মেজাজটা ভীষন খিচড়ে আছে তমার। অফিস থেকে এসে শুয়ে আছে চুপচাপ। এরমধ্যেই আম্মা দুইবার এসে বলে গেছে উঠে গোসল-খাওয়া সারতে। কিন্তু উঠতেই ইচ্ছা করছে না। এত অস্থির লাগছে, এত অসহায় লাগছে নিজেকে। কিছু ভাল লাগছে না। অনেক অনেকক্ষণ পরে বিদ্যুৎ চলে যেতে শোয়া থেকে ওঠে তমা। বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। এতদিন হয়ে গেল কাজটা করছে, এতকিছু দেখল তবু অন্যদের মত ওর অভ্যাস হয়ে যায় না, সয়ে যায় না। একটুতেই ভীষনরকম বিচলিত হয়ে যায়, কষ্ট পায়। মাথাটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। মাথা ধুয়ে যাওয়া পানির ধারাটা এত গরম! মাথা গরম হয়ে আছে। ভাল লাগছে না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুমে আসতে এগারটা বেজে গেল। আম্মা যে কতরকম খবর দিচ্ছে ঘুরে-ফিরে। সারাদিনে যা যা ঘটেছে সব তো শোনানো চাই। কিন্তু তমার ভাল লাগছে না। একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে, নিজের মত। তমা বুঝতে পারছে আম্মা কিছু বলতে চায়। এগুলো হচ্ছে ভণিতা। কথাটা কি তাও আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু এই কথাগুলো শুনতে ইচ্ছা করে না, ভাল লাগে না।
আম্মা একটু পরে এসে জাকিয়ে বসে বিছানায়। নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে, মেজাজ খারাপ ক্যান? অফিসে কোন ঝামেলা হইছে?’
‘না, ঝামেলা আর কি হবে? যা হয় সবসময়।’ একপাশে সরিয়ে রাখতে চায় তমা ব্যাপারটাকে, ‘তুমি কি কিছু বলবা নাকি?’
‘হ্যাঁ’, উশখুশ করে স্বীকার করে আম্মা।
‘বলতে চাইলে বলে ফেলো। এত ভূমিকা দেয়ার দরকার নাই।’
‘তোর আব্বা একটা ছেলের কথা বলতেছিল। তোর আব্বার কলিগের ভাইগ্না। ব্যাংকে চাকরি করে। বাড়ি আছে ঢাকায়।’
‘থামো আম্মা, এত হিস্টরি আমার জানার দরকার নাই।’
‘জানবি, শুনবি না সব কিছু? না জাইনা কি আগানো যায়?’
‘তুমি জানো আমি কেন মানা করছি। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না আম্মা। আমার পক্ষে সম্ভব না কোন পুরুষ মানুষের সাথে বাস করা।’
‘তাই বলে তুই একা তো থাকতে পারবি না সারাজীবন।’
‘কেন পারবো না আম্মা? কেন বিয়ে করতেই হবে? তুমি আমাকে জোর কইরো না প্রতিদিন এইভাবে। আব্বা নয় জানে না, তুমিতো সব জানো। তুমিতো বুঝো আমার কত ভয় হয়। আমি যে সহ্য করতে পারিনা। আমার অনেক কষ্ট হয়।’
বলতে বলতে আম্মার কোলে মুখ বুজে শুয়ে পড়ে তমা।
‘আমিতো বুঝিরে মা। কিন্তু কি করবো বল? সমাজ......’ আম্মা কথা শেষ করতে পারেনা। তমা ঝটকা মেরে উঠে বসে। ‘সমাজ! সমাজের কথা বলবা না আমাকে। কি করছিল তোমার সমাজ দুইটা থাপ্পড় মারা ছাড়া? কি করছিল যখন.....’ চিৎকার করতে করতেও থেমে যায় তমা। আম্মা ওকে থামানোর জন্য প্রাণপনে ইশারা করে যাচ্ছে। আব্বা সামনের রুমেই বসে আছে। তমা জানে ওকে থেমে যেতে হবে। বাইরে মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য, অন্যায়ের শাস্তির জন্য যে লড়াই করে যাচ্ছে সেই নিজের অন্যায়ের কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। মুখ বুজে থাকতে হচ্ছে পরিবারের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে। এটা যে কত কষ্ট, কত অসহনীয় একটা কষ্ট সেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব না। প্রিয়ন্তী থাকলে বুঝতো। একমাত্র প্রিয়ন্তীকেই বুঝানো যেতো। ভীষণ অভিমান হয় তমা। কেন চলে গলে প্রিয়ন্তী ওকে ছেড়ে? কিভাবে পারল? আম্মা তমাকে শান্ত করতে চায়। কিন্তু তমা সরে যায়, রূঢ়ভাবে চলে যেতে বলে আম্মাকে। বারবার মনে হয়, “আমার সাথেই কেন? এত অশান্তি, এত কষ্ট! আর কেউ ছিল না পৃথিবীতে? কেন? কেন?”
