somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপন্যাস - নিষিদ্ধ জ্যোৎস্না - পর্ব -০৬

২২ শে মে, ২০১৩ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছয়

কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। দূর থেকেই আমাদের গলির সামনে একটা জটলা দেখতে পেলাম। কাছে এসে দেখি, মা হাত পা ছড়িয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। অকল্পনীয় দৃশ্য। আমার পর্দানশীন মা এতগুলো বেগানা পুরুষের সামনে বেপর্দা, এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
পাশের বাড়ির নুরীর মা বলল,‘ভাই, এতক্ষণে আইলা ? সব্বনাশ যা হওনের হয়া গেল।’
আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘কী সর্বনাশ ?’
‘আহারে অহন কী অইব ? এত বড় সংসার’, নুরুর মা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, ‘মাগো, কাইন্দো না গো, মা। আল্লার কেরামতি মূর্খে বোজে না।’
আমি মার দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘মা, ওঠেন। ঘরে চলেন।’
‘বাবা, আমার কপাল পুড়ল’, মা আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করতে লাগলেন। আমি বোকার মতো লোকজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
পনির ভেতরে ছিল। আমার কণ্ঠস্বর শুনে ছুটে এল। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,‘ভাইয়া, এ কি হল ?’
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘আব্বা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে।’
‘কী করেছে ওই বুড়ো হারামজাদা ?’
‘মাকে খুব মেরেছে।’
‘আজ ওই বদমাশকে মেরেই ফেলব।’
আমাকে কয়েক জন আটকাল। তাদের এক ঝটকায় সরিয়ে চলে এলাম আব্বার ঘরে।
আব্বা ঘুমাচ্ছেন। বিশ্রী তেলতেলে ভুড়িটা উঠানামা করছে। আমি জোর গলায় ডাকলাম, ‘আব্বা।’
আব্বা রক্ত চক্ষু মেলে চাইলেন। বুঝলাম, নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘আপনি কী করেছেন ?’
আব্বা পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, ‘চেচাস ক্যান ? তর ছোট মা গুডবাই। বিদায় করে দিলাম। মেয়েলোক হল দাসী বান্দী, বড় বড় কথা বলবে কেন ?’
‘তাই বলে আপনি মাকে যখন তখন মারবেন ?’
আব্বা মজা পেয়ে হাসলেন। বললেন, ‘এই শেষ মার। তর ছোট মায়ের লগে সব খতম। তর অবশ্য মায়ের অভাব হবে না। নতুন মা পাবি। ঝকঝকে, নিউ মডেল।’
‘চুপ করেন।’
‘চুপ করব ক্যান রে, বোকা ? সত্যি কথা বললাম। তর মাকে ছেড়ে দিয়েছি। তালাক। এক্কেবারে তিন তালাক।’
বলে কী এ লোক ? আমার ইচ্ছে হল, নিজের মাথা বাড়ি দিয়ে ফাটিয়ে ফেলি। এই কুৎসিত পশুটার মৃত্যু হলে খুশী হতাম। নতুবা আমি নিজেই এক দিন খুন করে ফেলব। আমার বিশ্বাস হয় না, এ আমার বাপ। এই রকম নোংরা উৎস থেকে আমি জন্ম নিতে পারি না।
বাইরে চলে এলাম। পনির লুনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হল। লুনার চোখেও পানি। সহানুভূতির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে শার্টের হাতায় চোখ মুছলাম।
কে বলবে পনির আমার সৎ বোন ? আমার আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রীর মেয়ে ? ওর মাকে আব্বা কিছুক্ষণ আগে তালাক দিয়েছেন। কী রকম অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই ভদ্র মহিলা কিছুক্ষণ আগেও ছিলেন আমার মা। এখন তিনি কেউ না। শুধু মাত্র একজন মহিলা। মানুষের সম্পর্ক কত ঠুনকো !
আমার কাঁদা উচিত। ওদের মতো করে হাপুস নয়নে কাঁদা উচিত। কিন্তু আমার চোখ অশ্রু শূন্য। হৃদয়ের গভীরে আমি যে কী ভয়ঙ্কর কাঁদছি, কাউকে দেখাতে পারছি না। এই কষ্টে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
‘ভাইয়া, আমরা তোমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’
‘চলে যাচ্ছিস মানে ? কোথায় যাচ্ছিস ? আমি তোদের কোন দিন যেতে দেব না। মা উঠেন। চলেন, ঘরে চলেন।’
