somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড়পুকুরিয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উন্মুক্ত খনন বাসনা, জার্মান প্রতিনিধি দলের ফুলবাড়ি সফর এবং উন্মুক্ত খননে জার্মান সাফল্যের মিথ

২১ শে এপ্রিল, ২০১০ রাত ৮:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

”উন্মুক্ত খনির ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব কোন অর্থনৈতিক স্বার্থ নেই। যতদূর জানি, বাংলাদেশ সরকার যে কোন মূল্যে উন্মুক্ত খনি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন আমাদের কাছে যদি আপনাদের সরকার কারিগরী পরামর্শ সহ অন্যান্য সহযোগীতা চান তাহলে আমরা সানন্দে এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগীতা করবো। আমরা জার্মানিতে বেশ সফলতার সাথে উন্মুক্ত খনি খনন এবং এর নানান পরিবেশগত দিক সামাল দিয়েছি। এখন আমরা যদি এই উন্মুক্ত খনি প্রকল্পে অংশ না নেই তাহলে তো সেটা থেমে যাবে না, আর কেউ এসে ঠিকই কাজটি করবে। ধরেন, যদি চীন আসে তাহলে তো তারা আমাদের মতো আপনাদের কাছে কোন মতামত শুনতে আসবে না, তাদের কাছে মুনাফাই মূল।” কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশে জার্মান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং উন্নয়ণ সহায়তা কমিটির প্রধান হানস হাইনরিখ স্ক্নেলে ফুলবাড়ীর সড়ক ও জনপদ বিভাগের ডাকবাংলোতে বসে। সেখানে গত ১০ এপ্রিল ২০১০ তারিখে ৫ সদস্যের একটি জার্মান প্রতিনিধি দলের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবলু সহ স্থানীয় আন্দোলনকারী জনগণের সাথে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির স্থানীয় নেতৃবৃন্দও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত ফুলবাড়ীবাসীর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, স্থানীয় জনসাধারণের মতামত উপেক্ষা করে এবং ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ফুলবাড়ী চুক্তি ভঙ্গ করে যদি সরকার উন্মুক্ত খনি করতে চায় তাহলে তারা এতে অংশ নেবে কি-না। জাবাবে বাংলাদেশে জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন: ”এই মূহূর্তে এই হাইপোথ্যাটিক্যাল প্রশ্নটির উত্তর দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।” প্রতিনিধি দলে উপস্থিত রক্ষণশীল দলের সংসদ সদস্য জুরগেন ক্লিমকে এবং জার্মান রাষ্ট্রদূত হোলগেন মাইকেল উভয়ই যদিও দাবী করেছেন তারা তাদের দেশে সফল ভাবে উন্মুক্ত খনির মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করেছেন, প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য, জার্মান লেফট পার্টির এমপি, নিইমা মোভাসাত স্বীকার করেছেন, ”জার্মানীতে উন্মুক্ত খনির পরিবেশগত সমস্যা আগেও যেমন ছিল, এখনও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ অব্যহত আছে।” একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বড়পুকুরিয়ায় বাংলাদেশের প্রথম উন্মুক্ত খনি খননের বাসনা ব্যাক্ত করেন। বৈঠকে তিনি কেমন করে উন্মুক্ত খনির পরিবেশগত বিপর্যয়ের বিষয়টিকে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়ে কথাবার্তা বলেন বলে জানা যায়। এর ঠিক তিনদিন পর গত ১৩ এপ্রিল ”দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস” পত্রিকায় জার্মানির আরডব্লিউই এজি কোম্পানির প্রতিনিধি ড.থমাস ভন সোয়ার্জেনবার্গ এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ”কোল মাইনিং ইন ওপেন পিট: এক্সপেরিয়ান্স ইন জার্মানি চ্যালেঞ্জ ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রবন্ধটিতে লেখক জার্মান আরডব্লিউই এজি কোম্পানি কর্তৃক ”পরিবেশ সম্মত ভাবে” ফুলবাড়ি-বড়পুকুরিয়া অঞ্চলে উন্মুক্ত কয়লা খনির সম্ভাবনার কথা বয়ান করেন। বড়পুকুরিয়া এবং ফুলাবাড়ি একই কোল বেড ইউনিটের অর্ন্তভূক্ত বলে মন্তব্য করে এই এলাকার উন্মুক্ত খনির সম্ভাব্য রোড ম্যাপ সম্পর্কে তিনি বলেন:” কয়লা খননে দেরী করতে না চাইলে, প্রথমে ফুলবাড়িকে দিয়েই শুরু করা উচিত যেহেতু ফুলবাড়ি অঞ্চল নিয়ে ইতোমধ্যেই সবচেয়ে ভালো গবেষণাগুলো হয়েছে। উন্মুক্ত খনিটির ডিজাইন এমন হওয়া উচিত যেন ফুলবাড়ি থেকে উন্মুক্ত খনন করতে করতে বড়পুকুরিয়ার দিকে যাওয়া যায়..”। বড়পুকুরিয়া এবং ফুলাবাড়ি অঞ্চলের কয়লার গভীরতা এবং হাইড্রোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের সাথে তিনি আরডব্লিউই এজির জার্মানিতে করা উন্মুক্ত খনির মিল নির্দেশ করে তিনি বলেন: ”বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা দাড়াবে পুনর্বাসন। যে পদ্ধতিতে এ কাজটি করা হয় তা জার্মানিতে আরডব্লিউ এজি গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পন্ন করে আসছে। বাংলাদেশের কয়লার গভীরতাও আরডব্লিউই পরিচালিত কয়লা খনিগুলোর মতোই ৩০০ মিটারের বেশী গভীর...”।

