"আমাদের প্রকৃত জমিদারী খানাকুল কৃষ্ণনগর, জেলা হুগলী।
জমিদারীর একভাগ যায় মিদনাপুর(মেদিনীপুর) আর আরেক ভাগ আমাদের খানাকুল।
আমাদের পূর্ব পুরুষ কলকাতায় কালীঘাটে এসে ওঠেন।
8, Hazra Rd. (Late Sarat ch. Sinha’s fore fathers) এবং 91 Beltolla Rd. (my ancestors) যেখানে আমার (সমরচন্দ্র সিংহ) জন্ম হয়।
আমার ঠাকুরদা ঁগিরীশচন্দ্র সিংহ, আমি যখন শিশু তখন বৃদ্ধ বয়সে মারা যান। তিনি খুবই স্বাস্থ্যবান, গৌরবর্ণ এবং সু-পুরুষ ছিলেন।
আমার ঠাকু’মা ঁনিমাইবালা দেবী খুব সুন্দরী এবং গৌরবর্ণা মহিয়সী মহিলা ছিলেন। খুব ছেলেবেলার স্মৃতিকথায় আমার তাঁকে মনে পরে, তিনি খুবই সাত্ত্বিক বৃদ্ধা ছিলেন। তাঁর ঠাকুর ঘর নানান হিন্দু দেব-দেবীর ছবিতে পূর্ণ ছিল। আমাদের পরিবারের কাছে সে ঘরটি অতি পবিত্র ছিল।
আমি স্মৃতিতে তাঁকে দেখতে পাই, তিনি লাল শাড়ি পরতেন। অনেক রুদ্রাক্ষের মালা এবং কঙ্কণ আর উপর বাহুতে অনন্ত পরতেন (সোনা-রূপার গহনা তিনি পরতেন না)। বিভিন্ন আকারের মন্ত্রপূত কবচ(ছোট থেকে বিশাল বড় ২” পর্যন্ত!) তাঁর গলায় এবং উপর বাহুতে ঝুলত। ঠাকু’মার চুল সাদা ছিল। তাঁর চওড়া সিঁথে লাল সিঁদুরে আবৃত থাকত এবং সেই সঙ্গে একটি বিশাল বড় গোল সিঁদুরের টিপ তাঁর প্রশস্ত কপালে উজ্জ্বল ভাবে অবস্থান করত, তান্ত্রিকদের মত।
আমার খুব আব্ছা মনে পরে বেলতলায় আমাদের এলাকার প্রতিবেশীরা অসুস্থ হলে ঠাকুমার কাছে মন্ত্রপূত কবচ এবং প্রসাদ নিতে আসতেন। তিনি এভাবে ওসুধ প্রয়োগে সফল এবং জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি খুব সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করতেন। ঠাকুরদা বেঁচে থাকলেও তিনি সম্পূর্ণ নিরামিশ ভোজন করতেন।
আমি জানতাম অল্পবয়সে তিনি স্বাস্থ্যবতী ও দৃঢচিত্তের অধিকারিনীও ছিলেন। কৈশরে আমি আমার কাকির(ঁপ্রকাশচন্দ্রের স্ত্রী) কাছে শুনেছি এবং দেখেওছি আমার বাবাও যুবা বয়সে আসাধারণ শক্তিও স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন।
আমার ঠাকুরদা যদিও B.A. পাশ করা হাইকোর্টের অনুবাদক ছিলেন, তবু তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসার জন্য প্রায়ই বিহার, উত্তরপ্রদেশ যেতেন। তাঁর ঘি ও মাখন সরবরাহের ব্যবসা ছিল। তাঁর ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান চলছিল। এ কারণে তাঁকে কিছুকাল বহুদিন কলকাতার বাসা ছেড়ে বিহারে অবস্থান করতে হয়।
আমার ঠাকুমাকে বরাবর দারিদ্রের ভিতর সংসার চালাতে হয়। তখন তিনি তিন পুত্র ও দুই কন্যার জননী। একসময় শোচনীয় দারিদ্র তাঁকে বেলতলার বাড়ি ছেড়ে পাঁচ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে খানাকুলে যাত্রা করতে হয়। সে যুগে এই যাত্রা ছিল অতি দুরুহ(আনুমানিক ১৯০০ খ্রীঃ)। ট্রেনও গরুর গাড়িতে করে আমতা পর্যন্ত গিয়ে তারপর নৌকায় যাত্রা করতে হয়। তারপর ৫-৭ মাইল(বেশিতো কম না!) হাঁটাপথ, যা দুর্গম কাঁচা রাস্তা।
আমার ঠাকুমা তখন খুবই স্বাস্থ্যবতী, কিছুটা স্থূলা। কিছু মাইল চলার পর প্রচন্ড গ্রীষ্মের তাপে(সময়টা বৈশাখ অথবা জ্যৈষ্ঠ) তিনি অসম্ভব মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পরেন। তার উপর এত পথ হাঁটায় তাঁর দুই উরু ঘর্ষণে যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। এই অবর্ণনীয় কষ্ট, অসম্ভব পথ পরিশ্রম তাঁকে ক্লান্তির শেষ সীমায় উপনিত করল। এর সাথে ছিল বহুক্ষণ অনাহার। মূর্ছা যাওয়ার মত তাঁর অবস্থা হল। তবু তিনি সব কিছু অগ্রাহ্য করে আবার চলতে শুরু করলেন। তাঁর সবচেয়ে ছোট শিশু পুত্র ও কন্যাটি ক্ষুধা ও কষ্টে সারাপথ কেঁদে চললো।
