somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি আরবি গল্পের বাংলা অনুবাদ

১২ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৭:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্পের নাম: ছোট ছোট ঈশ্বরেরা
মূল:ঢান্নাউন আইউব(১৯০৮-১৯৮৮)
বাংলা অনুবাদ: সুমন সোহরাব

লেখক পরিচিতি : ইরাকের ছোট গল্প ও উপন্যাসের পথ প্রদর্শক ঢান্নউন আইউব মসুলে জন্মগ্রহন করেন। বাগদাদের শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করেন। শিক্ষাদানের পাশাপাশি সারা জীবন তাকে, বিশেষকরে সংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু উচ্চতর পদে দায়িত্ব পালন করতে হয়। একপর্যায়ে তিনি বাগদাদের শিল্পকলা ইনস্টিটিউট এর পরিচালক নিযুক্ত হন। কিভাবে এক জন সম্মানিত ব্যক্তিকে সরকারের দমন পীড়ন ও ভ্রান্ত নীতির কারনে যতনা ভোগ করতে হয় তাঁর জীবনের গল্পে এই বিষয়টি খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। অনেক ঘটনা প্রবাহের মধ্যদিয়ে এক পর্যায়ে তাকে কোর্ট মার্শাল এর মুখোমুখি হতে হয়। এরই সূত্র ধরে তিনি ১৯৫৪এরদিকে ভিয়েনায় দেশান্তরি হন। এ সময় ইরাক এক জন রাজার অধীনে শাসিত হচ্ছিল। তারপর ১৯৫৮ এর বিপ্লবের সময় দেশে ফিরলেও খুব অল্প সময় তিনি স্বদেশে অবস্থান করেন। এরপর আবার ১৯৬১তে তিনি দেশ ছাড়েন। আইউব তার সাহিত্য জীবনের কিছুটা সময় ইংরেজি ও রুশ সাহিত্য অনুবাদ করে কাটান। প্রায় ছয় বছরের বেশী সময় সম্পাদনার পর তাঁর ছোট গল্প আল-মাজাল্লা মসুল রিভিউতে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি সহ তার অন্যান্য গল্পগুলো এগারো খন্ডে প্রকাশিত হয়, সংকলনটিতে ভিয়েনার গল্প(১৯৫৭) অর্š—ভুক্ত ছিল। তাঁর ছোট গল্পের মতো ড.ইব্রাহিম(১৯৩৯) এবংদ্যা হ্যান্ড, দ্যা ল্যান্ড এবং দ্যা ওয়াটার(১৯৪৮) উপন্যাস গুলো ইরাকের প্রতিদিনের সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি, এগুলোর মধ্যদিয়ে তিনি ব্যঙ্গাত্মকভাবে, নিজস্ব ধাঁচে, সম্পূর্ন নতুন আঙ্গিকে জীবনের অনেক করুন বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। জীবনের বাকিটা সময় তিনি দেশান্তরি হয়ে ভিয়েনাতেই কাটিয়েদেন এবং সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ছোট ছোট ঈশ্বরেরা