জার্মানিতে প্রতিবর্গ কিমি এ জনসংখ্যার ঘনত্ব ২৩২ এবং বাংলাদেশে ১০৬৩। পরিবেশ, মাটির গঠন, কয়লা স্তরের গভীরতা, হাইড্রোলজি ইত্যাদি বাদ দিলেও স্রেফ ঘনবসতির বিবেচনাতেই জার্মানির তুলনায় প্রায় ৫গুণ বেশি জনসংখ্যা-ঘনত্বের দেশ বাংলাদেশের উন্মুক্ত খনির সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মাত্রার সাথে কম ঘনবসতির দেশ জার্মানীর কোন অর্থেই তুলনা হতে পারে না। অথচ আমরা দেখছি বারবার উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদনের পক্ষের যুক্তি হিসেবে জার্মানির উন্মুক্ত কয়লা খনির ”সাফল্যের” দোহাই পারা হচ্ছে। এর আগেও জার্মান টেকনিক্যাল এজেন্সি জিটিজেড এর মধ্যস্থতায় এশিয়া এনার্জি এবং জার্মান কোম্পানি আরউব্লিই এর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এশিয়া এনার্জি ও আরডব্লিউই এর পার্টনারশিপে তোলা কয়লা দিয়ে আরডব্লিউই এর বিদ্যুৎ উৎপাদনের খায়েশ মেটানোর পক্ষে দালাল তৈরীর প্রচেষ্টা হিসেবে সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী এবং মন্ত্রী এমপিদের জার্মানী ঘুরিয়েও আনা হয়েছে। ভাবখানা এমন, যেন জার্মানিতে উন্মুক্ত খনি খনন করা হয়েছে বলেই বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনন জায়েজ হয়ে যাবে কিংবা জার্মান উন্মুক্ত কয়লা খনির মডেলের মধ্যে যেন কোন পরিবেশ ও জীবন-জীবিকা ধ্বংসের কোন বালাই নেই! এই রকম একটা পরিস্থিতিতে জার্মান প্রতিনিধি দলের ফুলবাড়িতে আগমন, প্রধানমন্ত্রীর উন্মুক্ত খননের ইচ্ছা পোষণ এবং তার পরপর পত্রিকায় জার্মান আরডব্লিউই এজি কোম্পানির প্রতিনিধির ফুলবাড়ি এবং বড়পুকুরিয়ায় একযোগে উন্মুক্ত খনি খননের নসিহত করা লেখা প্রকাশ ইত্যাদি ঘটনাগুলোকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। এ অবস্থায়, পরিবেশ-প্রকৃতি-জনসংখ্যাঘনত্ব কোন দিক দিয়েই বাংলাদেশের সাথে জার্মানির কোন তুলানা চলেনা- বারবার এই কথাগুলো বিভিন্ন ভাবে পরিস্কার করার পরও যেহেতু এখনও জার্মানিকে উন্মুক্ত কয়লা খনির আদর্শ মডেল হিসেবে হাজির করার প্রচেষ্টাটি জারি রয়েছে সেকারণেই আমরা উন্মুক্ত পদ্ধতির ”আদর্শ” খোদ জার্মানির জনগণ ও পরিবেশের উপর উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের ফলাফলটুকু একটু যাচাই বাছাই করে দেখা জরুরী বলে মনে করছি।

