somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হুমায়ূন আহমেদের মায়ের হাতে লেখা কিছু কথা । কিন্তু আমার মনে হয় লেখা টি উনার নয়, উনার বড় ছেলের ।আপনার কি মনে হয়?

০৮ ই মে, ২০১০ বিকাল ৪:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার বড় ছেলে কাজল, মানে কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। ওর জন্মের আগের দিনের কথা খুব মনে পড়ে। বাড়ি ভর্তি লোকজন, বিশাল হইচই! একটা উৎসবের মতো পরিবেশ। সবাই অপেক্ষা করে আছে, কখন শোনা যাবে বাচ্চার কান্না। দিন পেরিয়ে রাত আসে, রাত পেরিয়ে সকাল। কিন্তু বাচ্চার কোনো দেখা নেই! পরদিন আস্তে আস্তে ব্যথা বাড়তে থাকে। সারা দিন আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি; আস্তে আস্তে মনে হতে থাকল—কষ্টে বুঝি মরেই যাব। যার জন্য এত কষ্ট, একসময় মনে হলো তার আর মুখও দেখতে চাই না। রাত নয়টায় অমানুষিক যন্ত্রণার মাঝে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হলো। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান হলো, হইচই যেন শত গুণ বেড়ে গেছে। কান পাতা দায়! সবাই ধাক্কাধাক্কি করে বাচ্চা দেখছে! ছেলে হয়েছে শুনতে পেলাম, কিন্তু একনজর যে তাকে দেখব, সেই উপায় নেই। নিজে থেকে দেখতে চাইব, এত বড় নির্লজ্জ কাজ করি কেমন করে? একসময় আমার পাশে এনে দেওয়া হলো তাকে। মাথা ভরা কালো চুল, টকটকে ফরসা গায়ের রং, চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবখানা এমন—কী, বলেছিলে না আমার মুখ দেখবে না? এখন? আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে গেল আমার প্রথম ছেলের মুখ দেখে! দুষ্টের চূড়ান্ত ছিল সে। ও তখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ে। এক সন্ধ্যায় এসে বলল, ‘আমি গরুর কথা বুঝতে পারছি!’ ওকে এত বোঝাই, না তুমি ভুল শুনেছ, কিন্তু কে শোনে কার কথা! (পরে ও যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ক্লাসে একদিন এক ছাত্র নাকি তাকে জিজ্ঞেস করে বসেছিল, ‘স্যার, আপনি কি গরুদের কথা বুঝতে পারেন?’)
হুমায়ূনের বাবা তার জন্মের সময় আমার কাছে ছিলেন না। এক মাস পর তাঁর ছেলে দেখার সময় হলো। সবার ধারণা, হয়তো একটু লজ্জা পাবেন তিনি। কিন্তু কিসের লজ্জা! বাড়ি পৌঁছেই আমার মাকে বললেন, ‘আম্মা, বাচ্চা কোথায়, তাড়াতাড়ি দেখান।’ আমার নানি সাবধানে কাজলকে তাঁর হাতে তুলে দিলেন। অবাক হয়ে খানিকক্ষণ দেখে তাকে বুকে চেপে ধরে তাঁর সে কী আদর!
আমার বাবা আর শ্বশুর মিলে ছেলের নাম রাখলেন শামসুর রহমান। কিন্তু কাজলের বাবা নাম পাল্টে রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। ভাগ্যিস রেখেছিলেন, তা না হলে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পীকে আলাদা করতে হতো একটি মাত্র আ-কার দিয়ে। একজন হতেন কবি শামসুর রাহমান, আরেকজন হতো কথাশিল্পী শামসুর রহমান!
আমার শাশুড়ি অবশ্য কখনোই হুমায়ূন নামটাকে গ্রহণ করেননি। শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে ডেকে গেছেন ‘শামসুর মা’!
ইকবাল
ছেলেটা এত বেশি শান্তশিষ্ট ছিল যে মাঝেমধ্যে ভয় হতো, শেষে না আবার বোকাসোকা হয়! কিন্তু কদিন পরেই বুঝলাম, ভীষণ মেধাবী সে। বড় ভাইবোনের লেখাপড়া দেখে সেও দিব্যি লিখতে-পড়তে পারে! বুদ্ধিমান ছেলেপুলেরা দুষ্টু হয় জানতাম, এই ছেলে ব্যতিক্রম। বড় দুজন জন্ম থেকে দুরন্ত। ওই তুলনায় সে খুব শান্ত। কথাবার্তা বলে খুব কম। একবার কৌতূহলী হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিরে, তুই কথা বলিস না কেন?’