আদিগন্ত আকাশের সিমানা জুড়ে বিস্তৃত গম ক্ষেত গুলো সকালের বাতাসে একটানা র্ম র্ম শব্দ করছে। মাঝে মধ্যে গমের কঁচি শীষ গুলো নমনীয় ডাটা সহ নুয়ে পরে সবুজের সেই সমুদ্রে ছোট ছোট মৃদু মন্দ ঢেউ তুলছে। আকাশে ছিটে ফোঁটা মেঘের চিহ্ন মাত্র নেই। এর মাঝে সুর্যটা নীল সাগরের মত বিশাল আর মৃতের মত নিশ্চুপ আকাশটাকে আলোকিত করে রেখেছে। উপরদিক থেকে আসা এই আকাশ আবার দিগন্তের সিমানায় এসে সবুজের সেই সাগরের সাথে মিশেগেছে। দিগন্তের এই জায়গাটিতে সুর্যের আলোর সাথে আকাশ আর গমখেতের রঙের মিশ্রনে অপরূপ এক আবহের জন্ম হয়েছে।
সবুজের সেই আদিগন্ত সাগরের মাঝ থেকে শুরু করে ধুসর রঙের একটি গ্রাম বেলাভূমি পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, গ্রামের বসত বাড়ি গুলো এলো মেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক সেদিক থেকে গড়ে উঠেছে, এর কয়েকটা এত ছোট যে প্রায় শেয়ালের গর্তের মতো, বাকি গুলোর আকৃতি আরো বড় কোন পশু থাকার ঝুপড়ি আকারের, এগুলো আজব সেই সমুদ্র তিরে ফোস্কার ন্যয় ফুটে আছে। মার্চের তপ্ত রোদের আলোয় গম খেতের সবুজ ঝক ঝক করছে, ঠিক যেনো তৃণের প্রতিটি তলজুড়ে রোদের আলো ঠিকরে সেধিয়ে যেতে চাইছে, সকালের এই রোদ যেনো চারদিক থেকে জীবনকে আকন্ঠ ছুয়ে থাকতে চায়-কেবল এর পেছনের জানালা হীন কাদার দেয়ালে গড়া সেই বাড়ি গুলো ছাড়া।
এমনি কোন ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বসন্তের বাতাস গমক্ষেতে হানা দেওয়ার আগেই এমন মিষ্টি একটি দিনে, হঠাৎ যেন আকাশটা কেমন নিচে নেমে এসেছে, বাতাস আর্তনাদ করতে শুরু করেছে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি পড়ছে। দেখতে দেখতে বৃষ্টির জল সমস্ত গমের খেতগুলো এমনভাবে ভাসিয়ে দিয়ে গেলো যেন বাকি সপ্তাহ দুএক বা তারো বেশী সময়ের জন্য কৃষকদের অলস বসে থাকতে হয়, প্রতি দিন যথা সময়ে সূর্য উঠলেও গ্রামটা যেন অনভ্যস্তের মত অসময়ে ঘুমিয়ে পড়লো। জীবন্ত কোন কিছু চোখে পরে না, কেবল আকাশের অজানা কোন থেকে মিষ্টি স্বরে একটানা ডেকে যাচ্ছে কয়েকটা ভরতপাখি, যেন দেব দূতের ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ, আর আবাবিলের দল নতুন বাড়ি তৈরীর উপাদান যোগার করতে কিঁচির-মিঁচির শব্দে ডুবো মাটিতে কাদার সন্ধানে ঝাপিয়ে পড়ছে।
গ্রাম থেকে মাইলখানেক দূরে বিশাল এক প্রসাদ মাটি ফুড়ে শক্ত ভীতের উপর দাড়িয়ে আছে। হাজার তিনেক বছর আগে ব্যাবিলনের কৃষকেরা নিজেদের জন্য বাড়ি তৈরী করে জায়গাটি কানায় কানায় ভরে ফেলে ছিলো। এদেরই এক জন কৃষক বুঝি জীবন ফিরে পেয়ে, এই সুবিশাল নতুন দালানটি ঈশ্বরের উদেশ্যে উৎসর্গ করেছে, বছরের প্রতিটি দিন যার ভেতর শস্য দানা আর খাবার দাবার ঢেলে দেয়া হয়!