জার্মান উন্মুক্ত কয়লা খনি

ফেডারেল মাইনিং এক্টের মাধ্যমে জার্মানিতে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে লিগনাইট কয়লা উত্তোলন করা হয়। এই মাইনিং এক্টের আওতায় প্রায় ৩০০’রও বেশি স¤প্রদায়কে উচ্ছেদ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯-৮০ সালের সময়কার তেল সংকটকে কাজে লাগিয়ে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লা উত্তোলন বেগবান করার অযুহাতে এ আইনের আওতায় উন্মুক্ত কয়লা খনি জায়েজ করা হয়েছে। পূর্ব জার্মানির লুসিটিয়াতে ওপেনপিট লিগনাইট মাইনিং করছে ভ্যাটেনফল, পশ্চিম জার্মানির রাইনল্যান্ডে করছে আরডব্লিউই এজি এবং জার্মানির মধ্যাঞ্চলে কাজ করছে মিবরাগ কর্পোরেশন।ভ্যাটেনফল কর্পোরেশনটির মালিক সুইডেনের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ভ্যাটেনফল ইউরোপ এজি এবং মিবরাগ কর্পোরেশনের মালিক ন্যাদারল্যান্ডের মিবরাগ বিভি নামের হোল্ডিং কোম্পানির মাধ্যমে আসলে যুক্তরাষ্ট্র। আর আরডব্লিউই এজি হলো জার্মান কোম্পানি।

উচ্ছেদ

উন্মুক্ত খনির ফলে ভূ-পৃষ্টের গঠন পাল্টে যায় এবং ভূ-পৃষ্টে বসবাসরত মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি ধবংস হয়। উন্মুক্ত খনির ফলে জার্মানিতে এ যাবত কতগুলো গ্রাম ধবংস হয়েছে তার কোন পূর্ণাঙ্গ হিসাব করা হয়নি, এ কাজটি করার জন্য জর্মান সরকারেরও কোন মাথা ব্যাথা নেই। বেসরকারী ভাবে গ্রীন লীগ নামের পরিবেশবাদী সংগঠনের হিসেবে দেখা যায় উন্মুক্ত কয়লা খনির ফলে শুধু লুসাটিনিয়ান মাইনিং এলাকা থেকেই এ পর্যন্ত ১৩৬ টি স¤প্রদায়ের ২৫,০০০ মানুষকে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে, যার মধ্যে ৮১ টি স¤প্রদায় একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সোর্ব সাংস্কৃতিক সংগঠন ’দমোভিনা’র হিসেবে ১৯২৪ সাল থেকে লুসাটিনিয়া অঞ্চলে উন্মুক্ত খনির ফলে মোট ১২৩ টি গ্রাম ধবংস হয়েছে।

