somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোজি: প্রাচীন চিনের শান্তিবাদী একজন দার্শনিক

১১ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ১০:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মোজি। প্রাচীন চিনের শান্তিবাদী দার্শনিক। সে কালের যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে মানবসৃষ্ট কোনও দর্শন এতটা মানবিক হতে পারে তা মোজিবাদ সর্ম্পকে না-জানলে বিশ্বাস করা কঠিন। মহাত্মা মোজি যুদ্ধপীড়িত যুগে শান্তির বার্তা নিয়ে চিনের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। একবার শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে দশ দিন দশ রাত একটানা হেঁটেছেন, পায়ের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বাঁধলেও বিশ্রাম নেননি ... যখন আগ্রাসী শক্তিকে বোঝাতে ব্যর্থ হলে তখন আক্রান্ত নগরের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে ছুটলেন ...



চিনের মানচিত্র। আজকাল চিন যেমন বিভিন্ন পণ্য উৎপন্ন করে বিশ্বজুড়ে ভোক্তার চাহিদা মেটাচ্ছে - তেমনি প্রাচীনকাল থেকেই নানান দার্শনিক মতের সূতিকাগার হিসেবে চিন বিশ্বজুড়ে কৌতূহলী মনের পিপাসা মিটিয়ে আসছে। আজকাল যেমন চাইনিজ ইলেকট্রনিক্স পণ্য বাদে আধুনিক জীবন কল্পনা করা যায় না -তেমনি অন্তত মরমীবাদের ক্ষেত্রে প্রাচীন চিনের দার্শনিক লাওৎ-সে প্রবতির্ত তাওবাদ এর ভূমিকা সেরকমই ...

চিনের শাংডন প্রদেশের তেংঝাও এ মেজি জন্মেছিলেন। মোজি-র সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮০ থেকে ৩৯০। মোজি শব্দের অর্থ -শিক্ষক মো। অবশ্য মোজির প্রকৃত নাম ছিল ডি (তি)।


মানচিত্রে চিনের শাংডন প্রদেশ



শাংডন প্রদেশ এর পাহাড়

মোজির সময়কালে চিনে কফুসিয়াস মতবাদ ছিল প্রবল। প্রত্যেককেই কফুসিয়াস দর্শনের পাঠ গ্রহন করতে হত। প্রথম জীবনে মোজি ছিলেন কনফুসিয়াসের এক শিষ্যের শিষ্য। পরে তাদের সর্ম্পকে ভাঙন ধরে। এরপর নিজস্ব দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠা করেন মোজি । গভীর ব্যক্তিমায়া (কারিশমা) ছিল মোজির, বিস্তর শিষ্য জুটেছিল। মোজির মতবাদকে বলা হয় মোজিবাদ। প্রাচীন চিনের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অধ্যায়কে বলা হয়- ‘হানড্রেড স্কুল অভ ফিলসফি’। ঐ সময়কালে কনফুসিয়াসের মতবাদ ও লাওৎ-সে প্রবর্তিত তাওবাদের প্রতি তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল মোজিবাদ।



প্রাচীন চিন।

কিন্তু, মোজি কি বিশ্বাস করতেন?
মোজি বিশ্বাস করতেন যে মানবজীবনের এক সক্রিয় শক্তি হল স্বর্গ বা হেভেন। এই স্বর্গীয় প্রনোদনার কারণেই অশুভ মনোভাব লালন করলে শাস্তি পেতেই হবে। এ কারণেই মানুষের উচিত সর্বজনীন মঙ্গল কামনায় স্বর্গীয় পথ অনুসরণ করা। মোজি বলেছেন: “সর্বজনীন প্রেমের পথকে অনুসরণ করলে অন্যের দেশকে নিজের দেশ বলে মনে হবে, অন্যের পরিবারকে নিজের পরিবার বলে মনে হবে আর অপরকে মনে হবে আমি। ... যখন সামন্ত প্রভূরা একে অন্যকে ভালোবাসতে শিখবে-তখন আর যুদ্ধ হবে না। যখন ব্যক্তিমানুষ একে অন্যকে ভালোবাসবে তখন আর কেউই হতাহত হবে না। যখন বিশ্বের সব মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসবে তখন আর দূর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার হবে না। সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের শোষন থাকবে না ...ধনীরা গরীবকে উপহাস করবে না। চতুরেরা সহজ-সরল লোকদের ঠকাবে না। ”



প্রাচীন চিনের জনমানসে কনফুসিয়াস, লাওৎ-সে ও মোজির মতবাদ ছিল গভীর ভাবে প্রোথিত...