অবস্থা সম্পন্ন এই প্রাসাদটি ছিলো শেখের বসতবাড়ি, পুরো জেলা সহ এমন আরো কত গুলোর মালিক ছিলো সে, তার মালিকানায় যেটুকুন ভূমি ছিলো তার পুরোটার আয়তন বেলজিয়ামের চাইতে বড় হবে। তার এই জায়গাটিতে যে সব কৃষক আর শ্রমিক কাজ করতো, আর যে সব গাছগাছালি, পশুপাখি, মানুষজন, আকাশের সূর্য এবং বৃষ্টি আর বাতাস যা কিছুই তার সাজোয়া বাহিনির কাজে আসবার মত ছিলো সবার উপরই শেখ কতৃত্ব করতে চেষ্টা করতো। এত সবের মালিক হওয়ার কারনে সবদিক দিয়েই তিনি ছিলেন যথেষ্ঠ ক্ষমতাবান, মারডাক এবং এনলিল আর এন্টোনাবাসথেম সহ কল্পিত আরো সব দেবদেবীর মতো মহিমান্বিত, উপাসকেরা কেবল এসব দেবদেবীর মূর্তীর মাঝে তাদের সেই ঈশ্বরদের খুজে পেতো, অন্যদিকে তাদের মাঝে শেখ একজন জীবন্ত ঈশ্বরের মতই ছিলো যে কিনা তাদের আদেশ উপদেশ দিতেন, তাদের জীবন দান করতেন আর বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষন করতেন, সুখ অথবা দুঃখ দিতেনÑ এবং মানুষ জন্ম নিয়তির বিড়ম্বনায় পড়ে যে সব ঝড়ঝাপ্টার মুখোমুখি হয় এর সব কিছুই ছিলো তার নিয়ন্ত্রনে।
শেখ মামঘাম বিশাল এক উপজাতি শসন করতেন, তার বাবা শেখ বুদাইর এদের মাঝে সব সময় এক ধরনের আতঙ্ক জাগিয়ে রাখতেন। সে সময় জল সেচের ব্যবস্থা ছিলোনা, তার বাবা উপজাতির লোক জন সহ থাকতো টিথেস ও বুটি অঞ্চলে, তখন দল বল নিয়ে সে লুটের মাধ্যমে জিবিকা নির্বাহ করতো। প্রতিবেশীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে তাদের এ অর্থ সংগ্রহের কাজ চলতো। তখন টিথেসদের মধ্যে এক জন কৃষক থাকার কথাও শোনা যায় না।
বুদাইর এতসব নতুন উন্নয়ন ঘটা পর্যন্ত বেঁচে থাকেননি। অন্তত বড় ছেলে মাটার মাধ্যমে তিনি সফল হয়ে ছিলেন, প্রচন্ড বদরাগী ভয়ানক এ শাসকের নাম বিপ্লব ও এর ফলে পাওয়া স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত দিকে দিকে উচ্চারিত হতো। এমনকি নতুন রাজ্য দিওয়ানও তার প্রচন্ড শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি টের পেতো আর ভয়ে নতজানু হয়ে তার কাছে পরাজয় স্বীকার করতো, একারনে তার শক্তি বাড়তেই লাগলো। সে তার সেচ্ছাচারীতার মারপ্যাচ নিজ জাতির লোকদের মধ্যেও দেখাতে লাগলো, এমনকি নিজ রক্তের সম্পর্কের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও, নিজের ভাইদের সে লোহার একটি দন্ড হাতে নিয়ে শাসাতো, নিজ অনুসারিদের প্রতি তার আচরন ছিলো ক্ষমাহীন, মামুলি বিষয়ে বিরোধীতায় যে কাউকে কারা বরন অথবা হত্যার স্বীকার হতে হতো। তার ভাইয়েরা নিজেদের কাজে কর্মে কোন ত্র“টি খুজে না পেলেও অকারনেই তাদের যাতনা ভোগ করতে হতো; উপজাতিয় রীতিনীতি এবং দেশের প্রচলিত আইন তাদের শোচনীয়ভাবে বশ্যতা মেনে নিতে ও সব নিষ্ঠুরতা মুখবুজে সহ্য করতে বাধ্য করে। তাছাড়া সবার বয়স সে সময় এতটাই কম ছিলো যে বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে করার কিছুই ছিলোনা তাদের। কেবল মমঘামই ছিলো এর সব কিছুর উর্দ্ধে। বড় ভাইয়ের সব গুনই কম বেশী তার মধ্যে ছিলো, সে ছিলো তার অন্যতম বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা। মাটা নিজের ছেলেদের সহ অন্যান্য ছোট ভাইদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে কাছের শহরে পাঠাবার বুদ্ধিও তার কাছ থেকেই পায়, অত্যন্ত দূর দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়ার কারনে সে বুঝতে পেরেছিলো এর মধ্যদিয়ে তাদের খানদানের মর্যাদা ধরে রাখা সহজ হবে, সাথে পারিবারিক মানসম্মানও বাড়বে।