মধ্য জার্মানিতে উন্মুক্ত খননের মাধ্যমে ১২০ টি স¤প্রদায় ধবংস করা হয়েছে এবং মোট ৪৭,০০০ এর বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। কেবল লিপজিগ এর দক্ষিণ দিকেই ১৯২৪ সাল থেকে মোট ৬৬ টি গ্রাম ধবংস করা হয়েছে এবং ২৩,০০০ এর ও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যূত করা হয়েছে।

ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ এর জার্মান শাখা বুন্দ(BUND) হিসেব করেছে রাইন ল্যান্ডে ১৯৮৫ সালের আগেই ৫০টিরও বেশি
গ্রাম ধবংস করা হয়েছে এবং ৩০,০০০ এরও বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বুন্দ এর হিসেবে জার্মান লিগানাইট মাইনিং এর মাধ্যমে ৩০০ এর বেশি স¤প্রদায়ের ১ লক্ষরও বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

২০০৪ সালে পোলিশ সীমান্তের কাছে পূর্ব জার্মানির ঐতিহ্যবাহী হর্নো গ্রামের সোর্ব আদিবাসীদের নৃতাত্তিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণের ধারে কাছে না গিয়ে ভ্যাটেনফল সেখানে উন্মুক্ত খনি করে। লাকোমা সেটেলমেন্টের নিকটবর্তী অঞ্চলটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষিত সংরক্ষিত জলাভূমি এবং গুরুত্বপূর্ণ পাখি-অঞ্চল বলে বিবেচিত হলেও ভ্যাটেনফল উন্মুক্ত খনি খনের প্রস্তুতি হিসেবে সে অঞ্চলের ভূ-গর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করে। একই ভাবে মিবরাগ কর্পোরেশন স্যাক্সোনির হিউয়েরসডরফ এর মতো প্রাচীন গ্রাম ধবংস করেছে। আর আরডব্লিউই কোম্পানি ২০৪৫ সাল নাগাদ গর্জভইলার-২ খনির বিস্তারের জন্য মোট ১৮ টি স¤প্রদায়ের ৮০০০ অধিবাসীকে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেছে।

বর্তমানে আরডব্লিউই পরিচালিত রাইনল্যান্ডের হামবাখ কোয়ারিকে কিছু দিন আগ পর্যন্তও বলা হতো ”দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মানব নির্মিত গর্ত।”বর্তমানে অবশ্য কলম্বিয়ার কেরেজন মাইন তার দখল করেছে। হামবাখ কোয়ারিতে মাটির ৪৫০ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় ২.৩ বিলিয়ন টন লিগনাইট কয়লা সঞ্চিত আছে। একেকটি ১৩,০০০ টন ক্ষমতার মোট ৮টি খনন যন্ত্র সেখানে কাজ করছে। এই উন্মুক্ত খনির ফলে মোট ৮৫ বর্গ কিমি এলাকা খনন করা হবে যার মধ্যে ৪০ বর্গ কিমি জুড়ে হামবাখ বনভূমিও রয়েছে। এই বনভূমির মাত্র ১৫ কিমি এলাকা খননের হাত থেকে রক্ষা পাবে। এই খনির জন্য ৪৫ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি মাটির নীচ থেকে উত্তোলন করা হবে এবং মোট ৫,২০০ স্থানীয় অধিবাসীকে সরানো হবে। এই উন্মুক্ত খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে ৩,৮৬৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার জার্মানির সর্ববৃহৎ কয়লা-বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানোর জন্য।

বেকারত্ব:

উন্মক্ত খনন পদ্ধতি অধিকতর ভরি যন্ত্রপাতি নির্ভর হওয়ায় এ পদ্ধতিতে কর্মসংস্থান নষ্ট হওয়ার তুলনায় নতুন কর্ম সংস্থান তৈরী হওয়ার হার সামান্য। ফলে জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র , অষ্ট্রেলিয়া সহ যে সব দেশেই উন্মুক্ত খনি হয়েছে সেখানে খনি অঞ্চলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের খনি এলাকা গুলোতে দেশের গড় বেকারত্বের হারের চেয়ে বেশি বেকারত্ব লক্ষ করা গেছে। জার্মানির পূর্ব দিকে ভ্যাটেনফল পরিচালিত চারটি অঞ্চলেই বেকারত্বের অভিশাপ জার্মানির অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির ফলে এই হার বেড়েই চলেছে। ১৯৯০ সালের পর পূর্ব জার্মানিতে উন্মুক্ত খয়লা খনির উৎপাদনশীলতা ৪ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেকারত্বের হারও বেড়েছে। ১৯৮০ সালে খনিগুলোতে যেখানে ১ লক্ষ ৪০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান ছিল, বর্তমানে কর্পোরেট উন্মুক্ত খনিগুলোতে স্রেফ ১০/১২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। ২০০৪ সালের জুন মাসে ভ্যাটেনফল এর কর্মী সংখ্যা ছিল ৮,৪৯০ জন। ২০০৬ সালে এসে সে সংখ্যা দাড়ায় ৭.৮৬০ জন। অন্যদিকে মিবরাগ কর্পোরেশনের কর্মী সংখ্যা ২০০৪ এর মার্চ নাগাদ ছিল ২,১৪৮ জন।


মরুকরণ ও পরিবেশ বিপর্যয়:

উন্মুক্ত খনি খননের একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলো ওয়াটার টেবিল বা পানির স্তরকে নীচে নামানো যেন খনির কয়লা পানি বিহীন অবস্থায় উত্তোলন করা যায়। আর ওয়াটার টেবিল নীচে নামানোর জন্য খনি এলাকা থেকে পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলে অনত্র সরিয়ে ফেলা হয়। জার্মানিতে এরকম হাজার হাজার পাম্পের মাধ্যমে এই পানি উত্তোলন ও মরুকরণ চলছে।
জার্মানিতে প্রতি একটন কয়লা/ওভার বার্ডেন উত্তোলনের জন্য মাটির নীচ থেকে এক ঘর্নমিটার পানি সরিয়ে ফেলতে হয়। এভাবে উন্মুক্ত খনির মাধ্যমে প্রতিবছর ৬৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি মাটির নীচ থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এই পানিকে পাইপের মাধ্যমে জলাভূমিতে সঞ্চলাতি করে পরবর্তীতে আবার কয়লা তোলা শেষে উন্মুক্ত খনি এলাকায় ফেরত আনা হলেও ফলাফল অনিশ্চিত। খনন কাজ শেষে খনি এলাকায় একটা কৃত্রিম ভূমি জেগে উঠে যার উর্বরতা, জৈব-অজৈব বৈশিষ্ট ফিরে পেতে হয়তো হাজার বছরেরও বেশি সময় লাগবে। ব্য্রান্ডেনবার্গ এর পরিবেশ সংস্থার সভাপতি ম্যাথিয়াস ফ্রিউয়েড ২০০৪ সালে রাজ্য সভা বা স্টেট এসেম্বলিকে জানিয়েছিলেন গত সত্তর বছরে রাজ্যটির ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১ মিটার নেমে গিয়েছে অর্থাৎ ২৯,৪৭৭ বর্গ কিমি এলাকা থেকে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি কারণ হিসেবে উন্মুক্ত খনি ছাড়াও চাষাবাদ, শিল্পায়নকেও নির্দেশ করেছিলেন। এভাবে গোটা জার্মানিতে ৮০ বিলিয়ন ঘনমিটার সমপরিমাণ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।