মোজিবাদের অন্যতম নীতি হল শ্রেয়োনীতি বা উপযোগীতাবাদ। মোজিবাদীরা অনেক ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধীতা করে। যেমন, যে সমস্ত উদ্যেগ জনগনের কল্যাণে আসে না সেরকম উদ্যেগের প্রবল বিরোধীতা করে। মোজিবাদীরা কয়েকটি ক্ষেত্রে কনফুসিয়াসের দর্শনের বিরোধীতা করে। কনফুসিয়াসপন্থীরা সংগীত ও সামাজিক অনুষ্ঠানের গুরুত্ব আরোপ করে। মোজিবাদীদের মতে এসব অর্থহীন। কনফুসিয় রীতি অনুযায়ী পিতামাতার মৃত্যুতে সন্তান শোক প্রকাশ করে। মোজিবাদীরা এরও বিরোধীতা করে। মোজিবাদীদের মতে এ হল সময়ের অপচয় মাত্র-এর চে জীবিত লোকদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ভালো। মোজির মতে কনফুসিয়াসপন্থীরা আসলে ‘গজদন্তমিনারবাসী’ যারা উচুঁপদের সরকারি চাকরি পেয়েই সন্তুষ্ট থাকে। মোজি মনে করতেন: চিন্তা ও কর্মের মধ্যে মিল থাকতে হবে। সমাজের নেতারা স্বর্গের ইচ্ছা অনুসরণ করবে। আর জনগন নেতাদের অনুসরণ করবে।


প্রাচীন চিনের যুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবিগুলি এ সময়েও বেশ আলোচিত ...

মোজির যুদ্ধবিষয়ক মত ছিল উল্লেখযোগ্য। আসলে মোজির সময়টা ছিল যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ এক সময় । চিনের ইতিহাসে এ সময়কে ‘ওয়ারিং স্টেটস পিরিয়ড’ বা ‘যুদ্ধরত রাজ্যসমূহের কাল’ বলা হয়। মোজি আত্মরক্ষাকে সমর্থন করলেও আগ্রাসী যুদ্ধকে স্বর্গবিরোধী নীতি আখ্যা দিয়ে চরম অমঙ্গল ও অপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন। এভাবে মোজিবাদীরা প্রতিরক্ষা কৌশলে দক্ষ হয়ে ওঠে এবং যে সমস্ত নগর সামরিক আগ্রাসনের সম্মূখীন তাদের সাহায্য করত। কথিত আছে, মোজি একবার শান্তি স্থাপনের উদ্দেশে দশ দিন দশ রাত একটানা হেঁটেছেন, পায়ের ক্ষতে ব্যান্ডেজ বাঁধলেও বিশ্রাম নেননি। যখন আগ্রাসী শক্তিকে বোঝাতে পারলেন না তখন আক্রান্ত নগরের প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে ছুটলেন। মোজি ও মোজিবাদীদের ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে এরকম অনেক লোককাহীনি চিনের সমাজে রয়েছে। আসলে মোজি ও তাঁর অনুসারীরা ছিলেন ভীষণ আদর্শবাদী ও উগ্র কল্যাণকামী। তারা কনফুসিয়াসপন্থী দের সমালোচনা করত রক্ষণশীল ঐতিহ্যে বিশ্বাসী বলে। কনফুসিয়াস সম্পর্ক ও দায়িত্বে র ক্ষেত্রে
স্তরবিন্যাস করেছিলেন। এটিও মোজির না-পছন্দ ছিল।
যা হোক। কালক্রমে চৈনিক সমাজ থেকে মোজিবাদ অবলুপ্ত হয়ে যায়। কনফুসিয়াস এর মতবাদ অধিক গ্রহনীয় হয়ে ওঠে।
মোজি ও তাঁর শিষ্যেরা মিলে ৭১ অধ্যায়ের একটি বই লিখেছিল । বইটির নাম: ‘মোজি’। এর মধ্যে অবশ্য ১৮টি অধ্যায় পাওয়া যায়নি। বইটিতে মোজির দর্শন স্থান পেয়েছে।



চিনের শাংডন প্রদেশের বর্তমান কালের ছবি। মনে থাকার কথা চিনের শাংডন প্রদেশের তেংঝাও এ মেজি জন্মেছিলেন। গণচিন মোজির শান্তিবাদী দর্শন ভুলে গেছে। এখন সে তাইওয়ান কে দখল করবে বলে প্রায়শ থ্রেট দেয় ... অথচ মোজি বলেছিলেন... সর্বজনীন প্রেমের পথকে অনুসরণ করলে অন্যের দেশকে নিজের দেশ মনে হবে, অন্যের পরিবারকে নিজের পরিবার মনে হবে আর অপরকে মনে হবে আমি। ...
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×