মাটার মারা যাবার পর তার যোগ্য উত্তসূরী হিসেবে অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে যান মমঘাম, একইসঙ্গে ভাইয়ের মত প্রচন্ড ক্ষমতা ধরে রাখতে ভয়ানক ক্রুরতার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন। তার অসহ্য নির্যাতন ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বিপর্যস্ত কৃষকেরা তার পাশবিকতা নিয়ে গান বাধে। “মমঘম ঈশ্বরের কাছে প্রনত হয়”, তারা গাইতে থাকে, “তার পর সে ঈশ্বরকে তুলে ধরে, এটাই সত্য, আর নিজ কাঁধে করে বয়ে বেড়াতে থাকে!” শহুরে জীবনে অভ্যস্থ তার ভাই ও ভাতিজাদের অনেকে এরই মধ্যে দূর্নীতির জড়ায় আক্রান্ত হয়ে বখে যায়, বাকিরা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে থাকে। জ্ঞানের আলোয় পারিতিপ্তেরা অল্পতেই সুখি, তাই মমঘামের টেবিল থেকে উচ্ছিষ্ঠের ছড়ানো ছিটানো অংশ যা কিছু তাদের ভাগ্যে জুটতো তাতেই তারা অনেক বেশী সন্তষ্ঠ ছিলো। কিন্তু বখে যাওয়া দলটি আকন্ঠ ওয়াইন পান করা, জুয়া খেলা আর মেয়ে লোকের পেছনে ছুটতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, এই সব অমিতব্যয়ীদের কাছে তাদের পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তি মাত্র বছর খানেকের হাত খরচের চেয়ে বেশী কিছু ছিলোনা। মরহুম শেখের বড় ছেলে আজিজ ছিলো তার বাবার মতই চড়ম চশমখোড়, নিষ্ঠুর আর বখিল। সে বখে যাওয়া দলটির নেতৃত্বদিয়ে আসছিলো। কিন্তু মমঘামের হাতে ক্ষমতা চলে আসার পর সে আজিজের সৃষ্টিছাড়া সব আচরন নিয়ন্ত্রনে আনতে তাকে এক প্রকার চাপের মধ্যে রাখেন। এখান থেকেই তাদের মাঝে মুখ কালাকালির শুরু, একদিকে চাচা তার মৃত ভাইয়ের মতো নিষ্ঠুর আর মহান ক্ষমতার অধীকারি হবার আশা মনে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর অন্যদিকে ভাতিজা নিজেকে তার বাবার রেখে যাওয়া রাজদন্ডের আইন সম্মত উত্তরাধীকারি ও তার নামের ধারক বাহক ভাবতে শুরু করে। মমঘাম নিজে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম এ কথা জানিয়ে দেবার পর অবস্থা আরো বেগতিক হতে শুরু করে, নিজ দেশের লোকের কাছে লজ্জায় পড়ার জন্য বিষয়টি উছিলা হয়ে দাড়ায়। কেবল একটিমাত্র সন্তান জন্মদানের অক্ষমতা তাকে আরো বেশী হিংস্র ও স্বেচ্ছাচারী করে তুলে।
এখন আলোকোজ্জল সেই দিনের মাত্র ঘন্টাখানেক পর হতে আবার আমরা গল্পে প্রবেশ করবো, প্রসাদের সদর দড়জার বাইরে দিয়ে এ সময় আলখাল্লা পরা দুজন মুখোশধারী ঘোড়া সাওয়ার দ্রুতবেগে খামারের দিকে যাচ্ছিলো। গ্রামের কৃষকেরা তাদের ফসলের ভাগ যেখানে জমিদারের হাতে সপে দেয় সে জায়গাটি তারা খুব দ্রুত পেরিয়ে গেলো। গবাদি পশুর যাতায়াতের চিহ্ন ধরে তারা মাঠের মাঝামাঝি জায়গায় এসে হাজির হয়, পাসে বৃষ্টির জলে ভরা একটি গর্ত, বড় ধরনের একটি নৌকা আটবে এতে, এমন টলটলে জলে তারা কোন আগ্রহ দেখালো না, ঘোড়া গুলো ক্ষিপ্রতার কারনে তখনো সেদিকে লক্ষ্য করেনি হয়তো, পথের দুপাসে রসালো গাছও এর কারন হতে পারে। তবে এব্যপারে কোন সন্দেহ নেই মনিবদের মতো আকন্ঠ ভোজন করেই তারা কাজে নেমেছে!