আর এভাবে পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়ার ফলাফল হয়েছে মারাত্মক। জার্মান-ন্যাদারল্যান্ড জলাভূমির Maas-Schwalm-Nette এর প্রাকৃতিক পানি চক্র ইতোমধ্যেই ধবংস হয়ে গেছে। ফলে চাষাবাদ পুরোটাই কৃত্রিম জলসেচের উপর নির্ভরশীল। এলাকার বাস্তুসংস্থান এবং তার সাথে সম্পর্কিত প্রাণী ও গাছপালার অস্তিত্ব হুমকীর মুখে। ভূগর্ভস্থ পানির অভাবে অনেক ঝর্না শুকিয়ে গেছে, অনেক আদ্র অঞ্চল শুকনো হয়ে গেছে। শত বছরেও এ অবস্থার অবসান হবে কিনা সন্দেহ আছে। ১০০০ বছরেরও পুরোনো ১০ হাজার একরের হামাবাখ বনভূমি ২০২০ সাল নাগাদ পুরোপুরি ধবংস হয়ে যাবে। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিরেক্টিভ 92/ 43/EEC অনুসারে Maas-Schwalm-Nette জলাভূমি এবং হামবাখ বনভূমি উভয়ই হলো সংরক্ষিত অঞ্চল।


জার্মানির উন্মুক্ত খনির পরিত্যক্ত খাতকে কৃত্রিম লেক এ পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় পানির ৮৫% ই সংগ্রহ করা হয় হয় ¯স্প্রি নদী থেকে পানি টেনে নিয়ে। পশ্চিম বার্লিন উপকুলের হাভেল নদীর সাথে মেশার আগ পর্যন্ত স্প্রি নদী ৩৮২ কিমি পথ অতিক্রম করে। পরিত্যাক্ত খনির দিকে ক্রমাগত পানি টেনে নেয়ার প্রতিক্রিয়ায় ২০০৩ সালের গ্রীষ্মে দেখা গেল সেই ¯স্প্রি নদী উল্টো পথে লিগনাইট উন্মুক্ত খনির দিকে যাত্রা করে বসেছে!

এই স্প্রি নদীর হাইড্রোলজিক্যাল ভারসাম্য পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য আগামী দশ বছরে ব্র্যান্ডেনবার্গ রাজ্যকে ৩০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হবে। নদীর গতিবেগ বৃদ্ধি করার জন্য কৃত্রিমভাবে নদী পথও পরিবর্তন করতে হবে। বর্তমানে নদীর গতি এরকম শ্লথ যে বাষ্পীভবনের ফলে যে পরিমাণ পানি নদী থেকে উড়ে যায় বৃষ্টিপাত এবং শাখা-উপনদীর মাধ্যমে তা আর পূরণ হতে পারে না।

প্রাক্তন লুসাটিয়ান খনি এলাকার পানির অম্লত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। উন্মুক্ত কয়লা খনি থেকে উত্তোলিত আয়রন পাইরাইটসই এর জন্য দায়ী। এই অধিক অম্লত্বের পানিতে মাছ কিংবা জলজ উদ্ভিদ কোনটিই ভালো হয় না। এমনকি এই মরা পানি অঞ্চলে পর্যটন শিল্পও গড়ে তোলা যায় নি। শুধু তাই নয়, আবর্জনা ও কয়লা খনির অবশেষ ফেলে খনি এলাকা পুনারায় ভরাট করে সেখানে চাষাবাদ বা বসতি নির্মাণের চেষ্টাও সফল হয় নি, যে কারণে ইদানিং পরিত্যাক্ত উন্মুক্ত খনি এলাকায় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছে।


