অনেকেই মাঝে মাঝে আমাদের, পশ্চিমবঙ্গ বাসীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন দিল্লির উপনিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। তারা অনেকে খোঁচা দিতে চান, কেউবা হয়ত সত্যই ভাবেন ব্যাপারটা বোধহয় সেরকমই। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও পরিচিতি সত্তা/ আইডেনটিটির বিষয়গুলি নিয়ে তাদের গভীর চর্চার সুযোগ হয়ত তেমন হয় নি বলেই তারা এমন বলেন।
আপনাদের অনুরোধ করব পরিচিতি ও হিংসা সংক্রান্ত বিষয়ে আরো চিন্তাভাবনা করার জন্য। অমর্ত্য সেন এর বইটাও দেখতে পারেন। মানেন কি যে আমাদের অনেকগুলো পরিচিতি থাকে ? ভাষা, সংস্কৃতি একটা পরিচিতি, খুব গুরূত্বপূর্ণ পরিচিতি। সেই পরিচিতি নিয়ে পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ কাছাকাছি আসে, আসতে চায়, বিনিময় করতে চায়।
আরো অনেক পরিচিতি আছে। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ মৌর্য সাম্রাজ্যের আমল থেকে ব্রিটিশ শাসনাধীন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আড়াই হাজার বছর ধরে এক শাসন ব্যবস্থায় থেকেছে। আলাদা আলাদা ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভাস ইত্যাদি নিয়েও। এই বিভিন্নতার মধ্যেও এর ঐক্যর আদল দীর্ঘ ইতিহাসে থেকেছে। ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে যে ঐক্যর এক বিশেষ চেহারা দেখা গিয়েছে। অবিভক্ত ভারতের মুসলিমদের একটা অংশের মনে হয়েছিল এই ঐক্যটা নেই, বা বানানো একটা ঐক্য এটা, যেটা ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা দরকার। একটি মাত্র পরিচয় সম্বল করে। একটি ধর্মগত পরিচয় পরিচয় সেটা। বেরিয়ে আসার পর পূর্ববঙ্গের লোকেরা দেখলেন ধর্মগত পরিচয়টিই একমাত্র থাকছে না, ভাষার পরিচয়টাও গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ফলে আবার একটি নতুন দেশের জন্য লড়াই আর আবার দেশভাগ। একবার ধর্মের পরিচিতি নিয়ে, একবার ভাষার পরিচিতি নিয়ে।
আমরা অন্যভাবে ভেবেছি। আমাদের কাছে পরিচিতিগুলি মূল্যবান। যে কোন মানুষের মতোই। কিন্তু বিভিন্ন আলাদা আলাদা পরিচিতি কোনও রাষ্ট্রে থাকতে পারবে না, এরকম আমরা ভাবি নি। কেউ কেউ যারা ভেবেছি, যেমন নাগা, মিজো বা পাঞ্জাবের কেউ কেউ, তারাও এখন সেভাবে ভাবেন না। ওন্তত বেশিরভাগ ভাবেন না। এখন কাশ্মীরের লোকেরা ভাবেন অনেকে। আজাদ কাশ্মীর চান। সেখানে ধর্মর প্রশ্ন আছে, আর আছে অন্যায় রাষ্ট্রীয় দমনের প্রশ্ন। খুবই অন্যায় রাষ্ট্রীয় দমনের প্রশ্ন। সে প্রেক্ষিত, কাশ্মীর প্রেক্ষিতে এখন যাচ্ছি না। কিন্তু তাছাড়া বিভিন্ন সত্তা যে একসঙ্গে থাকতে পারে, ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা তার একটি সফল উদাহরণ। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত। আমাদের ক্ষণে ক্ষণে মিলিটারি শাসনের দরকার হয় নি। আপনাদের তো পছন্দের ভিত্তিতে সত্তা অনুযায়ী গঠন করে নেওয়া দেশ। তাও গণতন্ত্র এত ভঙ্গুর কেন? মাঝেমাঝেই সেনাশাসন স্থাপিত হয় কেন ? পশ্চিমবঙ্গকে ঈর্ষাবশত দিল্লির উপনিবেশ হিসেবে গণ্য না করে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গর সত্তাগত পরিচয়গত দিকগুলি আরো গভীরভাবে ভেবে দেখুন।