‘ম্যাডাম, মেয়েটাকে পাওয়া যাচ্ছে না গতকাল থেকে।’
‘কোন মেয়েটা?’
‘আয়েশা।’
‘সেকি! কোথায় যাবে? ওরতো যাওয়ার কোন জায়গা ছিল না। এক ওর শ্বশুড়বাড়ি ফিরে যায়া ছাড়া।’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তমা।
‘আমি জানি না ম্যাডাম। আমি সকালে এসে দেখছি নাই। হোস্টেলের কেউ বলতেও পারল না। তবে এইটা জানি কালকে ওর জামাই আসছিল দেখা করতে বিকালে।’
‘দেখা করতে আসছে! আপনারা দিলেন কেন দেখা করতে?’
‘আমি জানতাম না ম্যাডাম। আর আমরাতো মানা করতে পারি না যদি গার্জিয়ান দেখা করতে আসে।’
‘গার্জিয়ান! ওরা তো ওর গার্জিয়ান ছিল না। ছিল জানোয়ার।’ দাঁতে দাঁত পিষে বলে তমা।
‘আমি কি বলবো, বলেন? নিয়মতো নিয়মই।’ মাথা নেড়ে বলতে বলতে চলে যায় মাহফুজা, হোস্টেলের সুপার। একেবারেই যাওয়ার জায়গা নেই অথবা একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার এমন মেয়েদের জন্য ওদের সংস্থা একটা হোস্টেল পরিচালনা করে। আয়েশাকে সেখানেই রাখা হয়েছিল। অথচ মেয়েটা কোথায় চলে গেল। ফিরে গেছে ওই নরকে? তমা ভাবতে পারে না। মানতে পারে না। খুব কষ্ট হয়।
................................. ......................... ...........................
তমাদের সংন্থা বিভিন্ন দেশী-বিদেশী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, কিংবা ব্যক্তিগত ডোনেশন গ্রহণ করে থাকে। যেহেতু তাদেরকে মামলা বা অসহায় মেয়েদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। তাছাড়া একটা ছোটখাট হাসপাতালও আছে যা ওরা পরিচালনা করে। হাসপাতালের প্রধান তমাকে খবর দিয়ে পাঠিয়েছেন যে এক প্রবাসী ভদ্রলোক এসেছেন কিছু ডোনেশনের জন্য। ভদ্রলোক এইচ আই ভি পজিটিভ। খুবই অসুস্থ। তার কিছু ব্যক্তিগত কথা বলার আছে। তিনি নাকি বলছেন, “পাপ স্বীকার”। আর তিনি ভর্তিও হতে চান এই হাসপাতালেই। বিশদ আলোচনার জন্য তমার যাওয়া প্রয়োজন।
কৌতূহলী হয়ে উঠে তমা। একটু তাড়াতাড়ি কাজ-টাজ গুছিয়ে বের হয়ে পড়ে অফিস থেকে। “পাপ স্বীকার”, তমা এটা বিশ্বাস করতে পারে না যে কোন পুরুষ মানুষের পাপ স্বীকার করার মত সাহস আছে। তমা বিশ্বাস করে না, কাউকে না।
চলবে.........
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৫৩