চার বছরের বাচ্চা গম্ভীর হয়ে বলল, বেশি কথা বলে কী লাভ?
এই হলো আমার মেজো ছেলে ইকবাল। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে মুহম্মদ জাফর ইকবাল নামে পরিচিত।
ওর জন্ম সিলেটের মীরাবাজারে। ডিসেম্বর মাসের এক ভোরে, ছয়টা ২২ মিনিটে। এমন নিখুঁত সময়ের কথা বলতে পারছি ওর বাবার কল্যাণে, একমাত্র তাঁর পক্ষেই এটা সম্ভব ছিল। যা হোক, ছেলের কথা শুনে সবাই ছুটে এল। বাচ্চাকে দেখে কারও আশ মেটে না। ধবধবে গায়ের রং, বড় বড় হাঁসের ডিমের মতো চোখ, নাদুস-নুদুস চেহারা। ওর চাচা আজীজ বাচ্চাদের খুব আদর করত। সে অনেক ভাবনাচিন্তা করে ছেলের নাম রাখল ইকবাল আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদের ভাই ইকবাল আহমেদ। বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, হঠাৎ ওদের বাবা নিউমারোলজিতে ঝুঁকে পড়লেন। কাগজে আঁকিবুঁকি করে, হিসাবপত্র করে একদিন ঘোষণা করলেন, না, নাম ঠিক হয় নাই। ওর নাম হবে জাফর ইকবাল।
কাজল ছেলেবেলা থেকে দুষ্টুমি করে বড় হয়ে পড়ালেখায় মন দিয়েছে। ইকবাল ছেলেবেলা থেকেই মনোযোগী। স্বাধীনতার পর সর্বস্ব হারিয়ে আমরা নতুন করে জীবন শুরু করেছি। ইকবাল আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয়নি। প্রাইভেট টিউশনি করেছে। খবরের কাগজে কার্টুন এঁকেছে। এমএসসি করার পর একদিন আমেরিকা চলে গেল পিএইচডি করতে। তার প্লেনের ভাড়াটাও আমার দিতে হয়নি।

শাহীন
খুব ছোটবেলায় একদিন আমার কাছে এসেছে ও। মাথা চুলকে বলল, ‘মা, ইকবাল না কালো।’ আমি তো অবাক! কী বলে এই ছেলে! ইকবাল কেন কালো হতে যাবে? কত সুন্দর গায়ের রং ওর, ধবধবে ফরসা! কী বলিস তুই? পরে বোঝা গেল, কোনো একটা নাম বা শব্দের মাঝে একটা করে রঙের দেখা পায় ছেলেটা। ওর বাবা বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, জার্মানি না জাপানে কোথায় যেন এমনটা শোনা গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওদের বাবা বিদায় নিলেন, বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়নি। খুব অল্প বয়স থেকেই সবার থেকে বেশি কষ্ট করেছে সে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রেশন তুলেছে, বাজার করেছে। এর মাঝে আবার পড়াশোনা করে মানুষ হয়েছে! এই হলো আমার ছোট ছেলে শাহীন। কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব। ওর রম্য লেখাগুলোও আমার বেশ ভালো লাগে।
শাহীনের জন্মও সিলেটে। নাম ঠিক করার সময় বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদার নাম অনুসারে ওদের বাবা ওর ভালো নাম রেখেছিলেন কুদরতে খোদা। দীর্ঘদিন পর ছেলেমেয়ে নামটি নিয়ে আপত্তি করল, নামটা নমস্য ব্যক্তির হলেও একদম সেকেলে! নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো ইবনে ফয়েজ মুহম্মদ আহসান হাবীব। ঠিক বলতে পারব না, কোনো এক সময় সে ইবনে ফয়েজ ঝেড়ে ফেলে শুধু আহসান হাবীব হয়ে গেল
(লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো থেকে নেওয়া)
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×