আজিজ, এই ঘোড়া সাওয়ারের এক জন, সঙ্গীর দিকে সে ঘুরে দাড়ালো, “এই জমির জন্য তুমি কত খাজনা আদায় করো, খালাফ?”সে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার মনে রাখা দরকার, অনেক দিন হলো তুমি আমাদের প্রতিনিধি হয়ে এই দায়িত্ব পালন করছো, যথেষ্ট হয়েছে।”
“গেলো বছর” উত্তরে খালাফ বোললো, “শুধু এই গ্রামের জন্য বিশহাজার দিনার দিয়েছি, গ্রীষ্ম এবং শীত এক সঙ্গে। এই হিসেবে আপনার দশটি গ্রাম থেকে পুরো দু’লাখ রিয়াল আসবে।” আজিজ এ কথা শুনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে উঠলো।
“আর তুমি জানো,” সে প্রশ্ন করার ভঙ্গীতে বোললো, অভিশপ্ত দানবটা বছরে আমাকে কতদেয়? মাত্র দু হাজার দিনার, ব্যস! লোকটা যদি আমার রূহকে ভয় না করতো, তাহলে হয়তো এক হাজার দিনার দিয়েই বসিয়ে রাখতো, তার কাপুরুষ ভাই আর ভাতিজা গুলোকে তাই দিচ্ছে সে, ওগুলোর শুধুপেট ভরাতে পালেই হলো, আর কিচ্ছু চাই না। আমার নিজের দু’লাখ থেকে দিচ্ছে মাত্র দু’হাজার। খোদার কসম আমি ব্যটার ঘাড় মটকাবো!”
“কিন্তু ওর ক্ষমতার জোর আছে,” হালকা হাঁসি হেঁসে খালাফ বোললো, “সারা তল্লাটের লোক ওর কথায় উঠে বসে আর চামচারও অভাব নেই।”
সামান্য অভিভুত না হয়ে, আজিজ হেঁসে উঠলো।
“এর সব কিছু আমার হবে,” সঙ্গে সঙ্গে যথোপযুক্ত জবাবে সে বোললো, “ও মরে কবরে যাবার পর। আমি আর অযথা শহরে বসে সময় নষ্ট করবো না। সোজা মাথাও একশ’ দিনারের নোট মেলে ধরলে আমার কাছে এসে গুটিশুটি মেরে যাবে। আমার অভিশপ্ত চাচার টুটি চেপে ধরবে!”
খানিকটা ভেবে চিন্তে এর পর সে বলে, “দেখ খালাফ । পাষন্ডটা আমাকে অনেক ঠকিয়েছে। এভাবে আর চলতে পারে না। প্রায়ই আমি তোমাকে লোকটার একটা গতি করতে বলেছি, কিন্তু সব সময় তুমি তোমার সিদ্ধান্ত বদলেছো। ধরে নাও আমার আগেকার প্রস্তাব এখনো বজায় আছে। অংশ হিসেবে তুমি সামনের গ্রামটা পাবে- বিয়েথা করবে, এর জন্যে ওর বোন শানোউনা রয়েছে। ব্যটা মরার পর আত্বীয় স্বজন সবার হার জুড়াবে,মুক্তির স্বাদ পাবে। শানোউনা তার অধীকার ফিরে পাবে, তাকে বিয়ে করে তুমিও প্রতিষ্ঠা পাবে।”
“আজিজ” প্রতিনিধি জবাবে বোললো, “আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছি, আর এখন সেই সময়। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কের রেশধরে তার মনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে এবং এরই মধ্যে সে আমাকে বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। বোকাটা জানেনা এই হুমকি ওর নিজের মৃত্যু পরোয়ানা!”
“তুমি বলছো, তাহলে এটাটই আঘাত করার উপযুক্ত সময়? এব্যপারে তোমার পরিকল্পনা কি?”