নুরীর বাপ বলল, ‘করতাছ কী বাবা ? বেশরীয়তী কাম। তোমার মার ওই ঘরে থাকা এখন নাজায়েজ।’
‘আমি এই সব মানি না। আমি কিচ্ছু মানি না। ’
চিৎকার করে জানিয়ে দিলাম সবাইকে। কিন্তু আমার গলা ভেঙ্গে এল। বুকের গভীর ভেঙ্গে চলে এল উদগত কান্না। মার পাশে কাদা মাটিতে বসে আমিও হঠাৎ মার মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।
আব্বা ঘরে থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,‘চোপ রাও। সব হারামজাদা, চোপ রাও।’
আমরা ভয়ে চুপ মেরে গেলাম। কিন্তু নুরীর মার কোলের বাচ্চাটা ভ্যা করে কেঁদে দিল।
হঠাৎ করে হাড়গিলে নুরীর বাপ তেড়ে কুঁদে গেল, ‘পাইছ কী মিয়া ? বৌ ছাড়ছ ভালো কথা, কিন্তুক জুলুম কর ক্যান ? চুপ কইরা রইলা ক্যান ? মনে করছ, নেশা কর বইলা সবাই তোমারে ডরায় ?
আব্বা নুরীর বাপের দিকে মাস্তানী দৃষ্টিতে তাকালেন। হিংস্র দৃষ্টি। দাঁত চিবিয়ে বললেন,‘নুরীর বাপ, পাতলা পায়খানা হয় ?’
নুরীর বাপ ঘাবড়ে গিয়ে বলল,‘না তো। কিন্তুক এই কথা ক্যান ?’
‘এমন মার দেব যে, ছয় মাস পাতলা পায়খানা থাকবে।’
আব্বা তার ডান হাতের মাদুলিতে আল্লাহু নামটায় হাত বুলাতে লাগলেন। বিশাল এই মাদুলিতে ভর্তি আব্বার ব্যবসার মাল। টাটকা হেরোইন। আব্বার মারমুখী ভঙ্গি দেখে নুরীর বাপ ভয়ে কেটে পড়ল।
‘কলমী, উঠো। সাফ সাফ কাইট্টা পড়। নইলে লাত্থি মাইরা ড্রেনে ফালায়া রাখমু।’
আব্বার হুমকিতে মার কোন প্রতিক্রিয়া হল না। কিন্তু আশেপাশের ভীড় পাতলা হয়ে গেল। সবাই যার যার ধান্দায় চলে গেল। শুধু লুনা পনিরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
আমি আব্বার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। সাহস করে বললাম, ‘আব্বা, আপনার মতো খারাপ মানুষ হয় না।’
আব্বা প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন,‘এত দিনে বুঝলি ? ভালোই হইছে, তুইও কাইট্টা পড়।’
‘বেরিয়ে তো যাবই। এই নরকে থাকার কোন ইচ্ছা নেই।’
‘তাইলে সগগে যাও’, আব্বা মুখ বাঁকিয়ে হাসলেন,‘সঙ্গে হুর পরী তো দিয়াই দিলাম। চিন্তার কী, এখনই বিদায় হও।’
আব্বা ভুড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বারান্দার খাটে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসলেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে টানতে লাগলেন।
আমি একটা ট্রাংকে আমাদের যাবতীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম। আব্বা বারান্দায় খাটে বসে সিগারেট টানতে টানতে আমাদের কীর্তিকলাপ দেখছেন। হঠাৎ হেচকি তুলে হাসলেন। আমি চমকে তাকাতেই আরেকটা হাসি দিলেন। উপহাস। বললেন,‘একটা ট্রাংকে তোদের জিনিসপত্র না আটলে আরেকটা এনে নে। আমি টাকা দিতাছি।’
আমি তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি তরল গলায় বললেন,‘ইচ্ছে হলে ফার্নিচারও নিয়ে যেতে পারিস। একটা ট্রাক ভাড়া করে নিলেই হবে।’
কোন কথা না বলে উঠে চলে এলাম। একটা ব্যাগ কিনতে হবে। কিছু কাপড় চোপড় ট্রাংকে জায়গা হচ্ছে না। পনির ও মাকে নুরীদের ঘরে বসিয়ে একটা ব্যাগ কিনতে বেরিয়ে গেলাম।
ফিরে দেখি, পনির ও মা নেই। আমার কাপড় চোপড় নুরীদের বাসায় রেখে ওরা চলে গেছে। নুরীর মা বলল, ‘তোমারে পনির একটা চিঠি দিয়া গেছে।’
নুরীর মা একটা ক্ষুদ্র চিরকুট নিয়ে এল।
ভাইয়া,
তোমাকে কষ্ট না দেয়ার জন্যই আমরা চলে গেলাম। কোথায় গেলাম জানানো সম্ভব হল না। কোন দিন হয়তো দেখা হবে। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি, ভাইয়া। কেন এত ভালোবাসি, তা আমি নিজেও জানি না।
ইতি-
তোমার বোন পনির ।

চলবে ...

পর্ব -০১পর্ব - ০২পর্ব - ০৩পর্ব - ০৪পর্ব - ০৫পর্ব -০৭

আমার অন্যান্য ধারাবাহিক উপন্যাস :

কুষ্ঠ নিবাস

নাটকের মেয়ে



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:২৭
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×