐদিন রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে লং মার্চের সূচনা হয়। যা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়। দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে মানুষে মানুষে ভরে যায় রাজশাহীর রাজপথ। ভারত বিরোধী নানা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয় জনপদ। বেলা ২টার সময় হাজার হাজার মানুষের স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যে ৬টায় লংমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রাত্রি যাপনের জন্য সে দিনের মত শেষ হয়। মাঠেই রাত যাপন করার পরদিন সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। শিবগঞ্জে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরী করে মহানন্দা নদী পার হয় মিছিল। হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেয় এই লংমার্চে। কানসাট হাই স্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। মওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না। তিনি বলেন, আজ রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। মওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লংমার্চ সমাপ্ত হলেও সেদিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে।
মাওলানা ভাসানী আজ বেঁচে নেই। কিন্তু নদীর বিপন্ন দশা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী এখন প্রায় পানিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অবস্থা আরো শোচনীয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ পানি কম পেয়ে প্রতি বছরই লিখিত-অলিখিতভাবে প্রতিবাদ করে আসলেও এ ব্যাপারে ভারতের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকেও বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও গত ১৩ বছরে তা কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। শুধু আশ্বাসের বাণীই শোনা গেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মতে, ভারতের সঙ্গে পানি চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগে ১৯৯৫ সালে শুকনো মওসুমে অর্থাৎ ১২মে পদ্মায় পানি প্রবাহ ছিল ৯.৪৬মিটার এবং ১৯৯৬ সালে ১০.১৯মিটার ছিল। চুক্তি কার্যকরের পর ১৯৯৭ সালে কিছুটা বেড়ে ১০.২৫মিটার। ১৯৯৮ সালে ১১.৪১মিটার এবং ১৯৯৯ সালে ১০.৪৫মিটার। এরপর আবার কমতে থাকে ২০০০ সালে ১২মে ১০.৪২মিটার, ২০০১ সালে ১০.৩০মিটার, ২০০২ সালে ১০.৩৪মিটার ২০০৩সালে ৯.৬৭মিটার, ২০০৫সালে ৯.১১মিটার, ২০০৬সালে ৮.১২মিটার এবং ২০০৭ সালে ৯.০৫মিটার, ২০০৮ সালে ৮.০৮মিটার, ২০০৯ সালে ৮.৭৫মিটার এবং ২০১০ সালের গত ১২মে ৮.৫৮মিটার পানি প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এতে প্রমাণিত হয়, ভারত চুক্তি অনুযায়ী তার ন্যায্য পানি প্রবাহিত হতে দিচ্ছে না। বরং পানি বণ্টনের নামে বাংলাদেশের পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলকে প্রতারিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, প্রতিবেশী ভারত তিন শতাধিক বাঁধসহ বিভিন্ন ধরনের সেচ প্রকল্প দিয়ে গঙ্গা নদীকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। নদ-নদী বিধ্বংসী এমন ব্যাপক কার্যক্রমের দরুন এবার শুষ্ক মওসুমের সূচনাতেই বাংলাদেশে হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। গঙ্গা অববাহিকার পানি সংকটে কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশসহ সার্বিক অবস্থা বিপর্যস্ত। পদ্মা নদীকেন্দ্রিক সেচ প্রকল্পগুলো গুটিয়ে নিতে হয়েছে। গঙ্গা সেচ প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্পে পানির হাহাকার চলছে। নতুন কোন প্রকল্প হাতে নিতে সাহস পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট মহল। নদীর বুকে শত শত চর মরুময় পরিস্থিতি তৈরী করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা জুড়ে কৃষি-সেচ, মৎস্য আহরণ ও নৌ যোগাযোগই বিপর্যস্ত হয়নি, সার্বিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী জেলেরা জানান, ১০ বছর আগে ৪ জন জেলের একটি দল পদ্মায় নৌকা নিয়ে মাছ শিকারে গেলে গড়ে প্রতিদিন ২৫/৩০ কেজি ইলিশ, ৫/৭ কেজি চিংড়িসহ বোয়াল, পিওল, খয়রা, রাইখোড়সহ নানা প্রজাতির আরও ১৫/২০ কেজি করে মাছ পাওয়া যেত। ওই মাছ বাজারে বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় হতো। জিনিসপত্রের দামও কম ছিল। সুখেই কেটে যেতো জেলেদের দিন। এখন রাজশাহীর পদ্মায় ইলিশ পাওয়া যায় না। হারিয়ে গেছে আরও কয়েক প্রজাতির মাছ। বাপ দাদার পেশা যেসব জেলে এখনও আকড়ে আছে, তাদের ১০ জনের এক একটি গ্রুপ এখন সারা রাত জেগে মাছ ধরে ১১ থেকে ১৪ কেজি। ওই মাছ বাজারে বিক্রি করে তারা পায় সর্বোচ্চ ১৪ শ' টাকা। সে টাকার ৬ ভাগ দিতে হয় নৌকার মালিক মহাজনকে। আর বাকি ১০ ভাগ পায় জেলেরা। এ হিসেবে এখন একজন জেলে গড়ে প্রতিদিন আয় করে ৭০ টাকা। এই টাকায় এখনকার দ্রব্যমূল্যের বাজারে তাদের সংসার চলে না। ফলে রাজশাহীর পদ্মা পাড়ের সাড়ে ৭'শ জেলে বাপ দাদার পেশা ছেড়ে যোগ দিয়েছে অন্য পেশায়। তাদের কেউ রাজ মিস্ত্রির কাজ করছে। কেউ রিকশা চালাচ্ছে। কেউ অল্প পুঁজি জোগাড় করে ভ্যানে করে পাড়ায় মহল্লায় সবজি বিক্রি করছে। শুধু মাছ কেন, নদীকেন্দ্রিক বহু সংখ্যক প্রজাতির জীব হারিয়ে গেছে। অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। পদ্মার দুর্যোগে এর অববাহিকাজুড়ে চলছে বিরূপ প্রকৃতির তান্ডব। গ্রীষ্মে প্রবলতর খরা আর শীতে তাপমাত্রা ৪/৫ ডিগ্রীতে নেমে যাবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×