somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দাদুর ডায়রী থেকে

২২ শে এপ্রিল, ২০১০ বিকাল ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


"আমাদের প্রকৃত জমিদারী খানাকুল কৃষ্ণনগর, জেলা হুগলী।
জমিদারীর একভাগ যায় মিদনাপুর(মেদিনীপুর) আর আরেক ভাগ আমাদের খানাকুল।

আমাদের পূর্ব পুরুষ কলকাতায় কালীঘাটে এসে ওঠেন।
8, Hazra Rd. (Late Sarat ch. Sinha’s fore fathers) এবং 91 Beltolla Rd. (my ancestors) যেখানে আমার (সমরচন্দ্র সিংহ) জন্ম হয়।

আমার ঠাকুরদা ঁগিরীশচন্দ্র সিংহ, আমি যখন শিশু তখন বৃদ্ধ বয়সে মারা যান। তিনি খুবই স্বাস্থ্যবান, গৌরবর্ণ এবং সু-পুরুষ ছিলেন।

আমার ঠাকু’মা ঁনিমাইবালা দেবী খুব সুন্দরী এবং গৌরবর্ণা মহিয়সী মহিলা ছিলেন। খুব ছেলেবেলার স্মৃতিকথায় আমার তাঁকে মনে পরে, তিনি খুবই সাত্ত্বিক বৃদ্ধা ছিলেন। তাঁর ঠাকুর ঘর নানান হিন্দু দেব-দেবীর ছবিতে পূর্ণ ছিল। আমাদের পরিবারের কাছে সে ঘরটি অতি পবিত্র ছিল।
আমি স্মৃতিতে তাঁকে দেখতে পাই, তিনি লাল শাড়ি পরতেন। অনেক রুদ্রাক্ষের মালা এবং কঙ্কণ আর উপর বাহুতে অনন্ত পরতেন (সোনা-রূপার গহনা তিনি পরতেন না)। বিভিন্ন আকারের মন্ত্রপূত কবচ(ছোট থেকে বিশাল বড় ২” পর্যন্ত!) তাঁর গলায় এবং উপর বাহুতে ঝুলত। ঠাকু’মার চুল সাদা ছিল। তাঁর চওড়া সিঁথে লাল সিঁদুরে আবৃত থাকত এবং সেই সঙ্গে একটি বিশাল বড় গোল সিঁদুরের টিপ তাঁর প্রশস্ত কপালে উজ্জ্বল ভাবে অবস্থান করত, তান্ত্রিকদের মত।

আমার খুব আব্‌ছা মনে পরে বেলতলায় আমাদের এলাকার প্রতিবেশীরা অসুস্থ হলে ঠাকুমার কাছে মন্ত্রপূত কবচ এবং প্রসাদ নিতে আসতেন। তিনি এভাবে ওসুধ প্রয়োগে সফল এবং জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি খুব সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করতেন। ঠাকুরদা বেঁচে থাকলেও তিনি সম্পূর্ণ নিরামিশ ভোজন করতেন।

আমি জানতাম অল্পবয়সে তিনি স্বাস্থ্যবতী ও দৃঢচিত্তের অধিকারিনীও ছিলেন। কৈশরে আমি আমার কাকির(ঁপ্রকাশচন্দ্রের স্ত্রী) কাছে শুনেছি এবং দেখেওছি আমার বাবাও যুবা বয়সে আসাধারণ শক্তিও স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন।

আমার ঠাকুরদা যদিও B.A. পাশ করা হাইকোর্টের অনুবাদক ছিলেন, তবু তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য প্রায়ই বিহার, উত্তরপ্রদেশ যেতেন। তাঁর ঘি ও মাখন সরবরাহের ব্যবসা ছিল। তাঁর ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান চলছিল। এ কারণে তাঁকে কিছুকাল বহুদিন কলকাতার বাসা ছেড়ে বিহারে অবস্থান করতে হয়।

আমার ঠাকুমাকে বরাবর দারিদ্রের ভিতর সংসার চালাতে হয়। তখন তিনি তিন পুত্র ও দুই কন্যার জননী। একসময় শোচনীয় দারিদ্র তাঁকে বেলতলার বাড়ি ছেড়ে পাঁচ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে খানাকুলে যাত্রা করতে হয়। সে যুগে এই যাত্রা ছিল অতি দুরুহ(আনুমানিক ১৯০০ খ্রীঃ)। ট্রেনও গরুর গাড়িতে করে আমতা পর্যন্ত গিয়ে তারপর নৌকায় যাত্রা করতে হয়। তারপর ৫-৭ মাইল(বেশিতো কম না!) হাঁটাপথ, যা দুর্গম কাঁচা রাস্তা।