হর্নো গ্রামের কথা

১৯৯৩ সালে পোলিশ সীমান্তের নিকটবর্তী হর্নো গ্রামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং সেখানে বসবাসকারী সোর্ব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য গ্রামটিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়। ব্রান্ডের বার্গ রাজ্যের সংবিধান সোর্ব সংলঘু জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সেগ্রামের বসতি এলাকা সংরক্ষণের প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিল । হর্ন গ্রাম এবং সে গ্রামে বসবাসকারী ৩৮০ সোর্ব জনগণের দুর্ভাগ্য গ্রামটি ভ্যাটেনফল উন্মুক্ত খনির খনন পথে পড়ে গিয়েছিল। ফলে ১৯৯৭ সালে ব্র্যান্ডেনবার্গ স্টেট এসেম্বলির পাশ করা ”ব্রাউন কোল এক্ট”-এর মাধ্যমে জশভালদ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দ্রুত জ্বালানী সর্বরাহের মাধ্যমে পুরো অঞ্চলের বিদ্যুৎ সর্বরাহের স্বার্থে হর্নো গ্রামটিকে ধবংস হতে হয়, উচ্ছেদ হতে হয় সেখানকার আদিবাসী অধিবাসীদের।

আর এ কাজটি সফল করার জন্য গুজব ছড়িয়ে এমন একটি অবস্থা তৈরী করা হয় যেন হর্নো গ্রামটিকে ধবংস না করলে ৩০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান রক্ষা হবে না। এটা ছিল ১৯৯৩ সালের কথা। এক বছর পর বেসরকারীকরণ সম্পন্ন হওয়ার পর বলা হতে লাগলো ”হর্নো গ্রাম অথবা ১২ হাজার চাকুরি” আর ১৯৯৭ সালে যখন ব্রাউন কোল এক্ট পাশ করা হচ্ছে তখন বলা হচ্ছিল ”হর্নো গ্রাম অথবা ৪ হাজার চাকুরি”! হর্নো গ্রামের বিনিময়ে ৪ হাজার চাকুরির কথা বলা হচ্ছিল অথচ ৯০ এর দশকে শুধু মাত্র খরচ যৌক্তিকরণের নামে এ এলাকার ল্যসিজ কয়লা খনির ৯০ শতাংশ শ্রমিক ছাটাই করা হয়েছিল। ৫৭ হাজার কর্মসংস্থানের মধ্যে ২০০৫/৬ সাল নাগাদ অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২,২০০-২,৪০০ কর্মসংস্থান!

এই হর্নো গ্রাম থেকে শুরু করে অপেক্ষাকৃত কম ঘনবসতিপূর্ণ গোটা জার্মান দেশে উন্মুক্ত কয়লা খনির আখ্যান যে ভয়াবহ চিত্র হাজির করে, সেই চিত্র দেখে, জেনে-শুনে ফুলবাড়ি কিংবা বড় পুকুরিয়া কিংবা বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলে উন্মুক্ত খনি স্থাপনের জন্য স্রেফ খায়েশ পোষণ করাটাই মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসানের মা হিজাব করেন নি। এই বেপর্দা নারীকে গাড়ি গিফট করার চেয়ে হিজাব গিফট করা উত্তম।

লিখেছেন লেখার খাতা, ১১ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩


ছবি - সংগৃহীত।


ইফতেখার রাফসান। যিনি রাফসান দ্যা ছোট ভাই নামে পরিচিত। বয়স ২৬ বছর মাত্র। এই ২৬ বছর বয়সী যুবক মা-বাবাকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনে দিয়েছে। আমরা যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ এঁটেল মাটি

লিখেছেন রানার ব্লগ, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১:৫৬




শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম, মাত্র একটা টিউশানি শেষ করে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম । ছাত্র পড়ানো বিশাল এক খাটুনির কাজ । এখন বুঝতে পারি প্রোফেসরদের এতো তাড়াতাড়ি বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসুন সমবায়ের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করি : প্রধানমন্ত্রী

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১২ ই মে, ২০২৪ ভোর ৪:১০



বিগত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিজ সংসদীয় এলাকায় সর্বসাধারনের মাঝে বক্তব্য প্রদান কালে উক্ত আহব্বান করেন ।
আমি নিজেও বিশ্বাস করি এই ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক ।
তিনি প্রত্যন্ত অন্চলের দাড়িয়ারকুল গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×