এইরূপ অবস্থায় আমার পিতা তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই এবং বোনকে দুই কাঁধে বসিয়ে নিলেন এবং আর একজনকে কোমড়ে বেঁধে নিলেন। তারপর মার কষ্ট দেখে তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। সঙ্গে এক ভাই থেকে গেল। এভাবে আবার যাত্রা শুরু হল। ধিরে ধিরে তারা ক্রমশ গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হতে থাকলেন। যখন নিজেরদের গ্রামে প্রবেশ করলেন তখন পুর অঞ্চলকে যেন এক কঠিন অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে।
কিন্তু এত পরিশ্রম করে গভীর রাতে যখন তারা নিজের ভিটেতে পৌঁছতে সক্ষম হলেন তখন দুর্ভাগ্যবশত খাদ্য বা অর্থ – কোন রূপ সাহায্য না দিয়েই তাদের বিতাড়িত করা হল। আসলে তখন আমার ঠাকুরদার সঙ্গে এক কঠিন বৈষয়িক ঝামেলা চলছিল। গ্রামের আত্মীয়রা ভাবলেন ঠাকুরদা কৌশলে করুণার আশ্রয়ে সম্পত্তি হস্তগত করতে রাতারাতি স্ত্রী-পুত্রদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফলে কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালেন না।
আত্মমর্যাদা সম্পন্না, প্রগাঢ বুদ্ধিমতী মহিলা আমার ঠাকুমা অনুনয়, বিনয় বা করুণা প্রার্থণা করলেন না। সে রাতে তিনি সন্তানদের নিয়ে বাইরে একটি আটচালায় কাটালেন এবং মুড়ি, কিছু বাতাসা ও শীতল জল সন্তানদের আহার করালেন এবং নিজেও গ্রহণ করলেন।
তারপর দিন সকালেই তারা কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য যাত্রা শুরু করলেন। ঠাকুমার শেষ সম্পদ –হাতের কঙ্কণ যা সোনার তারে জরান ছিল, সেটি গ্রামের হাটে বিক্রি করা হল। সেই অর্থে তারা খাদ্য সংগ্রহ করলেন এবং ফেরার জন্য গরুর গাড়ি, নৌকা ও ট্রেনে যাতায়াতের জন্য রাখলেন।
পরবর্তী কিছুকাল আমাদের কলকাতার বেলতলার বাড়িটি বন্ধক রাখতে হয় আমাদেরই আরেক পিতৃপুরুষের কাছে খুব সামান্য মূল্যে। পরবর্তীকালে কিছু সম্পত্তি ভাগ্যক্রমে রক্ষা পায় আমার পিতা ও কাকার কল্যাণে। আমাদের মিদ্নাপুর ও হুগলী খানাকুলের অংশের বিনিময়ে।
আমার পিতা ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র। তারপরে আরো তিন ভাই ও তিন বোন ছিল। আমার পিতা ঁপ্রবোধচন্দ্র সিংহ - খুব অল্প বয়স থেকে সংসারের দুঃখ–কষ্ট দেখেন। তাই তিনি খুব অল্প বয়সেই বোস’স্ সার্কাসে (Bose’s Circus) চাকরী নেন। বোস’স্ সার্কাস তখনকার যুগে বিখ্যাত সার্কাস পার্টি ছিল।
আমার পিতা সেখানে উড়ন্ত ট্রাপিজ্ খেলা, খাঁচায় বন্ধ বাঘের সঙ্গে খেলা এবং বুকের উপর হাতি দাঁড়ানোর খেলা দেখাতেন। তিনি জাপান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি এবং দক্ষিণ আমেরিকায় সার্কাসদলের সাথে ভ্রমণ করেন। এভাবে তিনি পুর সংসারের ভরণপোষণ করতেন।
তিনি আমার দুই কাকাকে লেখাপড়া শেখান। আমার মেজ কাকা ঁপ্রকাশচন্দ্র সিংহ ভেটেনারী সার্জেন স্নাতক হয়েছিলেন।"
..........................................
এই পর্যন্ত দাদু লিখে গেছেন- শুনেছি দাদুর বাবা অল্প বয়সে ট্রাপিজের খেলা দেখাতে গিয়ে পায়ে লোহার পেরেক ফুটে শেখান থেকে সেপ্টিক হয়ে মারা যান, ছোট ছোট চার সন্তান রেখে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১০ রাত ৯:৫৩