“তামার কি মনে আছে কৃষক আম্মোউরি আর তোমার চাচার ঝগরার কথা? তোমার চাচা ওকে লাঠি পেটা করেছিলো, এতে ওর পাজরের দুদুটি হার ভেঙ্গে গিয়েছিলো, কৃষকের ছেলে সমস্ত গ্রামবাসীর সামনে এর প্রতিশোধ নেবার কথা ঘোষনা করেছিলো। আমি তোমার চাচাকে সাবধানে থাকার কথাবলে সতর্ক করে দিয়েছিলাম, তার নিরাপত্তা নিয়ে আমি চিন্তিত বলে কিন্তু কাজটি করিনি, করেছি কৃষকের হুমকির ওপর তার নজর ধরে রাখতে। তোমার চাচাতো আমার মুখে প্রায় থুতু মারতে বসেছিলো। এসব মশা মাছিতে তার কোন ভয় নেই, জবাবে সে বলেছে। আজ রাতে সে শহরে আমন্ত্রিত- পৌরমেয়র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হবে, সেখানে সেও থাকছে। আর যেহেতু তোমার চাচার ড্রাইভার অসুস্থ, তাই সে নিজেই গড়ি চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাত্র বিশ মাইল পথ, খুব বেশীতো নয়। পথের দু’ধার ঘন নলখাগড়ার ঝোপে ছাওয়া, লুকিয়ে শিকারের জন্য অপেক্ষা করার অপূর্ব জায়গা। গোপনে আমি দু’টি বার বার গুলি ছোড়া যায় এমন রাইফেল সঙ্গে এনেছি। আমরা গাড়িটাকেও পুড়িয়ে ওর সঙ্গে নরকে পাঠিয়ে দিব!”
“চমৎকার!” আজিজ বোললো, “একদম নিখুঁত হিসাব! যদিও আমাদের এত বেশী সতর্ক হবার কোন দরকার ছিলো না। কোন শালা আমাদের এর জন্য দায়ি করতে যাবে, আর কেইবা ওর হয়ে প্রতিশোধ নিতে আসবে? ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ ওর কোন সন্তান নেই। এ ঘটানার মাধ্যদিয়ে শহুরে ভেরার পালের মতো তার আত্ময়ীদের বাৎসরিক আয় দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছি আমি।”
জবাবে খালাফ বোললো “এর জন্যও সতর্ক থাকত হবে, বিপদ এখানেই, লোক জনকে ভাবতে দিতে হবে ‘আম্মোউরির ছেলে তাকে খুন করেছে? তার বাবা ছাড়া আর কাউকেই পাওয়া যাবেনা যে বলবে এ সময় তার ছেলে বাড়ি ছিলো। আমাদের কথাতো কারো মাথাতেই আসবে না, আমরা এখন শহরে যাচ্ছি, একারনে আমরা সন্দেহের বাইরে থাকবো- যদিও আমরাই আবার বদমাশটাকে লুকিয়ে চুকিয়ে মারার একটা ফন্দি বের করেছি আর জংলি বাঘটাকে যেভাবে হোক আজকে মারবোই!”
অমাবস্যর অন্ধকার রাত, এমন একটা সুন্দর দিনের পর ঘুঁটঘুটে অন্ধকার এই রাত যান্তব এক অপরাধ দৃশ্যের সাক্ষি হয়ে রইলো- যদিও ইরাকের গ্রাম গুলোতে এধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভাতিজা তার চাচাকে হত্যা করেছে। প্রায়ই সেখানে মায়ের পেটের ভাই ভাইকে খুন করছে, অথবা ছেলে বাবাকে, এমন ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়- আর এটা খুবই সাধারন আইনের হাত গলে কেবল দূর্বলেরাই বেরিয়ে যেতে পারেনা। কিন্তু ক্ষমতাবানেরা কাবিল হয়ে হাবিলকে ক্ষুদে ঈশ্বরের মতই অহরহ খুন করে পারপেয়ে যাচ্ছে। প্রাচিন উপকথা গুলোতেও দেবতাদের একে অন্যকে বাছবিচারহীন হত্যা করতে দেখা যায়।
সেই সব ঈশ্বরেরতো কোন কিছুরই অভাব নেই; তবে কেন তারা আজো রক্তের জন্য তৃষ্ণার্ত?

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৮:০৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর মধ্যে সে একজন ।।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ১৩ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯



আপনারা কতজন Umma Kulsum Popi চেনেন, আমি ঠিক জানি না। আমার পর্যবেক্ষণ মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের একজন হলেন উনি। যদি বলি দেশের সেরা পাঁচজন কনটেন্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিস অস্বীকার করে রাসূলের (সা.) আনুগত্য সম্ভব

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৩ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সূরাঃ ৪ নিসা, ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আর আনুগত্য কর রাসুলের, আর যারা তোমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×