আমার ঠাকুমা তখন খুবই স্বাস্থ্যবতী, কিছুটা স্থূলা। কিছু মাইল চলার পর প্রচন্ড গ্রীষ্মের তাপে(সময়টা বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ) তিনি অসম্ভব মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পরেন। তার উপর এত পথ হাঁটায় তাঁর দুই উরু ঘর্ষণে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। এই অবর্ণনীয় কষ্ট, অসম্ভব পথ পরিশ্রম তাঁকে ক্লান্তির শেষ সীমায় উপনিত করল। এর সাথে ছিল বহুক্ষণ অনাহার। মূর্ছা যাওয়ার মত তাঁর অবস্থা হল। তবু তিনি সব কিছু অগ্রাহ্য করে আবার চলতে শুরু করলেন। তাঁর সবচেয়ে ছোট শিশু পুত্র ও কন্যাটি ক্ষুধা ও কষ্টে সারাপথ কেঁদে চললো।

এইরূপ অবস্থায় আমার পিতা তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই এবং বোনকে দুই কাঁধে বসিয়ে নিলেন এবং আর একজনকে কোমড়ে বেঁধে নিলেন। তারপর মার কষ্ট দেখে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। সঙ্গে এক ভাই থেকে গেল। এভাবে আবার যাত্রা শুরু হল। ধিরে ধিরে তারা ক্রমশ গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। যখন নিজেরদের গ্রামে প্রবেশ করলেন তখন পুর অঞ্চলকে যেন এক কঠিন অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে।

কিন্তু এত পরিশ্রম করে গভীর রাতে যখন তারা নিজের ভিটেতে পৌঁছতে সক্ষম হলেন তখন দুর্ভাগ্যবশত খাদ্য বা অর্থ – কোন রূপ সাহায্য না দিয়েই তাদের বিতাড়িত করা হল। আসলে তখন আমার ঠাকুরদার সঙ্গে এক কঠিন বৈষয়িক ঝামেলা চলছিল। গ্রামের আত্মীয়রা ভাবলেন ঠাকুরদা কৌশলে করুণার আশ্রয়ে সম্পত্তি হস্তগত করতে রাতারাতি স্ত্রী-পুত্রদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালেন না।

আত্মমর্যাদা সম্পন্না, প্রগাঢ বুদ্ধিমতী মহিলা আমার ঠাকুমা অনুনয়, বিনয় বা করুণা প্রার্থণা করলেন না। সে রাতে তিনি সন্তানদের নিয়ে বাইরে একটি আটচালায় কাটালেন এবং মুড়ি, কিছু বাতাসা ও শীতল জল সন্তানদের আহার করালেন এবং নিজেও গ্রহণ করলেন।

তারপর দিন সকালেই তারা কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। ঠাকুমার শেষ সম্পদ –হাতের কঙ্কণ যা সোনার তারে জরান ছিল, সেটি গ্রামের হাটে বিক্রি করা হল। সেই অর্থে তারা খাদ্য সংগ্রহ করলেন এবং ফেরার জন্য গরুর গাড়ি, নৌকা ও ট্রেনে যাতায়াতের জন্য রাখলেন।

পরবর্তী কিছুকাল আমাদের কলকাতার বেলতলার বাড়িটি বন্ধক রাখতে হয় আমাদেরই আরেক পিতৃপুরুষের কাছে খুব সামান্য মূল্যে। পরবর্তীকালে কিছু সম্পত্তি ভাগ্যক্রমে রক্ষা পায় আমার পিতা ও কাকার কল্যাণে। আমাদের মিদ্‌নাপুর ও হুগলী খানাকুলের অংশের বিনিময়ে।

আমার পিতা ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারপরে আরো তিন ভাই ও তিন বোন ছিল। আমার পিতা ঁপ্রবোধচন্দ্র সিংহ - খুব অল্প বয়স থেকে সংসারের দুঃখ–কষ্ট দেখেন। তাই তিনি খুব অল্প বয়সেই বোস’স্‌ সার্কাসে (Bose’s Circus) চাকরী নেন। বোস’স্‌ সার্কাস তখনকার যুগে বিখ্যাত সার্কাস পার্টি ছিল।

আমার পিতা সেখানে উড়ন্ত ট্রাপিজ্‌ খেলা, খাঁচায় বন্ধ বাঘের সঙ্গে খেলা এবং বুকের উপর হাতি দাঁড়ানোর খেলা দেখাতেন। তিনি জাপান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় সার্কাসদলের সাথে ভ্রমণ করেন। এভাবে তিনি পুর সংসারের ভরণপোষণ করতেন।
তিনি আমার দুই কাকাকে লেখাপড়া শেখান। আমার মেজ কাকা ঁপ্রকাশচন্দ্র সিংহ ভেটেনারী সার্জেন স্নাতক হয়েছিলেন।"
..........................................
এই পর্যন্ত দাদু লিখে গেছেন- শুনেছি দাদুর বাবা অল্প বয়সে ট্রাপিজের খেলা দেখাতে গিয়ে পায়ে লোহার পেরেক ফুটে শেখান থেকে সেপ্‌টিক হয়ে মারা যান, ছোট ছোট চার সন্তান রেখে।

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১০ রাত ৯:৫৩
৬৯টি মন্তব্য ৭৫টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×